ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

উপন্যাস

ধারাবাহিক উপন্যাস

মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্‌সান (পর্ব- ৫)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪০ ঘণ্টা, মে ১৫, ২০১৬
মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্‌সান (পর্ব- ৫)

৫.
বেসামাল হাতের নাটাই,
উড়ছে তাই হাওয়াই মিঠাই।

বাধ্য হয়ে ছাড়তে হয়েছে আগের থাকার জায়গাটা।


‘মাছ-মাংস ছাড়া জীবনে কিছু আছে নাকি? ঘাস, লতা-পাতা খাইতেছি। সম্ভব না। আমি পারতেছি না। ’ রেগে গিয়ে বলে বড়মামা।
‘মামা, একটু ওয়েট। কয়েকটা দিন একটু সহ্য করো। তারপর ঠিক হয়ে যাবে। ’ বলি আমি।
‘কিচ্ছু ঠিক হবে না। এই বেগুন ভাজা আর পাতলা ডালই খেতে হবে। নিস্তার নাই। আমি শুকনা হয়ে যাবো। এক দিনেই আমার ওজন কমছে পাঁচ কেজি। শিওর। ’ বলে মামা। তার অবস্থা দেখে খারাপই লাগে।
‘মামা ঠিক হয়ে যাবে তো! মাথা ঠাণ্ডা করো। একটু ঘুমাও। ’ বলি।
মামা আমার কথা শোনেন। ঘুমানোর চেষ্টা করেন। আমি নিশ্চিত তিনি ঘুমাতে পারবেন না। মাথায় রাগ আর পেটে খিদে নিয়ে ঘুমানো অসম্ভব। তিনি একটু পরেই আবার আমার সঙ্গে এসব নিয়ে আলাপ করার চেষ্টা করবেন। কথার তুবড়ি ছুটিয়ে রাগ ঝাড়বেন।
মামার সঙ্গে এসব নিয়ে আলাপে যেতে চাচ্ছি না। তাই পালাই। ছাদে যাই।
বুনোর বাসার ছাদটা সুন্দর। পরপর পাটি বিছানো রয়েছে। সঙ্গে ছোট আকারের পাশবালিশ। রোদ নেই। ছায়া ছায়া চারপাশ। বালিশ দেখে একটু ঘুমিয়ে নিতে ইচ্ছে করে।  
গতকাল আর আজ অনেক ঝক্কি গেছে। মায়ের দেখাশোনা আমিই করেছি দু’টো দিন। মামাকে ছুটি দেওয়া হয়েছে। মায়ের সেবার জন্য হাসপাতাল আর হোটেল করতে করতে মামা ক্লান্ত। তাই বাবার কথামতো তাকে ছুটি দিয়েছি।
বাবার সঙ্গে কথা হয়েছে। অঘটনের কথা বলেছি। বলেছি, হাতে কোনো টাকা-পয়সা নেই। হোটেল ভাড়াও নেই।  
বাবা সব শুনেছেন। ঠাণ্ডা গলায় বলেছেন, ‘চিন্তা করিস না। দেখছি’।  
বাবার আচরণে অবাক হইনি। লোকটা বিপদে পড়তে পড়তে এখন আর বিপদকে বিপদই মনে করে না। ডালভাত হয়ে গেছে সব। ব্যাপারটা ভালো না মন্দ বুঝতে পারছি না। জীবনটা কেমন জানি নাটকের মতন আজকাল। প্রতিদিনই অঘটন। ক্লাইমেক্স!
বুনোর বাসায় উঠেছি আগের জায়গা ছেড়ে। বিপদ কাটানোর একটা না একটা উপায় হয়েই যায়। এবারের মতো বুনোই বাঁচিয়েছে। জেনেছে আমাদের বিপদের কথা। মামা গিয়েছিলো। করুণ কণ্ঠে বলেছে সব। মামার আকুতিতে বুনোর মন ভিজেছে। নিজে থেকে উদ্যোগী হয়েই আমাদের বাড়িতে তুলেছে।  
আগের হোটেলের মালিক আকাশ নামে সেই লোকটার পরিচিত। অঘটনের পর তার কাছে খোঁজ নিতে যাওয়া হয়েছিলো। বলা হয়েছে টাকা-পয়সা নিয়ে উধাও হওয়ার কথা। তিনি সব শুনে ব্যবস্থা না নিয়ে বরং হুমকি দিয়েছেন, এ খবর বাইরে না চাউর করার। মামা তাই আর দেরি করেনি। হোটেল ছাড়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। বুনোর বাসাটাও পাওয়া গেছে ঠিক এসময়েই।  
ওরা থাকে বাড়ির দোতলায়। একতলায় আমরা আছি। দু’টো রুম।  

ভাড়া হচ্ছিলো না। পড়ে ছিলো দুই-তিন মাস। রুপিতে মিললেও ফ্যামিলি পাওয়া যাচ্ছিলো না ভালো আবার ফ্যামিলি ভালো হলে এই ভাড়া দিতে নারাজ।  
তাই বুনো আমাদের নিয়ে এসেছে। অল্প কিছু টাকা দিতে হবে। এখনই টাকা দেওয়ার তাড়া নেই। দেশ থেকে টাকা আসলেই হলো। এতে হেল্প করাও হলো আবার কিছুদিন পড়ে থাকা ঘরগুলোর জন্য ভাড়াও পাওয়া গেলো।  
বুনোর মা আমাদের ঘর দিতে রাজি ছিলো না। ভিনদেশি মানুষকে হুট করে বিশ্বাস করাটা ঠিক নয়। বুনো চেঁচামেচি করে রাজি করিয়েছে। সে তার আদরের মেয়ে। আদরের মেয়ের কথা ফেলা যায় না। সামান্য ক্ষতি হলে হোক তবুও!
ছাদে হাঁটতে থাকি এদিক ওদিক। চুপচাপ।  
বাবার কথা মনে পড়ে। লড়াই করে যাচ্ছে লোকটা একাই। দেশে কী করছে এখন কে জানে! জানি চাচা, মামা, খালারা সবাই এড়িয়ে যাচ্ছে আজকাল বাবাকে। ধার নেওয়া হয়েছে অনেক। শোধ করা যায়নি। জমিজমা বেচে শেষ। শুধু বরিশালের বাড়িটাই রয়েছে।  
বাবাকে আজকাল খুব ক্লান্ত মনে হয়! কেমন পরাজিত! মাথাটা একটু নিচু করে কথা বলার চেষ্টা করে। দোষ নেই। যে ঝক্কি তার ওপর দিয়ে যায় তাতে টিকে থাকাই মুশকিল।  
এই মানুষটাই কী ভয়ঙ্কর ব্যক্তিত্ববান ছিলো! তার ভয়ে সবাই কাঁপতো। বাসায় দুনিয়ার নিয়ম-কানুন। রাতে আটটার ভেতর খেয়ে দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তে হতো! এরপর লাইট অন করার নিয়মই নেই। একদম ফজরের আজানের সময় উঠে বাবা হাঁটতে যেতো। ফিরে এসে আমাদের ঘুম ভাঙানোর অত্যাচার। পড়াশোনা করানো। বাবার ভয়ে নিঃশ্বাস ফেলতেও সতর্ক থাকতে হতো।
সেই মানুষ এখন একদম আলাভোলা। আস্তে করে কথা বলে। প্রায়ই এটা-ওটা ভুলে যায়। কী করছে না করছে খেয়াল থাকে না।
বাবার জন্য মায়া হয়। আমার কিছুই করার নেই। কেন যে কিছু করার নেই!
ডলার এনডোর্স নিয়ে ঝামেলাটা মেটা দরকার। বাবার সমস্যা হয়নি। চলে গেছে দেশে। সমস্যা আমাদের।  
পাসপোর্ট নিয়ে ঝামেলা হবে। থানায় গেলেই আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা। টাকা পাঠাচ্ছে বাবা হুন্ডির মাধ্যমে। এটা নিয়েই যতো গন্ডগোল। আমাকে খোলাসা করে বলা হচ্ছে না। বাবা মামাকে নতুন একজনের ঠিকানা দিয়েছে জানি। সেখানে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। টাকা বিষয়ক কিছু মনে হয়।  
বাবা না বললে কী দরকার চিন্তা করার। আমার কী? নিজেই সামাল দিক না। আমার একটু অভিমান হয়।  
‘কতোক্ষণ ধরে আছো?’ বলে বুনো। আজ তার অফ ডে। অফিস নেই। ক্লাসও নেই। আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। একটা সাদা টি-শার্ট পরা আর সঙ্গে ঢোলা পাজামা। এটাকে নাকি প্লাজো বলে। রুবির কাছে জেনেছি। বোনটা বড় হয়ে যাচ্ছে আমার!
‘বেশিক্ষণ না। এইতো। ’ বলি আমি।
‘ভাতঘুম দিতে পারো। পাটি, বালিশ বিছানো। ’ বলে বুনো।  
‘না না। ঠিক আছি। ’ বলি আমি। কেমন সঙ্কোচ কাজ করে কথা বলার সময়। মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার সময় আমি আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলি। খুবই নগণ্য মনে হয় নিজেকে। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় কী জানা নেই।
‘মায়ের জন্য মন খারাপ কোরো না। পৃথিবী এমনই। শুরু শুরু আমারও বাবার কথা মনে করে খারাপ লাগতো। এখন আর লাগে না। মনেই পড়ে না বাবার কথা। বাবার জন্মদিনে মা নিয়ম করে কাঁদে। তারপর একটু পায়েস রান্না করা হয়। প্রতিবছর বাবা বলতে ওই অতোটুকুনই। ’ একটানা কথাগুলো বলে চুপ করে থাকে বুনো। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজায়।
আমি কী করবো বুঝি না। কেন জানি আমার ইচ্ছা করে মেয়েটার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে। সান্ত্বনা দিতে। এই দুপুরে মেয়েটার সব দুঃখ মুছে ফেলতে। ইচ্ছা পূরণ হয় না।
‘এই, তোমাদের খাওয়া-দাওয়ায় সমস্যা হয় তাই না?’ বুদ্ধিমতী মেয়ে প্রসঙ্গ বদলায়।
‘না। না তো। ’ জবাব দিতে গিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে যাই।
‘আহা, ভদ্র হতে হবে না। মুখোশ মনে হয়। জানি ডাল, বেগুন পছন্দ হচ্ছে না। বাই দ্য ওয়ে, চা খাবে?’ বলে বুনো।
‘চা। কোথায়?’
‘আমার ঠাকুমা। অনেক চা খায়। দুধ আর বেশি বেশি চিনি। ডায়াবেটিস থাকলেও কেয়ার করে না। মুড়ি ভিজিয়ে চা খেতে খেতে গল্প করেন। তার কাছে গল্পের খনি। ’
‘ওখানে গিয়ে চা খেতে হবে?’
‘হ্যাঁ’। বলে বুনো।
‘আজ থাক। পরে। ’ আমার যেতে ইচ্ছে হয় না। টাকা পয়সা নিয়ে টেনশনটা আছে। দূর করা যায় না। এমন সময় ভালোও লাগে না কোনোকিছু।
‘টেনশন? মা? টাকা-পয়সা?’ বলে বুনো। এই মেয়ের কাছে কোনোকিছু লুকানো কঠিন মনে হয়।
‘একটু টেনশন। টাকা পাঠাবে বাবা। একটা জায়গায় যেতে বলেছে। সেইফ কিনা জানি না। ’ শুকনো মুখে বলি আমি।
‘হুন্ডি?’ বলে বুনো।
‘হুম। ’
‘কেন যে করো এটা?’ চিন্তিত মনে হয় বুনোকে।
‘উপায় নেইতো। আমার হাতে কিছু নেই। ’
‘বুঝেছি। তুমি চাইলে আমিও যেতে পারি সঙ্গে। এই শহরটা তোমার চেয়ে ভালো চিনিতো তাই। ’
‘ওকে। ’ আমি খুশি হয়ে যাই। সাহস পাই। মামাকে বলতে হবে যে বুনো যাবে। মামা রাজিই হবেন। বুনোকে তিনি পছন্দ করেন। যদিও আকাশ মামার ঘটনার পর তিনি এখন কাউকে বিশ্বাস করতে চান না।  
ছাদে থাকার কারণে আকাশের অনেক কাছাকাছি রয়েছি বলে মনে হয়। একটা প্লেন উড়ে যায়। মনে হয়, খুব কাছ দিয়েই উড়ে গেলো। প্লেনের ইঞ্জিনের আওয়াজে কানে তালা লাগার জোগাড়। এই আওয়াজে বুনো বিরক্ত হয়ে বলে, ‘এজন্যেই আমার শহর পছন্দ হয় না। একা থাকতে দেয় না। কোথাও না কোথাও, কেউ না কেউ ঠিক যেনো হাজির। ’
আমার মন্দ লাগে না। প্লেনের মতো যন্ত্রদানব চলে যাওয়ার ঠিক পর পরই পাই পাখির আওয়াজ। ঘুলঘুলিতে বাসা বেঁধেছে হয়তো। পেতেছে ছোট্ট সংসার। পাখির জীবন চেয়েছিলাম সবসময়। পাইনি।
গায়ে রোদ এসে পড়ে। কি বাধ্য! মিষ্টি হয়ে ছড়িয়ে যায়। পোষা রোদ যেনো। কথা শোনে। শরীরে আরাম লাগে। হলুদ রোদ। রোদের পাগলামি আর ছায়ার সঙ্গে খুনসুঁটি দেখি। দেখি কাকগুলোর তারের শরীরে ঠাঁই নিয়ে একটু জিরিয়ে নেওয়া।  
‘রুবির সঙ্গে জমে গেছে বুঝেছো। মেয়েটা কী সুন্দর। কিউট। ’ বলে বুনো।
‘আমার তো মনে হয় না। ’ হেসে বলি আমি।
‘ও, বোনের সঙ্গে খুব দুষ্টুমি বুঝি?’
‘একটু একটু। আমি শান্ত ছেলে। সব ঝামেলা ওই করে। ’ 
‘মোটেও না। তোমাকে দেখে মনে হয় না তুমি একদম শান্ত। ছুপা রুস্তম। তুমি খারাপই আছো। কিন্তু বোঝা যায় না। ’
‘বাজে কথা। ’
‘একদম না। ’
আমাদের এই তর্ক, কথা বলা খুব ভালো লাগে। কেন জানি না বুনোর এই সান্নিধ্য, কাছে থাকাটা শেষ না হোক এটাই চাচ্ছি মনে মনে।
‘আমার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে বের হতে হবে। অফ ডে-তে মাস্ট। এছাড়া তো সময় দিতে পারি না ওকে। বের হবো। ওকে? থাকো। ’ বলেই ছাদ থেকে চলে যাওয়া শুরু করে বুনো।
আমি কিছু বলতে পারি না। কেন জানি দমে যাই। বুনোর কেউ থাকলে আমার তো দমে যাবার কথা না।  
বুনো যেতে যেতে হুট করে আবার ফিরে আসে। আমার কাছে এসে দাঁড়ায়। খুব কাছে। এতোই কাছে যে আমি তার নিঃশ্বাস টের পাই। তার শরীরের ঘ্রাণ পাই। তার অগোছালো চুল এসে আমার মুখ জাপটে ধরতে চায়।
তারপর অদ্ভুত এক অনুভূতি। ঠিক কয়েক সেকেন্ড। পৃথিবী অন্যরকম হয়। স্বর্গ হয়। ফাগুন হয়।
এরপরই চলে যায় বুনো। দৌড়ে। লজ্জা পেয়ে। তাড়াহুড়ো করে।
আমি কয়েক সেকেন্ডের ঘোর থেকে ফিরতে পারি না। কী হলো এটা? এমন তো কথা ছিলো না। বুনোর মাথা ঠিক আছে তো?
এমন আমার সঙ্গে কখনও হয়নি। এমন সুন্দর কিছু। এমন ভালো লাগার।  
সরি, হয়েছিলো। মাহবুবার সঙ্গে। একদিন।  
ভুলে যেতে চাই।
সেই দিনটার কথা খুব করে ভুলে যেতে চাই।  
চলবে…

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৯ ঘণ্টা, মে ১৫, ২০১৬
এসএনএস

আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন-
**মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্‌সান (পর্ব- ১)
** মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্‌সান (পর্ব- ২)
** মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্‌সান (পর্ব- ৩)
** মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্‌সান (পর্ব- ৪)

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।