টিকে থাকে শুধু নারী এবং গল্প, যদ্দূর আমি জানি। (ভার্জিনিয়া উলফ)
ফাতেমা হারিয়ে যায়; একদিন হঠাৎ চলতি সংসার ও বসত ভিটে থেকে আকালুর বউ ফাতেমা হারিয়ে গেলে দেখতে পাই আকালুকে, সুহাসিনী গ্রামে সে ফিরে আসছে- দূর থেকে যাকে মনে হয় একটা ধলা বক; লোকটাকে ফিরতে দেখা যায় ফাতেমার বাপের অর্থাৎ নিজের শশুর বাড়ি থেকে, ফাতেমা যে হারিয়ে গিয়েছে: নারীটি নিজের বাপের বাড়ি যায়নি, সুহাসিনীর কোথাও নেই, তাহলে কি সে ম্যাজিকের মতো উধাও হলো? এই ধরনের প্রশ্নের মুখে পড়ে গল্পটিতে প্রবেশ করি যখন জননীকে হারিয়ে পুত্র আমির হোসেন ও কন্যা বকুল কেঁদে চলে অবিরাম।
আকালু ভূমিহীন, নিতান্ত গরিব কৃষক এই হেতু পুলিশের কাছে গেলে তারা মিসিং কেস নিতে চায় না; গ্রামবাসীরা ভেবে নিতে চেষ্টা করে স্ত্রীর এ অকস্মাৎ অন্তর্ধানে হয়তো স্বয়ং আকালুর ভূমিকা থাকতে পারে। গল্পটি স্বভাবতই এরপর ফ্ল্যাশব্যাকে যায়, নাহলে চরিত্রগুলোর অতীত জানতে পারতাম না আমি, এজন্যই ফ্ল্যাশব্যাক আসে; যেহেতু মানব চরিত্রের অতীত রহস্যময়, একইরূপে আজকের দিনটা ভবিষ্যতের রহস্য।
‘আমাদের বকুল’ আসলে এক ধরণের চক্র- পড়তে পড়তে অনুমান করি গল্পটি১ এক গোলকধাঁধা, যেখান থেকে শুরু করেছি ঘুরে-ফিরে সেই বিন্দুতে এসে দাঁড়াবার সম্ভাবনাই বাড়তে থাকে; এইসব ভেবে নিয়েও কাহিনি এগোয়, ফাতেমাকে খুঁজে না পাওয়ার যাতনা গোটা সুহাসিনী গ্রামের লোকজন অনুভব করে, আকালুর জন্য আমার মায়া না লাগলেও গ্রামবাসীর জন্য করুণা জাগে, যেহেতু দেখা যায় তারা আফসোস করছে- আফসোসটি আধা যৌনতা, আধা অলৌকিকতার মিশ্রণে আমার মনেও ধাক্কা মারে। এইযে একটা পারিবারিক দুর্ঘটনায় গ্রামবাসীর সাথে আকালুর কথাবার্তা, সম্ভবত এই অজো গাঁয়ের সমাজ থেকে শুরু করে নাগরিক যাপনেও তা সমগ্র বাঙালির মনস্তত্ত্ব তুলে ধরে, এখানে তার গল্পের আলাপে শহিদুল জহির সম্পর্কে আমার অবজার্ভেশন শুরু হয়- তিনি সুহাসিনীকে যে একটা মেটাফোর করে তার সমগ্র জনপদের গল্প বরেছেন, বুঝে উঠতে পারি। বরং কিছু অংশ নিচে কোট করা যেতে পারে পাঠকের সুবিধায়:
এক দুপুরে আকালু ক্ষেতে কাজ করছে, সূর্য মাথার উপরে উঠলে সবার বাসা থেকে খাবার আসে শুধু আকালুর আসে না, তখন সহ-কৃষকদের সাথে তার এইসব বাতচিত হয়-
“--ক্যারে আকালু, দুপুরে খালি তামাক খায়া থাকপি?
--তোমাগোরে এত কথা দিয়া কাম কী? আমি তামুক খায়া থাকি, গু খায়া থাকি, তোমাগোরে কী?
--তর বাড়িত কি রান্দাবাড়া বন্দ? তর ছাওয়াল পাওয়াল কী খায়? বকুল রাইনব্যার পারে?
--পান্তা আছে খাইবোনি, আমি সন্দায় যায়া রানমু। ”
এই সংলাপের পরে কিন্তু দেখা যায় আকালু ক্ষেতের কৃষকদের খাবারে সানন্দে ভাগ বসাচ্ছে, দিনমান কাজ করছে এবং সন্ধ্যা মিলাবার পর সহ-কৃষকেরা আবার তাকে বলছে- “--ক্যারে আকালু, তামুক খাবিনা! তামুক খায়া বাড়িত যা, বউ না থাইকলে কেমন নাগে বোঝ গা!
আকালু জবাব দেয়- তোমরা তো কও আমি বউ মাইরা ফালাইছি!”
ফ্ল্যাশব্যাকের কথা বলছিলাম, সেখানে ফিরে যাই। যখন আকালু সদ্য ফাতেমাকে বিয়ে করে সুহাসিনীতে এনেছে। বিয়েতে বউয়ের সাথে আকালু একটা গাই গরুও পায়, যে গরু আর বউকে নিয়ে গ্রামবাসীর ফ্যান্টাসি সার্বজনীন। ফাতেমাকে তারা উঠোনে কাজ করতে দেখে, দেখে এই ভিন গাঁইয়া নারীর ভরাট স্তন, বিস্তৃত নিতম্ব এবং মোটা পায়ের গোছা (জহিরের এই শব্দচয়নগুলো খেয়াল করা জরুরি), তারা ফোড়ন কাটে- “ক্যারে আকালু, এমন বউ বিয়্যা করলি, এমন ধামার নাহাল তর বউয়ের শরীল!”
বস্তুত এই ‘ধামার নাহাল’ দেহের ফাতেমা আর গাই গরু, দু’টোই গ্রামজুড়ে রহস্য তৈরি করে যেহেতু বছর পার হলেও কেউ পোয়াতি হয়ে ওঠে না। এবং গ্রামবাসী ও কৃষকদের চোখে এ দু’টি প্রাণি একই মহিমায় ধরা দেয়- যখন তারা কৌতুকের স্বরে বলে, “বিয়া কইরা এমন একখান বউ আনলি, বিয়া কইরা এমন একখান গরু আনলি, দুইটাই এক রকম.. তর গাইয়ের দিকে তাকাইলে শালার কাপড় খারাপ হয়া যায়”।
টানা গল্পটি বর্তমান থেকে মুহূর্মুহু আমাদের অতীতে নিয়ে যায়, খানিকপরেই আছড়ে ফেলে বর্তমানে, গল্পের বুননে মুগ্ধতা জাগাটা স্বাভাবিক। এবং কাহিনি কিন্তু সমান্তরাল না, অনেকগুলো খণ্ডখণ্ড অতীত এসে জুটেছে এর শরীরে, সেই সাথে বিচিত্র চরিত্রগুলো, বিচিত্র এই কারণে যে তারা সবাই সমানহারে নিরাবেগ আর গহন কৌতুকপূর্ণ।
আকালুর বউ ফাতেমা আসলেই হারিয়ে যায় কিনা, এটি যেমন গল্পের অনুসন্ধানবিন্দু, একইভাবে নারীটি কোন কারণে হারিয়ে গেলো তার খোঁজে অতীতে ডুব দেওয়াটাও এর সাথে যুক্ত; দেখা যায় মিয়া বাড়ির আশ্রিত তালেবুল এলেম রফিকুল ইসলামের কাছে বকুল আর আমিরকে পড়তে পাঠায় ফাতেমা, তাকে বাসায় ডেকে পিঠা বানিয়ে খাওয়ায়- এইসব থেকে জহির আমাদের অনুমানের ইঙ্গিত দেন, বৈবাহিক জীবনে এই নারীর একাকিত্ব থাকতে পারে। যদিও রফিকুল ইসলামকে মোটেই আকালুর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখতে পাই না, বরং ফাতেমাকে কখনও মনে হয় আকালুর প্রেমিকা।
নানা দৃষ্টিকোণ থেকে একটা শিল্পকর্মের পাঠ চলতে পারে, যদিও কোনো সাধারণ পাঠক গল্পের বই নিয়ে বসলে কেবল গল্প শোনাটাই তার কাছে মুখ্যবস্তু হয়ে ওঠে- এ গল্পটি সেদিক থেকে কাহিনিই বলে যায়, টানা, নিরাসক্ত এক ভঙ্গিমায়: যেখানে মুখ্য চরিত্রেরা ঘুরে বেড়ায় উদ্দেশ্যহীন, নিয়তি তাদের নিয়ে খেলতে থাকে (কিন্তু কখনও কখনও মনে হয়েছে, জহিরের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে তার চরিত্রগুলোর উপর?), কেউ আলাদা আকার নিয়ে দাঁড়ায় না, সবাই মিলে হয়ে ওঠে একজন, আবার খটকা লাগে- প্রতিটি চরিত্রইতো আসলে আলাদা গল্পবাহক, একে অন্যের থেকে ভয়ানক বিচ্ছিন্ন। তাদের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে খুব বিষদ প্রবন্ধ লেখা চলতে পারে, ওসবের সাথে চলে আসতে পারে এদের সূত্রধর হিসেবে জহিরের উদ্দেশ্য ও বিধেয়- কিন্তু সেরূপ বিশ্লেষণের ভার গবেষকদের উপর ছেড়ে দেওয়াই শোভন।
গল্পটির নাম ‘আমাদের বকুল’ কেন, এর সমাধান কিন্তু বালিকা থেকে কিশোরী হয়ে উঠতে থাকা বকুল দেয় না, দেয় একটি কলাগাছ- যাতে পানি ঢালা লাগে না, এমনিই বেঁচে থাকে এ পরাবাস্তব বৃক্ষ। ঠিক মানব জীবনে স্ব-ফলন্ত বৃক্ষ হলো আশাবৃক্ষ, মানুষের বুকে এটি বেঁচে থাকার তাগিদ হিসেবে কাজ করতে থাকে- এবং সে বৃক্ষে আঘাত এলেই সুহাসিনী গ্রামের ভূমিহীন কৃষক আকালু আর তার হারিয়ে যাওয়া বউ ফাতেমার কন্যা ‘বকুল’ হয়ে ওঠে আমাদের বকুল।
১। ‘আমাদেরবকুল’ গল্পটি শহিদুল জহির (১১ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৩ – ২৩ মার্চ, ২০০৮) লেখেন ২০০০ সনে, যা তার তৃতীয় গল্পের বই- ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্পে (২০০৪) গ্রন্থভুক্ত হয়। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে অনেকে তাকে পোস্ট-মর্ডানিস্ট বলছেন, যদিও এ ধরনের শব্দবন্ধে আমার আপত্তি আছে- আপত্তির আখ্যান অন্য কোথাও বিস্তারিত লেখা যাবে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৪৩ ঘণ্টা, জুন ৩০, ২০১৬
এসএনএস