নারীতীর্থপথ
সরসর করে পুরুষেরা ঢুকে পড়ে
সরীসৃপের তলায় সূর্যের ফাটল
নিয়ত সান্ধায়া যায় কারো দেহে
অন্ধপথ ধরে কিলবিল মিহি ছল
যে গীত গাহিত মেয়ে প্রফুল্লবিরলে
বিকালে খুলিয়া কেশ গীতঅন্যমনে
বৃষ্টিরূপ সোদা গন্ধে সারাটা শরীর
জাগিত তাহাতে হেম কবিপ্রাণ ভনে
তোমারে আনিয়া দিই মনের ময়ূর
হৃদি বান্ধ যত ফুল সারিন্দার সুরে
যত পদ্য মনপুঁথি লিখন পৃষ্ঠায়
হাসি ফোটে অপলক অস্ফুট নূপুরে
চণ্ড পুরুষেরা ওই যোনিপদ্ম ছিঁড়ে
শীশ্নসূচে ভরে তোলে নিজেরি শরীর
পুরুষেই পুরুষ-জন্ম নারী ছত্রখান
চক্ষু আছে তবু সে তো আজন্ম বধির।
এসো তুমি ব্রাত্যকবি কহো ব্রাত্যকথা
কী যে রঙ্গ বিষম সঙ্গ ধরায় এমত
মানবভজনা কর মানব-মানবী গাহ
সমস্বরে বল সবে নারীতীর্থপথ।
সুইসাইড নোটস্
এই আসবাব এই স্তব্ধতা এই নিঝুম বনতল
একজন মানুষ একা একটা চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছে
টেবিলটা ঠান্ডা, অস্তগামী, তবে দ্রবীভূত নয়
শীতে কাঁপতে কাঁপতে রেইনট্রি ফরেস্ট নিজেই
পাতাঝরা দিনের গল্প বলে গেল
সোফাটা নিঃসঙ্গ গাছের জন্য কেন যে আর্তনাদ করে উঠল
ওর শাখাগুলো ডুকরে কাঁদল
এই বাড়ির মধ্যে কিছুক্ষণ আগেই বৃত্তাকারে নৈঃশব্দ্য ঘনিয়ে উঠেছিল
নৌকার মতো তাও আমার অস্তিত্বের ভেতর দিয়ে ভেসে গেল
স্তরীভূত স্ফটিকের বেদনাশূন্যতা একধরনের রক্তগোলাপ
ফাঁপা পাইপের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে থাকা বাতাস
জীবনের প্রচণ্ড তিক্ততা নিয়ে সমুদ্রের তলদেশ থেকে
তুমি পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে আছো
তোমার এই চেয়ে থাকাটা গোলাপের মতো বর্ণিল, উষ্ণ,
কত যে মাছ সন্তের মতো বার বার নড়েচড়ে উঠছে
তুমি জানো না হয়তো কারো জন্য তাক করে আছে
অথবা কিছু একটা খুঁজছে অথবা নিজেকেই আশ্রয় দিচ্ছে
খুঁজছে স্বপ্নবীজ আর দূরবীন
তাদের চোখ এতটাই খোলা যে মনে হয়
চোখের মনিগুলোকে কারা যেন শূন্যে ঝুলিয়ে রেখেছে
পৃথিবীতে গড়িয়ে পড়বার আগে তোমার আত্মা তারা হয়ে আকাশেই
ঝুলতে থাকবে
অনেক কিছুরই ব্যাখ্যা দিচ্ছিলে তুমি
বন্দুকের নলের মুখে তুমি কি স্থির নাকি উটপাখির মতো
বালিতে মুখ গুঁজে থাকো
প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর পাহাড়ের কতটা উঁচুতে উঠেছিলে
শেষ বিচারে উপসংহারটা ঠিক এরকম নয়
তুমি লিখতে চেয়েছিলে শান্ত স্নিগ্ধ কবিতা
কিন্তু বনান্তর থেকে তুলে আনা কাঠের চেয়ারে ঝিমুতে ঝিমুতে
তোমার মুখটা পৃথিবীর দিকে হেলে পড়ল
তুমি নিজেই লিখে রেখে গেলে তোমার নিজের সুইসাইড নোটস্।
জিরাফজন্ম
তোমার অনুপস্থিতিই আমার নিঃশ্বাসবায়ু, অগ্নি ও চুম্বন,
এই তো আমার দীর্ঘ জিরাফজন্ম, নিয়তিতাড়িত,
প্রণয়ের পাশে গাঢ় অন্ধকার, নক্ষত্র ও নৃসংশতা।
পানশালায় ঢুকে পড়বার আগে শরীরে পেতেছি ঘুম,
যদি পারো, দেবী, প্রহরপাখির মতো ওই নীল আকাশটা
পালকের পিঠে চড়ে একবার ঘুরে আসো।
প্রণয়ের জন্যে আমরা চেয়েছিলাম কাঠবিড়ালির জীবন
ক্ষিপ্র চলা, মেঘে মেঘে দুজনের সৌরপরিভ্রমণ
রৌদ্রে ছিল গুপ্তকথা, আমার আত্মাকে চিরে চিরে
তুমি ভরে দিয়েছিলে রশ্মি, সূচ, ছিন্ন জীবন আর মেঘকে
সেলাই করে পতাকার মতো ওড়াতে পারোনি
বাঘের খড়খড়ে জিভে আমার ঊণপৃথিবী, দিন যায়,
প্রসূতিসদন থেকে আগুন মুখে আমি বেরিয়ে আসি
তোমার হৃদয়তন্ত্রী ছুঁয়ে ধমনীতে বয়ে যায় নীলরক্ত
শরশয্যা থেকে সোনালি মেঘের পিঠে উঠে দাঁড়াই
দূর মরুভূমি থেকে লু হাওয়া ছুটে আসছে, তপ্ত,
আমার শোনিতে মিশে যাওয়ার আগে
তোমার সবুজ মরূদ্যানের কাছে এসে প্রতিধ্বনি তুলি
জ্বলন্ত তরবারি, বিদ্যুৎ ঝলকের মতো তোমার শরীর,
দূরত্বে থেকেও তোমাকেই আমি ছুঁয়ে দিই।
মহিমা বীজের, স্বপ্নঠোঁটে কতবার চুমু খাই
যতবার জেগে থাকি তোমার ভেতরে উজ্জ্বললোহিত
উদ্ভিদের মতো আমি ফুটে উঠি।
প্রেম, সিংহের থাবার নিচে রূপকথা ইঁদুরের শান্ত ঘুম
প্রেম, দূরত্বে যাপিত সোনালি চুলের হৃদয়কথন
প্রেম, তোমার আমার অবিচ্ছিন্ন উপনিবেশ
প্রেম, তোমার ঝলসে-ওঠা অস্তগামী অহংকারী ছুরির তলায়
অন্য কোনো নারীর চিবুক ছুঁয়ে তার কষ্ট শুষে নিয়ে
দিগন্ত দেখার সবুজ ঝরোখা।
তোমার বাবার জন্যে
মৃত্যু এক অলৌকিক সৌরপর্যটক, আত্মার স্নিগ্ধ আবর্তন
মৃত্যুর পর থেকে তোমার বাবার আত্মা তাই তোমাদের জন্যে
এই পৃথিবীতে ছড়িয়ে রেখে গেছে
নদী,
পাহাড়,
সমুদ্র আর
পাখির পর্যটন
চাঁদ দেখার লোভে তোমার বাবার আত্মা রাতের নির্জনতায়
এখনো তোমাদের বাড়ির চারদিকে একা একা ঘুরে বেড়ায়
বাঘের থাবা থেকে মৃত্যুকে কেড়ে নিয়ে তোমাদের জন্যে রেখে গেছেন
পেয়ারার ঘ্রাণে দ্যুতিময় দ্বিপ্রহর
এই যে শব্দ, সেও তো দিনশেষে তোমাকে কাছে টেনে নিয়ে
কুয়াশাজড়ানো অভিমানী বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে শুধু তোমারই সঙ্গে
তোমার বাবা একটার পর একটা অর্থহীন গল্প বলে যায়।
মৃত্যু এক মহাজাগতিক জলপ্রপাত
তোমার বাবার আত্মা বেহেশতে ঘুরতে ঘুরতে তাই শুধু তোমাকেই
তোমার বিপন্ন জ্বলন্ত শরীরে ঝরিয়ে দেয় জলকণা
প্রতিটি মৃত্যুর দিনে কান্নার অতল থেকে উঠে এসে
বাবার অশরীরী শরীরটাকে তুমি পরম মমতায় বার বার
মন্ত্রমুগ্ধ কম্পমান আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দাও।
দেখো, শাদা সারসের ডানা খুলে তোমার বাবার আত্মা শান্ত দিঘি,
সরষের হলুদ দিগন্ত, ধানক্ষেত, নদী পেরিয়ে সৌরলোকে মিশে যাচ্ছে।
আত্মরতি
ধৃতিময় রাত,
শিড়দাঁড়া বেয়ে কোমলগান্ধার
চুঁইয়ে চুঁইয়ে শীত নামে
মায়ালোকে নেকড়ের মসৃণ আঁচড়
নির্জনতা দ্বিধা মধ্যযামে
যে আসে সে নিজেই বুঝি-বা
আত্মদগ্ধ বিষাদপ্রতিমা
আরণ্যের গাঢ়ঘুম নিয়ে ঢলে পড়ে
অস্তমিত সবুজ দ্রাঘিমা
কী যে অপঘাত!
বাংলাদেশ সময়: ১২৩২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৬