ঢাকা, শুক্রবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

সোনামুদ্দির দেশভাবনা | আব্দুল হালিম মিয়া

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩২০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১৬
সোনামুদ্দির দেশভাবনা | আব্দুল হালিম মিয়া

সূর্য ডোবার ঠিক আগ মুহূর্তে সোনামুদ্দিকে খুঁজে পাওয়া যায় না। সব কাজকর্ম ফেলে কোথায় যেন হারিয়ে যায়।

প্রথম প্রথম ভাবতাম হয়তো এদিক সেদিক বিড়ি ফুঁকতে কোথাও লুকিয়ে আছে। পরে দেখি যে নাহ, এটা অনেকটা রুটিন হয়ে গেছে। হন্যে হয়ে খুঁজতে বের হলাম। সন্ধ্যা লেগে যাচ্ছে। অন্ধকার ঘনিয়ে আসার আগেই হ্যারিকেনের চিমনি মুছতে হবে। সোনামুদ্দি ছাড়া এই কাজটা নিখুঁতভাবে কেউ করতে পারে না।
 
বাড়ির পাশেই কুলকুল করে ছোট নদীটা বয়ে যায়। সারাদিনের ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের পর অনেকেই বিকেলের দিকে এখানে আসেন গা-টা জুড়িয়ে নিতে। মাঝে মাঝে সোনামুদ্দিকেও সেখানে যেতে দেখেছি। সেখানেই গেলাম তাকে খুঁজতে। সত্যি তাই, তিনি একটা বড় গাছের পাশে অনেকটা আধশোয়া অবস্থায় বসে চোখ দুটো মুদে আছেন। মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলি, কি সোনামুদ্দি, এভাবে বসে বসে কী করছো?
কিছু করছি না, ভাবছি।
তাই? তোমার হাতে পত্রিকা, ঘটনা কী? কিছুটা উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
না, বিশেষ কোনো কারণ নেই। তবে প্রতিদিনের নানা সমস্যার কথা পত্রিকায় দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে গেছি। ভাবছিলাম, আমি যদি প্রধানমন্ত্রী হতাম, তাহলে কী করতাম!
বাহ, তাই নাকি? ইন্টারেস্টিং ব্যাপার! আমার সাথে শেয়ার করা যায়?
নাহ, ভাইজান, হ্যারিকেনের চিমনি মুছতে হবে। দেরি হয়ে গেছে, আমাকে উঠতে হবে। বলেই উঠতে চেষ্টা করল সোনামুদ্দি।



ভাবছিলাম, আমি যদি প্রধানমন্ত্রী হতাম, তাহলে কী করতাম!
বাহ, তাই নাকি? ইন্টারেস্টিং ব্যাপার! আমার সাথে শেয়ার করা যায়?
নাহ, ভাইজান, হ্যারিকেনের চিমনি মুছতে হবে। দেরি হয়ে গেছে, আমাকে উঠতে হবে। বলেই উঠতে চেষ্টা করল সোনামুদ্দি
 

আমি তাকে জোর করে বসিয়ে দিলাম। বললাম, আজ তোমাকে না দেখে, রহিমুন বোধহয় এতক্ষণে কাজটা সেরে ফেলেছে। তার চেয়ে তুমি বলো, তুমি যদি সরকার প্রধান হতে কী করতে?
কোনো রকম ভণিতা না করে সোনামুদ্দি বলতে শুরু করল।
 
শোনেন ভাইজান, দেশ নিয়ে আমরাও ভাবি, মনে কইরেন না দেশটা শুধুই আপনাগো।
ঠিক আছে, ঠিক আছে, তুমি বলো তোমার ভাবনাগুলো। আমি সেগুলো প্রচারের ব্যবস্থা করে দিব। বলো, তুমি প্রধানমন্ত্রী হইলে কী করতা?
 
এইবার সোনামুদ্দি কিছুটা যেন লজ্জা পেল। হলুদ কটাসে দাঁতগুলো বের হয়ে এলো, মাথাটা অন্যদিকে একটু ঘুরিয়ে নিয়ে, অনেকটা আনমনা ভঙ্গিতে বলতে শুরু করল।
ধরেন কাল সকালে আমি আজগুবি কায়দায় কেমনে যেন দেশের প্রধানমন্ত্রী হইয়া গেলাম। প্রথমেই আমি আপনার ভাবীরে লইয়া প্রধানমন্ত্রীর যে অফিস, টুপলা টুপলি নিয়া সেই অফিসেরই দুইটা কামরা নিয়া বাসা বানাইয়া ফেলতাম। সেখানেই আমার অফিস সেখানেই আমার বাসা।
কেন এত সুন্দর বিশাল গণভবনে উঠতা না?
না। অযথা রাস্তায় আমার গাড়ি বাইর করতাম না। খুব জরুরি প্রয়োজন হইলে যেমন বিদেশ ভ্রমণ বা ঢাকার বাইরে কোনো জরুরি কারণে যাইতে হইলে বের হতাম, না হলে যেখানে অফিস সেখনেই আমার বাসা থাকত। যাতে আমার কারণে রাস্তার যানজটের জট আরো বাইড়া না যায়।
বাহ খুব ভালো, আইডিয়া। তারপর?
সচিবালয়টা গাজীপুর বা পুর্বাচলে নিয়ে যাইতাম ছয়মাসের মধ্যে। ঢাকার কেন্দ্রীয় জেলখানা নিতাম নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানায় বা জিঞ্জিরা এলাকায়।
তারপর?
ঢাকা শহরে বাসকারী সকলের রেজিস্ট্রেশন করে ফেলতাম কয়েক মাসের মধ্যে। তারপর ঘোষণা দিতাম, কোনো পরিবার একটার বেশি গাড়ি রাখতে পারবে না। কারো যদি একটার বেশি গাড়ি থাকে তাহলে তাকে ঢাকার বাইরে চলে যেতে হবে অথবা বাইরে ব্যবহার করতে হবে। অড-ইভেন ব্যবস্থা চালু করতাম। সোম, বুধ, শনি অড নাম্বারের গাড়ি চলবে, রবি, মঙ্গল, বৃহস্পতি ইভেন নাম্বারের গাড়ি চলবে। শুক্রবার ফ্রি।
 
যতদিন সচিবালয় ঢাকায় থাকবে, ততদিন মন্ত্রীরা স্কুল বাসের মতো কয়েকটা সরকারি বাসে করে অফিসে আসবে। মানে হলো, দশ বারোজন একসাথে। বাসের সাথে জাতীয় পতাকা লাগানো থাকবে। যারা এতে আপত্তি করবে, তাদের বাসা নিতে হবে সচিবালয়ের কাছের কোনো এপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে। মিন্টু রোডের আলিশান বাড়ি ভাইঙ্গা দিতাম একমাসের মধ্যে। এত বিশাল জায়গা, বাড়ি মাত্র একজন মন্ত্রীর জন্য রাখতাম না। সব ভাইঙ্গা বিশতলা, ত্রিশতলার বহুতল আবাসিক ভবন করে দিতাম।
তারপর?
সচিবালয় পুর্বাচলে গেলে সেখানেও মন্ত্রীদের থাকার জন্য অফিসের সাথেই বহুতল ভবন করে দিতাম যাতে তাদেরকে বহনকারী গাড়ি অযথা হু হু করে হুইসেল বাজায়ে জনগণের সেবা দেয়ার নামে নির্বাচিত হইয়া জনগণরে দাবড়াইয়া বেড়াতে না পারে।
বাহ ইন্টারেস্টিং। তারপর?
আর একটা কাজ করতাম। প্রায়ই দেখা যায় মন্ত্রীরা সচিবালয়ে আসেন একটা বা দুইটা মিটিং কইরা আবার চলে যান। কাজেই তাগো এইসব মিটিং করার জন্য বাসা থেকে মানে রিমোট বা কনফারেন্স কলের মিটিং বাধ্যতামূলক করে দিতাম।
মানে কী?
 
মানে হলো, ধরেন আপনি ফার্মগেটের কাছে দুই ঘণ্টার জামে আটকা পইড়া গেছেন। আপনার কাছে মিটিং ইনভাইটেশন গেছে আরো সাতদিন আগে, ইমেইলের মাধ্যমে। সেখানে একটা কনফারেন্স কলের নাম্বার ও পাসওয়ার্ড দেয়া হয়েছে। আপনি ফার্মগেটের জামের মধ্যেই বসে ওই নাম্বারে ডায়াল করে পাসওয়ার্ড এন্টার করলেই আপনি দশ বিশ বা পঞ্চাশজনের মিটিংয়ে ঢুইকা গেলেন।
 
কষ্ট কইরা সচিবালয়ে আইসা শরীর মন খারাপ করা লাগল না। মিটিং আধা ঘণ্টার, আইলেন চার ঘণ্টা ধরে, বাড়ি ফিরলেন তিনঘণ্টা রাস্তার জামে, এইটা কিছু হইল, ভাইজান? আপনেই কন?
তুমি তো ঢাকা শহরের যানজট অর্ধেক কমাইয়া দিলা সোনামুদ্দি! আর কী করবা?
খাড়ান, একটু পানি খাইয়া লই, বলেই সোনামুদ্দী পাশের সরকারি টিউবওয়েল থেকে হাত মুঠি করে ঢক ঢক করে পানি পান করতে লাগল।



বাংলাদেশ সময়: ০৩০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১৬
টিকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।