ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপন্যাস

ধারাবাহিক উপন্যাস

মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্‌সান (পর্ব- ৬)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০২ ঘণ্টা, মে ২১, ২০১৬
মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্‌সান (পর্ব- ৬)

৬.

আলোতে যেই খবর,
অন্ধকারে সেই কবর।

গোলাগুলিতে মারা গেছে একজন কিছুদিন আগেই।


গোলাগুলি আমাদের শহরেও হয়। ছাত্র রাজনীতি। এটা ওটা ঝামেলা। গুলি সহজলভ্য মনে হয়। কিছু একটা হলেই ঠুসঠাস, ফুসফাস। ক্লাস বন্ধ। আমরা সবাই ক্লাস ছেড়ে বাইরে। তারপর বন্ধুরা একসঙ্গে মিলে টাকা তুলে কলিজা সিঙাড়া খাওয়া আর সঙ্গে নিজাম চাচার চা।  
ক্লাস বন্ধ হলেও কোচিং চলবেই। এতে কোনো মাফ নেই। না গেলে খারাপ ব্যবহার, নম্বর এদিক-ওদিক। তাই সবাই মিলে এই স্যার ওই স্যারের কাছে ছোটা হয়। মাসে আটশো টাকা বেতন। এক এক ব্যাচে চল্লিশ-পঞ্চাশ জন ছাত্র-ছাত্রী। এখানেই প্রেম-ভালোবাসা। পড়তে পড়তে ভালোলাগা। নোট নিতে নিতে চোরা চাহনি। বিরক্ত করা। চিঠি দেওয়া, ফোন নম্বর। কখনও ‘না’ শোনা। অভিমান। বেশি হলে চড়-থাপ্পড়। রোজকার গল্প সবার।  
কোনো কোনোদিন ফুটবল খেলার টুনার্মেন্ট। মাঠের চারপাশে শ’খানেক মানুষের ভিড়। বাদাম আর ভেলপুরিওয়ালার রমরমা ব্যবসা। বিটলবণ কম হলো কেন? পুরিতে টক তেতুল দেওয়া হলো না কেন? এই নিয়ে ঠোকাঠুকি। আবার একেক দিন ঘুড়ির লড়াই। আমাদের ফরিদ মাঞ্জা দেওয়ায় সেরা। কাঁচের গুড়ো, কবুতরের পায়খানা, আলতাসহ আরও কী সব দিয়ে সুতো ধারালো করে সে। কঠিন মাঞ্জা। অন্যকোনো ঘুড়ির সুতো কাছে এসে টাচ করলেই ঘ্যাচ করে কাটা পড়বে।  
থমকানো শহর, কাজের চাপ নেই, কোথাও পৌঁছানোর তাড়া নেই- এমন জায়গাটার জন্য মন কাঁদে। কবে যাবো?
বুনোর সঙ্গে তার ছেলেবন্ধুও রয়েছে। আমরা এসেছি হুন্ডির টাকা তোলার জন্য এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলতে। কলকাতার অনেক ক্ষমতাবান লোক, ধনী। দু’টো মার্কেট তার। সিনেমা হলও রয়েছে। একসময় প্রতাপশালী গুন্ডা ছিলো। বুনোর ছেলেবন্ধুর পরিচিত। তার কাছে শুনে বুনো আমাদের জোরাজুরি করে নিয়ে এসেছে।
ছেলেটার নাম রজত। চেহারা সুবিধার না। টাউট-বাটপার ছাপ আছে। এটা আমার কথা না, মামা বলেছে। মামা ছেলেটাকে একদমই পছন্দ করতে পারছে না। বলছে, ‘বুনো মেয়েটার জন্য আফসোস হচ্ছে রে। কী সুন্দর পুতুলের মতো মেয়ে। সুন্দর মেয়েদের মাথা খারাপ হয় মনে হয়। না হলে এমন ছ্যাচড়া টাইপের ছেলের সঙ্গে প্রেম করে কেউ? এই রিলেশন টিকবে না। বলে রাখলাম, দেখিস’।  
সবসময়ের মতোই মামার কথার জবাবে কিছু বলিনি আমি। তাছাড়া বুনোকে নিয়ে ভাবছি। তার আচরণে অবাক হয়ে আছি। ছাদের ঘটনাটা বেমালুম ভুলে গিয়েছে সে। ছেলেবন্ধুর গায়ের সঙ্গে লেপ্টে রয়েছে। ভালোবাসাবাসি চলছে।
আমার কী করা উচিত? কিছু করা উচিত না। মায়ের চিকিৎসা করতে আসা ছেলের প্রেম-ভালোবাসা মানায় না। আর বুনোকে আমি ভালোবাসি কিনা এটা নিয়ে নিজেই বিভ্রান্ত। ভালোলাগা হতে পারে বড়জোর। এইতো।  

বুনোকে চাইতে পারি না। আরেকজনের প্রতি অবিচার করা হবে। সেটা অপরাধ হবে। কঠিন অপরাধ। এমনিতেই এক অপরাধ থেকে লুকাতে চাচ্ছি। পালিয়ে বেড়াচ্ছি। পারছি না। সেখানে অন্যকিছু নতুন করে ঠিক নয়। একদম ঠিক নয়।
‘মুভি দেখি চলো। সন্দীপ মুখার্জি বড় মানুষ। টাইম দিয়েছে ঠিকই কিন্তু দেখা করতে ঢের দেরি হবে মনে হয়। প্রায় ঘণ্টা দুই। ’ বুনোকে কথাগুলো বলে রজত।  
‘মুভি? শিওর!’ বলে বুনো। আমি, মামা আর রুবি ওদের কথা শুনি।
‘হুম। খাওয়ার জন্য কোথাও বসা যায় অবশ্য। কিন্তু তোমার বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় তো গলা অব্দি খেয়েছি। খিদে নেই। মুভি দেখলেই সময়টা কাটবে। ’ বলে রজত।
এই কথা বলার সময় মামাকে দেখি মুচকি হাসতে। পাতলা ডাল আর বেগুনভাজা খেয়ে এই ছেলে বলছে, গলা অব্দি খেয়েছে। এটাই যে হাসার কারণ বুঝতে সমস্যা হয় না। বুনোর বাসায় খাবার বলতে এইই।  
‘চলো তাহলে। ’ কথাটা বলে বুনো আর রজত সিনেমার টিকেট কাটতে যায়। আমাদের কিছু জিজ্ঞেস করে না। সিনেমা দেখবো কী দেখবো না জানতে চায় না। নিজেরাই কথা বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়।  
মামার কুঁচকানো ভ্রু দেখে মনে হয় বিরক্তি বেড়েছে তার। বাড়াটাই স্বাভাবিক।  
টিকেটের জন্য লম্বা লাইন। এ শহরের মানুষ সিনেমার জন্য পাগল।  
আমার লাইনে দাঁড়ানোর অভ্যেস আছে। সংসারের কাজ বলতে ব্যাংকে লাইনে দাঁড়ানো পর্যন্তই। ফিক্সড ডিপোজিটের টাকা তোলার জন্য বহুবার ব্যাংকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। মনে হয়, মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশ বেঁচে রয়েছে সঞ্চয়পত্রের কারণে। মাস শেষে অতিরিক্ত এই কয়টা টাকা সাহায্য করে খুব।
টিকেট পাওয়া যায়। প্রায় বিশ মিনিট। নিজেরাই কষ্ট করে লাইনে দাঁড়িয়ে সবার জন্য টিকেট আনে রজত আর বুনো। ইংরেজি ছবি একটা। আমরা হলে ঢুকি। সঙ্গে নেওয়া হয় পপকর্ন আর কোক। রুবি এই প্রথম হলে ঢুকছে ছবি দেখতে। খুশিতে লাফাচ্ছে সে।
এক ঘণ্টা পয়ত্রিশ মিনিটের যে ছবি দেখে আমরা বের হই তার কথা না বলাই ভালো।  
মামার চেহারা, কান, নাক- লজ্জায় লাল। রুবি কিছুই বুঝতে পারছে না। তার চোখ বেশিরভাগ সময়ই আমি ঢেকে রেখেছিলাম। শব্দ তো ঢাকা যায় না। রুবি সেটা নিয়েই বিভ্রান্ত হয়ে আছে। আমার মেজাজ খারাপ। বুনো কী আক্কেলে এমন বাজে ছবি দেখালো বুঝলাম না। ছবি জুড়ে নর-নারীর যেসব নির্লজ্জ কাণ্ড হয়েছে সেসব নিয়ে ভেবে গা রি রি করছে। বলার মতো না। একা দেখলেও না হয় হতো...ছি!


দেখা হয় সন্দীপ মুখার্জির সঙ্গে। বড্ড ভালো ব্যবহার করেন। ক্ষমতাবান লোক দেখেই বোঝা যায়। তিনি হুন্ডির ব্যাপারে সব শোনেন। তারপর বলেন, ‘দেখি কী করা যায়। ঝামেলায় জড়িয়ে গেছেন আপনারা। গোলাগুলিতে কিছুদিন আগেই ওখানে মারা গেছে একজন। রওনা দিয়ে দ্যান এখনই। গাড়ি দিয়ে দিচ্ছি’।  
এইটুকু কথা বলেই লোকটা চলে যায়। চা-বিস্কুট খেয়ে যেতে বলে। আমরা খেয়ে রওনা দেই। একটা জিপ। সন্দীপ মুখার্জির লোকই আমাদের নিয়ে যায় গন্তব্যে। ঘিঞ্জি জায়গা। চিপা গলি। একটা জায়গার পর আর গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায় না। দেখেই মনে হয়, চারপাশের মানুষগুলো ভয়ঙ্কর। কোনো না কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত। হেঁটেই রওনা দেই।  

ময়লা, আবর্জনা ডিঙিয়ে, মানুষের ভিড় পাশ কাটিয়ে একটা ভাঙাচোরা দোতলা বাড়িতে যাই। সন্দীপ মুখার্জির লোক পথ দেখায়। বলে, এটা কলকাতার সবচেয়ে জমজমাট এবং বড় জায়গা যেখানে প্রতিদিন কোটি রুপির ওপরে হুন্ডির লেনদেন হয়। পরিচয় করায় ছাব্বিশ কী সাতাশ বছরের একটা ছেলের সঙ্গে। এখানকার প্রধান। আগে বাবা ব্যবসা দেখতো। অসুস্থ হওয়ায় ছেলে দেখছে সব।  
কী আত্মবিশ্বাসী! হাতে সোনার রোলেক্স। আয়রন করা দামী শার্ট। ঘরের ভেতরেও সানগ্লাস পরে রয়েছে। মাঝ আঙুলে আংটি। আচার-আচরণ, ভাবে নিজের ক্ষমতার জানান দিচ্ছে প্রতিমুহূর্তে। এতো কিছুর ভেতর সবার আগে চোখে পড়ে তার পাশে টেবিলের ওপর রাখা রিভলবারটা। ভয় হয়। সঙ্গে রুবিও রয়েছে।  
কোথায় টাকা পাঠালো বাবা! বারবার ভুল করা কেন? সন্দীপ মুখার্জি সুবিধার লোক না। এখন মনে হচ্ছে, বুনোর ছেলে বন্ধুর কথা শুনে তার কাছে যাওয়াটাই ভুল হয়েছে।     
পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পরও ছেলেটা আমাদের সঙ্গে কথা বলে না। চোখের ইশারায় এক লোককে আমাদের অন্য কোনো জায়গায় নিয়ে যেতে বলে। ছোট ক্লায়েন্ট বলেই হয়তো তার এমন অবহেলা। আমাদের সামনেই লাখ লাখ টাকার লেনদেন হচ্ছে। রুপি আর টাকার বান্ডিল। সবাই গোনায় আর ব্যাগে ভরতে ব্যস্ত।  
‘ইধার আইয়ে। ইধার। ’ বসের কথা অনুযায়ী এক লোক আমাদের ছোট্ট একটা ঘরে নিয়ে যায়। মামা আর সন্দীপ মুখার্জির লোকটাকে আলাদা করে ঘরের এক কোণায় নিয়ে ফিসফিস করে কথা বলে। মামা পকেট থেকে একটা নোট বের করে। নোটের গায়ের কোনো একটা নম্বরের সঙ্গে এই লোক তার পকেট থেকে বের করা নোটের নম্বর মেলায়। আমি এইসবের কিছুই বুঝি না। সব ঠিকঠাক বুঝে মামার হাতে টাকা তুলে দেয় লোকটা। বলে, ‘গিনকে লিজিয়ে’।  মামা গুনতে বসে যায়।  
ঠিক এমন সময় সিনেমার মতো ঘটে। হইচই। পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া লোকের মুখে কথা শুনে বুঝি পুলিশের ঝামেলা। বখরা নিয়ে সমস্যা কোনো। ধরে নিয়ে যাবে। থানায় জায়গা হবে সবার। বস ছেলেটাকে দেখি পুলিশের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়তে। হাতে রিভলবার। সাহস বটে!
লোকজন সুযোগ বুঝে এদিক-ওদিক পালায়। পালায় সন্দীপ মুখার্জির লোকটা। রজতকেও দৌড়ে বের হয়ে যেতে দেখি। মামা হতভম্বের মতো বসে পড়ে, হাতে টাকা। গোনাও শেষ হয়নি। রুবি শুরু করে ভ্যা করে কান্না। বুনো তার ভয় ভাঙাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।  
আর আমি? নিজের ভাগ্যের কথা ভেবে মনে মনে হাসি। জেলে যেতে হবে নাকি গুলিতে মারা পড়বো এসব নিয়ে ভাবনা নেই। ভয়ও নেই। ভাবছি ভাগ্য কতোটা বিরূপ হলে এভাবে হাতে টাকা এসেও বারবার হাতছাড়া হয়ে যায়। এ তো আমার মায়ের চিকিৎসার জন্য আনা টাকা। খারাপ কিছু তো নয়। কার অভিশাপ?
হাতাহাতি শুরু হয়েছে মনে হয়। লাঠি দিয়ে মানুষ পেটানোর আওয়াজ পাই। মানুষের কান্না, চিৎকার। কেউ একজন চিৎকার করে বলছে, ‘তালতলা থানায় ভরবো সব। সবগুলোকে...শালা বাইন...’।  
পালানো উচিত। রুবি আছো তো সাথে। পালানো উচিত।
মামা, আমি, বুনো, রুবি পালানোর পথ খুঁজি। দৌড়াই।  
ছুটতে ছুটতে বের হতে গিয়ে চোখে পড়ে আকাশ মামাকে। আচমকা। এক পলকের জন্য।
আমি দৌড় থামিয়ে চিৎকার করে বলি, ‘বড় মামা, ওই লোকটা আকাশ মামা। বেঈমান’।
ঝামেলা, হুড়োহুড়ির ভেতর মামার কিছু শোনে না। আমার হাত ধরে টান দেয়।  
বলে, ‘দৌড়া। দৌড়া’।
আমি দাঁড়িয়ে থাকি। আমার আকাশ মামাকে ধরা দরকার। আমার মায়ের চিকিৎসার টাকাগুলো উদ্ধার করা দরকার।
লোকটাকে জিজ্ঞেস করা দরকার, ‘কেন করলেন? মানুষ তো এখনও এতো খারাপ হয়নি। তাই না’?
ধরার জন্য দৌড় দেই।
চলবে…

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫১ ঘণ্টা, মে ২১, ২০১৬
এসএনএস​

আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন-
**মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্‌সান (পর্ব- ১)
** মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্‌সান (পর্ব- ২)
** মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্‌সান (পর্ব- ৩)
** মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্‌সান (পর্ব- ৪)
** মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্‌সান (পর্ব- ৫)


 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।