মুখ খুলছি
মানিক বন্দোপাধ্যায় উনচল্লিশটা উপন্যাস লিখেছিলেন তার আটচল্লিশ বছরের নাতিদীর্ঘ জীবনে, এইসমস্ত উপন্যাসে কোনো উৎসর্গপত্র ছিল না, কেন ছিল না আমি জানি না তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো লেখকের জীবদ্দশায় যেসমস্ত উপন্যাস বেরিয়েছিল, দু’একটা বাদে ওসবের কোনো ভূমিকাও ছিল না। এ প্রসঙ্গে মানিকের বক্তব্য ছিল: আস্ত একটা বই লিখছি, লেখক হিসেবে এইতো আমার ভূমিকা—সুতরাং আলাদা করে বইয়ের শুরুতে ভূমিকা লিখবার কিছু নেই।
লোকটা নিঃসন্দেহে বাংলাসাহিত্যে তারাশংকরের পাশাপাশি থাকবেন—কেউ কারে নাহি জিনে সমানে সমান রকম। তিনি যখন উপন্যাসের ভূমিকা নিয়ে এইরকম ভাবেন, আমাদের গুরুত্ব দিতেই হয় যদিও এই যে লিখছি নিজের প্রকাশিত প্রথম পুস্তক ‘কোলাহলে’ নিয়ে—একে কী বলা যেতে পারে? বইটি কেন লেখা হলো, কী মাথায় রেখে লেখা হলো নানা রকম প্রশ্ন চারপাশে ঘুরছে, সতীর্থ অনেকেই এ নিয়ে বিস্তর লিখছেন—চমৎকার সব গল্প বেরিয়ে আসছে।
‘কোলাহলে’ যা
‘কোলাহলে’ প্রায় সতেরো হাজার শব্দের একটি উপন্যাস। এ আকৃতির আখ্যানগুলোকে পশ্চিমাদেশে আদর করে ডাকা হয় নভেলা। নভেলের ছোট রূপ তাই নভেলা, বড় গল্পের চেয়ে এর আকার বড় আবার বিশাল ক্যানভাস উপন্যাসের চেয়ে ছোট, খানিকটা ঘোঁড়া আর গাধার মাঝামাঝি থাকা খচ্চরের মতো।
কোলাহলের শব্দসংখ্যা নভেলার মতো হলেও আমি এটিকে উপন্যাস বলছি এর পটভূমির জন্য, সেটি দক্ষিণবঙ্গের খুলনা অঞ্চল। গোটা দক্ষিণবঙ্গের মানুষেরাই নির্মম ও কঠিন হয় এইরকম প্রচলিত। বিষয়টা ভুলও না, এ অঞ্চলের মানুষেরা কাটায় দুর্মর কঠিন জীবন, এদের জীবন সংগ্রামটা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে একটু দুঃসহ বলা চলে; ফি বছর ঢাকা মহানগরিতে অজস্র লোক প্রবেশ করে, তাদের অধিকাংশই আসে দক্ষিণবঙ্গ থেকে কারণ জীবিকার অভাব।
এই কঠিন সময়যাপনকারি লোকগুলোকে নিয়ে আমি কি একটা আঞ্চলিক উপন্যাস লিখলাম? উত্তর হচ্ছে—নেগেটিভ। আমি লিখেছি আমার শৈশব কৈশোরে দেখা মানুষদের আখ্যান, যারা প্রতিমুহূর্তেই আমাকে তাড়িয়ে ফেরে—আমার মগজে তৈরি করে স্থায়ী এক আবেশ। খুলনায় বড় হয়েছি বলেই দক্ষিণাঞ্চল চলে এসেছে, সেখানের মানুষেরা চলে এসেছে; আমি যদি ইউএস’র ফিলাডেলফিয়ায় বড় হতাম, কোলাহলে নিশ্চয় সেখানকার কোনো জনপদের ভাষ্য হয়ে উঠত। কারণ উপন্যাসটা আমি লিখতে চেয়েছিলাম আমার দেখা চারপাশ নিয়েই। এই চারপাশ নেহাত ছোট না, অজস্র মানুষ এসেছে আর চলে গিয়েছে গল্পটার ক্যানভাসে তাদের রঙ জমা করে, যা থেকে গিয়েছে তা হলো জীবনের চিরন্তন সঙ্গীত—যা সারা পৃথিবীতেই এক।
একটা মুণ্ডুহীন লাশ থেকে শুরু করে গ্রামের কিছু পরিবারের সাজানোগোছানো জীবনে আগত বিশৃঙ্খলা, বন্যার আমলে এক মূল চরিত্রের জন্ম এবং তার ছন্নছাড়া দিবস-রজনী, জুটমিল বন্ধ হওয়ার সময় খুলনা অঞ্চলে যে পরিবর্তন এসেছিল সেইসব দুর্দিনের রেশ কোলাহলে ধারণ করেছে। সব মিলিয়ে আমার কাছে কোলাহলে দুর্যোগের গল্প—সমাধান আঁকা গেল কি না, সেটি বলা আমার কাজ নয়। আবার দেখা যাবে পাঠকের কাছে প্রেমের উপন্যাস হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে কোলাহলে, বস্তুটা এড়িয়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। কারো পক্ষে কি সম্ভব? পৃথিবীর সকল মহৎ উপন্যাসগুলো জুড়েই আছে প্রেম।
পাঁচ-বছর আগের যে এপ্রিল
উপন্যাসটির খসড়া আমি লিখি ২০১০ সনের এপ্রিলে, প্রায় প্রাচীন পাণ্ডুলিপির গায়ে দেখতে পাচ্ছি মার্চের ২৮-এ শুরু হয়ে শেষ হয়েছে ২৬ এপ্রিল। অর্থাৎ সাকুল্যে এক মাস ধরে আমি আখ্যানটা লিখেছিলাম, বিরতিহীন—কারণ লেখালেখি ছাড়া ওই সময় করার মতো কিছুই ছিল না আমার হাতে। আয়-রোজগারের ব্যাবস্থা নেই, কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ না পেয়ে শেষমেশ ভর্তি হয়েছি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে, কলেজ হিসেবে বেছে নিয়েছি পূর্বোক্ত ঢাকা কলেজকেই। নানার বাসায় থাকি-খাই, গল্পের বইয়ে মুখগুঁজে রাখি। গ্রামে আব্বা-আম্মার সাথে যোগাযোগ করি অল্প—তাদের কথা ভেবে মন খারাপ হয়, কত আশা নিয়েই না একমাত্র পুত্রকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন; ওসময়টাতে সবাই ভাবছিল আশার গুড়ে আমি স্থায়ীভাবেই বালি ঢেলে দিয়েছি।
এমুহূর্তে বলা যেতে পারে কোলাহলে লিখবার পিছনের আরো একটি জরুরি গল্প; অলস দিন কাটাতে কাটাতে একজন মানুষ যে হঠাৎ হঠাৎ গল্প লিখছে, সাহিত্য করতে চাইছে—আজন্ম হতে চেয়েছে একজন সত্যিকার লেখক—খাতা ভরিয়ে ফেলছে কবিতায়, সে কেন উপন্যাস লিখবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল?
হুমায়ূন আহমেদের ‘ফেরা’ কিংবা ‘এই বসন্তে’ সে সময় প্রথম পড়েছি, মনে আছে ‘এই বসন্তে’ শেষ করবার পর বুকের গভীরে সুতীব্র হাহাকার জাগছে নিত্যদিন; এক সুররিয়েলিস্টিক আবেশ আমাকে তারা দিচ্ছে—চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি ধুধু ফাঁকা গ্রাম্য মাঠ, অদূরে বৈশাখের নদীতে ভেসে যাওয়া নিঃসঙ্গ লঞ্চ সিঁটি বাজাচ্ছে—আকাশে ভর করছে কৃষ্ণবরণ মেঘ, বৃষ্টি নামবে। উপন্যাস দুটিতে অমন কোনো দৃশ্য ছিল না অথচ পড়তে পড়তে চলে যাচ্ছিলাম আমার ফেলে আসা গ্রামের দিবস-রজনীতে, শৈশব-কৈশোরের যে জীবন সদ্য পিছনে ফেলে এসেছি।
আমি লিখতে শুরু করলাম ওই আবেশকে স্থায়িত্ব দিতেই—যেন তা মোহন এক নেশা; নিজেকে মনে হচ্ছিল উপন্যাসটির পটভূমি পুবপাড়ায় ঘুরে ফিরতে থাকা বোশেখি বাতাস, কেউ আমাকে চেনে না অথচ সবাইকে ছুঁয়ে যাচ্ছি।
উপন্যাস শেষ হবার পর আমার সবচেয়ে কাছের মানুষের কাছে পাণ্ডুলিপিটা রেখে খুলনায় ফিরে গেলাম নির্বাসনে যা মাস ছয়েকের মতো স্থায়ী ছিল। হাতে লেখা কোলাহলে’র খসড়া তার কাছেই রইল ২০১৩ পর্যন্ত, তখনও যার একমাত্র পাঠক ছিল একমাত্র সে-ই। এ বছর থেকে উপন্যাসটিকে আমি গুরুত্ব দিতে শুরু করলাম, মনে হলো তা প্রকাশ করা জরুরি হয়ে পড়েছে সুতরাং লিখতে শুরু করি পুনরায়।
লিখতে থাকি, কাটিছিঁড়ি—অনেক কিছু বদলে নতুন কিছু যোগ হয়। সিদ্ধান্ত নেই উপন্যাসটা জেমকনে পাঠানো যাবে—ওরা তরুণদের পাণ্ডুলিপি আহবান করে প্রতিবছরই কাউকে না কাউকে নির্বাচন করে কিন্তু ওদের ডেট ফি বছর পার হয়ে যেতে থাকে। দেখতে দেখতে ২০১৩ পার হয়, ২০১৪ চলে আসে—সেটিও ফুরিয়ে যায়; কোলাহলে’র ঘষামাজা, নবজন্ম আর হয়ে ওঠে না। লিখি খানিকটা, এরপর ব্যস্ত হয়ে পড়ি গল্প কিংবা অন্য কাজ নিয়ে। এসময়টায় প্রচুর গল্প লিখছি—নানান জায়গায় ওসবের কিছু কিছু ছাপা হচ্ছে। বন্ধুদের সাথে নিয়ে তীরন্দাজ নামে একটা ত্রৈমাসিক সাহিত্যপত্র বের করছি যদিও ১৩’র শেষ থেকে ১৪ সনের জুন-জুলাই পর্যন্ত দু’সংখ্যা বেরিয়ে পত্রিকাটি মারা যায়।
বাংলানিউজের শিল্প-সাহিত্যে ‘নির্বাচিত তরুণের উপন্যাস’ হিসেবে কোলাহলে’র প্রথম প্রকাশ
কোলাহলে’র খসড়াটি পুনরায় শীতনিদ্রায় চলে গিয়েছিল বছর খানেকের জন্য। ২০১৫ সনের মাঝামাঝি বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোরের শিল্প-সাহিত্য পাতা থেকে ঘোষণা দেয়া হয় যে, কর্তৃপক্ষ তাদের আসন্ন ঈদসংখ্যায় একজন তরুণ লেখকের উপন্যাস প্রকাশিত ও পুরষ্কৃত করতে চায়। সুতরাং এই ঘোষণা মাথায় রেখেই আমি একটা চূড়ান্ত চেষ্টা হিসেবে পাণ্ডুলিপিটা নিয়ে আবার বসি। এদ্দিনে আমার লেখার ধাঁচ আমূল বদলে গিয়েছে, দু’বছর আগেও যেভাবে লিখতাম—এখন আর ওভাবে লিখি না। সুতরাং কোলাহলে নিয়ে দু’মাসের চেষ্টায় আমি যা দাঁড় করালাম—তা হয়ে উঠল নষ্টালজিয়া আর বর্তমানের মিশেলে এক অতি সহিজিয়া কাহিনী। এবং খুব কমন ঘটনাটা এসময় ঘটে—জুনের ৭ তারিখে বাংলানিউজের দপ্তরে পাণ্ডুলিপি পাঠাবার শেষ দিন ছিল, আমি মেইল করি ওই শেষ তারিখের সন্ধ্যায়।
নতুন লেখকদের মেইল সাহিত্যপাতার সম্পাদকেরা খুলেও দেখেন না বিষয়টা ভুল প্রমাণ করে মাস দেড়েক পরে ‘কোলাহলে’ নির্বাচিত উপন্যাস হিসেবে প্রকাশ পায় ২০১৫’র ঈদুল ফিতরে—বাংলানিউজের পঞ্চম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যায়। লেখক হিসেবে পুরো বিষয়টা আমার জন্য হয়ে দাঁড়ায় অনেক বড় এক প্রাপ্তি।
প্রথম পুস্তক বিত্তান্ত
শেষপর্যন্ত উপন্যাস হিসেবে ‘কোলাহলে’ কোথায় দাঁড়িয়ে থাকবে সে উত্তর সময়ের কব্জায়। তবে এটুকু তো নিশ্চিত, একজন লেখকের চূড়ান্ত গন্তব্য তার বই—জীবদ্দশায় কিংবা মৃত্যুর পর, সর্বকালেই লেখকের আসল জীবন কাটে তার বইয়ের হাত ধরে। পত্রিকায় প্রকাশের পরেই কেবল মনে হয়েছিল—এদ্দিনে হয়তো প্রথম বইটা প্রকাশ করবার সময় এসেছে।
বইমেলায় আমার এই উপন্যাসটি বই হিসেবে বেরুচ্ছে ঘাসফুল প্রকাশনা থেকে। এ প্রকাশনীর কর্ণধার প্রায় শতভাগ ঝুঁকি নিয়ে কোলাহলে’কে বইয়ে রূপ দিয়েছেন। পাঠকের কাছে একজন আনকোরা লেখকের এ আখ্যান কেমন লাগবে, আগ্রহটা আমার রাত্তিরের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে—কুরে খাচ্ছে মগজ, মনে পড়ছে প্রিয় লেখক বোর্হেসের এই বাণী: ‘আমাদের মগজ স্বপ্ন দেখছে, পৃথিবী ছিল মস্তিষ্কের দেখা স্বপ্ন’।
নোট : ‘কোলাহলে’ আজকে যে অবস্থানে আমাকে নিয়ে এলো, তার পিছনে কিছু মানুষের ভালোবাসা আর বিশ্বাসের ভূমিকা বর্ণনায় তাদের বিরক্তি উৎপাদন করছি না। এ লেখাটি কেন যেন মনে হচ্ছে হারিয়ে যাবে না—এখানে স্বীকার করে নেয়া যাক, তাদের কথা আমি আজন্ম স্মরণ করব—এরচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ক্ষমতা এমুহূর্তে আমার নেই।
____________________________________________________
প্রকাশক: ঘাসফুল। প্রচ্ছদ: মিস্টার গ্রেভসের ব্লাড অ্যান্ড চারকোল অবলম্বনে নবী হোসেন। মূল্য: ১৬০ টাকা। পাওয়া যাচ্ছে অমর একুশে বইমেলায় ঘাসফুলের ১৩৭ নম্বর স্টল ও লিটলম্যাগ চত্বরের ২৩ নম্বর স্টলে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৬
টিকে/