ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

রোমাঁ রোলাঁ ও রবীন্দ্রনাথ : কথোপকথন

অনুবাদ : জুয়েল মাজহার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০১ ঘণ্টা, আগস্ট ৭, ২০১০
রোমাঁ রোলাঁ ও রবীন্দ্রনাথ : কথোপকথন

[রোমাঁ রোলাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যোগাযোগ ঘটে ১৯১৯সালে; ওই সময়টায় রবীন্দ্রনাথ সংকীর্ণ জাতীয়তাদের যে সংজ্ঞা দেন সেজন্য চিঠি লিখে রোলাঁ তাঁর প্রশংসা করেন। রোলাঁর অনুরোধে, ঠাকুর La Déclaration pour l` indépendence de l`esprit নামের একটি ঘোষণায় স্বার করেন।

সম্ভবত এটি ছিল যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী বুদ্ধিবৃত্তিক অভিমত সংগ্রহের প্রথম সমন্বিত প্রচেষ্টা। তাঁদের দু’জনার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে পারিতে (Paris), ১৯২১ সালের এপ্রিলে। যে কথোপকথনটি এখানে তুলে ধরা হলো সেটা হয়েছিল ১৯৩০ সালের আগস্টে জেনেভাতে। তাঁদের এই কথোপকথনের ওপর প্রথম প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় এশিয়া (Asia ) পত্রিকায়, ১৯৩৭ সালের মার্চ মাসে। ]


রবীন্দ্রনাথ: আপনার কি মনে হয় আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জেনেভা গুরুত্বপূর্ণ কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে?

রোলাঁ: হয়তো পারবে, তবে তার অনেকটাই নির্ভর করছে কয়েকটি বিষয়ের ওপর, যেগুলোর ওপর জেনেভার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
রবীন্দ্রনাথ: এ বিষয়টা নিয়ে এখানে যারা কাজ করছে, আমার মনে হয় সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ সেগুলোরই একটি। ঠিক এ মুহূর্তে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে ঠিকঠাক জায়গায় ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে সহায়ক ভূমিকা পালনের মতো অবস্থা এর আর নেই। রাজনৈতিক জগতে বৃহত্তর ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠার শক্তি হিসেবে সে আবির্ভূত হতে পারে অথবা না-ও পারে। এ কাজে নিয়োজিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী, সমাজ ও ব্যক্তি-মানুষের ওপর আমার অগাধ আস্থা; আর আমি আশা করি যে, শেষ পর্যন্ত এরা সবাই মিলে সত্যিকার অর্থেই জেনেভায় আন্তর্জাতিক কর্মযজ্ঞের একটি নির্ভেজাল কেন্দ্র গড়ে তুলতে পারবে, যা তৈরি করে দেবে ভবিষ্যৎ রাজনীতির সোপান।
 
 রোলাঁ: আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রাচ্যের তরফ থেকে এ ব্যাপারে একটি বার্তা পাবার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপো করছে। তাদের ধারণা ভারতবর্ষ-- আর আমি নিজেও বলতে চাই-- হচ্ছে গিয়ে সেই দেশ যে এ ব্যাপারে বিশ্বকে সে বার্তাটি দিতে পারে।

রবীন্দ্রনাথ: ভারতবর্ষ সম্ভবত একজন যুগপুরুষ পেয়েছে যিনি হচ্ছেন উনিশ শতকের বিশ্বজনীন মানসসম্পন্ন প্রথম ব্যক্তি; তাকে ভারতবর্ষ কী করে পেল সেটা এক কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার বটে। আমি রাজা রামমোহনের কথা বলছি; তিনি এক সত্যানুরাগী। এক গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান তিনি, তবুও যাবতীয় কুসংস্কার আর অন্ধ আচারের শৃঙ্খল ছিন্ন করেছেন অবলীলায়। তিনি বৌদ্ধধর্মকে বুঝতে চেয়েছিলেন, পাড়ি জমিয়েছিলেন তিব্বতে, শিখেছিলেন হিব্র“, গ্রিক, আরবি, ফার্সি, ইংরেজি আর ফরাসি ভাষা; চষে বেড়িয়েছিলেন ইউরোপ, আর মারা গিয়েছিলেন ব্রিস্টলে। সত্য তাঁর কাছে বিশেষ কোনো ধর্মালয়ের সংকীর্ণ গণ্ডীর বাসিন্দা যাজক-পুরুতের গৎবাঁধা ধারণার নামান্তর ছিল না; অথবা মতবাদ প্রচারের পেশাগত অধিকারবলে কেউ লোকের ওপর বাইরে থেকে একে চাপিয়ে দিতে পারবে এমনটাও তিনি মনে করতেন না। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, কেবল আধ্যাত্মিক ঐক্যই পারে গোটা মানবজাতির মেলবন্ধন ঘটাতে; আর ধর্মের আসল উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানবিক সম্পর্কের মৌলিক ঐক্যের, মানবিক উদ্যমের আর অর্জনের সেই মোম জায়গাটিতে গিয়ে পৌঁছানো।

 রোলাঁ: ভারতবর্ষে ধর্মীয় সহনশীলতার ব্যাপারটা কেমন সেটা নিয়ে প্রায়শই আমি ভাবি; আমাদের প্রতীচ্যে আমরা যেমনটা দেখতে পাই, ভারতবর্ষে ব্যাপারটা তেমন হওয়ার কথা নয়। আপনাদের ধর্মের মহাজাগতিক চারিত্র্য আর আপনাদের সভ্যতার বহুরূপতার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে।    
ভারতবর্ষ সব ধরনের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচারকে যুগপৎ বিকশিত হতে দিয়েছে।  
 
রবীন্দ্রনাথ: হয়তো এটা আমাদের দুর্বলতাও, আর এই নির্বিচার সহনশীলতার কারণে ভারতবর্ষে সব ধরনের ধর্মমত আর স্থূলতা মিলেমিশে ভজকট পাকিয়ে বসেছে; এর ফলে আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের সত্যিকার ভিত্তিটা যে কী সেটা অনুধাবন করা আমাদের জন্য হয়ে পড়েছে দুরূহ। যেমন ধরুন পশুবলি, এর সঙ্গে আমাদের ধর্মের কানাকড়ি সম্পর্কও নেই; এ-সত্ত্বেও চল্ আছে বলে অনেকে একে মেনে নিচ্ছে। সব দেশেই ধর্মের অনুরূপ বিচ্যুতি দেখতে পাওয়া যাবে। ভারতবর্ষে আজ আমাদের ভাবনার বিষয় হচ্ছে এসবকে বিদেয় করে বৃহত্তর বিশ্বাসকে প্রবল ও গাঢ়তর করা; আর সেটাই হচ্ছে গিয়ে আমাদের সতিকারের আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার।


রোলাঁ: খ্রিস্টধর্মের বাণীতেও দেখতে পাই পশুবলির বিষয়টিই প্রাধান্য পেয়েছে। ধরা যাক প্রথম পরিচ্ছেদগুলো:
 ঈশ্বরের কাছে হাবিলই বেশি পছন্দের কেননা সে ঈশ্বরের নামে পশু কোরবানি দিয়েছে।
 
  রবীন্দ্রনাথ: ওল্ড টেস্টামেন্টের ঈশ্বরকে আমি কখনই ভালোবাসতে পারিনি।


রোলাঁ: ...ভুল জায়গাটিতে জোর দেওয়া হয়েছে, আর বৃহত্তর অর্থে এই মনোভাবটা আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে যায়ও না।
 
 রবীন্দ্রনাথ: আমাদের উচিত হবে সবসময় এই ‘বৃহত্তর অর্থ’টিকেই গুরুত্ব দেওয়া। সত্য যেখানটায় এসে ইতিবাচক অশুভের মুখোমুখি হয়, তখন সে আর সহনশীল থাকতে পারে না; সত্য হচ্ছে সূর্যালোকের মতো, যার উপস্থিতিতে অপজীবাণুদের টিকে থাকা হয়ে পড়ে অসম্ভব; সত্যি বলতে কী, ভারতবর্ষের ধর্মীয় জীবন আজ সহনশীলতার শুভবাদী মানসিকতার অভাবে পীড়িত, আর এই মানসিকতাই হচ্ছে সৃজনশীল ধর্মের মৌল বৈশিষ্ট্য। বলতে কী, নাস্তিকতাও  আজ ভারতবর্ষের উপকারে আসতে পারে; যদিও আমার দেশ চিরায়ত বিশ্বাস হিসেবে নাস্তিকতাকে কখনোই গ্রহণ করবে না। এটা (নাস্তিকতা) বনের সব তিকর আগাছাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, আর দীর্ঘদেহী গাছেরা থেকে যাবে অটুট। ঠিক এ মুহূর্তে, এমনকী পশ্চিমের অস্বীকৃতির উপহারটুকুও ভারতবাসীর একটা বড় অংশের জন্য হয়ে উঠবে মূল্যবান।

রোলাঁ: আমি মনে করি বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ ভারতের এই প্রশ্নটির সমাধানে সহায়ক হবে।


রবীন্দ্রনাথ: আমি জানি, সুদীর্ঘ কাল-পরিসরে ভারতবর্ষ কখনই নিছক বুদ্ধিবৃত্তিক প্রত্যয়ে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারবে না; একদিন অবশ্যই ফিরে আসবে ভারসাম্য আর ঐক্য। সে কারণেই কোনো একটি দিকের প্রতি যদি সাময়িক ঝোঁক তৈরি হয়,তবে সেটা আধ্যাত্মিক জীবনের মূল উৎসে ফিরে যেতে আমাদের সাহায্য করবে। নিজেদের শেষমেশ মানবিক করে তোলার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান হবে আমাদের সহায়।

রোলাঁ: সম্ভবত আধুনিক দুনিয়ায় বিজ্ঞানই হচ্ছে সবচে আন্তর্জাতিক এক প্রপঞ্চ; আর তা হচ্ছে বিজ্ঞান-গবেষণায় সহযোগিতার মনোভাব। তবে কিনা আজকের পৃথিবীতে রাজনীতিকদের হাতে আছে যাবতীয় বিষাক্ত গ্যাস। এটা বেদনাদায়ক যে, বিজ্ঞানীরা এখন সামরিক মতাধরদের হাতের পুতুল; সংস্কৃতি নিয়ে, মানবচিন্তার উন্নয়ন নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ওদের নেই...সমস্যাটা যতোটা না জাতিতে জাতিতে বিরোধে, তার চেয়েও জাতির নিজের মধ্যেই বিভিন্ন শ্রেণীতে-শ্রেণীতে বিরোধের মধ্যে ঢের বেশি নিহিত। অবশ্য আগ্রাসী জাতীয়তাবাদের অভিশাপ ও যুদ্ধংদেহী মনোভাব তাতে কোনো অংশে কমে না বা এর যৌক্তিকতাও প্রমাণিত হয় না।  
 
রবীন্দ্রনাথ: শব্দ যতোটা সজ্ঞান, রেখা ততোটা নয়। চিন্তার (আইডিয়া) নিজস্ব আকার এবং রঙ আছে যা চিত্রকলায় মূর্ত হয়ে ওঠার অপোয় থাকে। এ মুহূর্তে ছবি আঁকার বাতিকে পেয়ে বসেছে আমাকে। আমার সকাল শুরু হতো গান আর কবিতা দিয়ে; আর এখন, জীবন-সায়াহ্নে এসে মন আমার ভরে আছে আকার আর রঙে।

অমিয় চক্রবর্তী সম্পাদিত
এক রবীন্দ্র-পাঠক থেকে

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৫৩০, আগস্ট ০৬, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।