সমাজকর্মীদের মধ্যে লেখক, লেখকদের মধ্যে সমাজকর্মী
যশোধরা রায়চৌধুরী
“দাগেস্তানের কবি রসুল গামজাতোভ নিজের প্রসঙ্গে এক জায়গায় বলেছিলেন– I am the poet among the politicians and polifician among the poets. . কথাটা মহাশ্বেতা দেবীর ক্ষেত্রেও আমার সমান সত্য মনে হয়। তার সম্বন্ধেও বলা যেতে পারে তিনি সমাজকর্মীদের মধ্যে একজন লেখক এবং লেখকদের মধ্যে একজন সমাজকর্মী।
মনে পড়ে আমাদের বাড়িতে পুরনো বইয়ের স্তূপে দেখেছিলাম, মহাশ্বেতা ভট্টাচার্যের লেখা একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। সুপ্রাচীন সেই বইটি বিজন ভট্টাচার্য-পত্নী মহাশ্বেতার লেখা। যাত্রাপথের শুরুর সেই ব্যক্তিত্ব বদলে গেছিল সমাজকর্মী মহাশ্বেতা দেবী-তে, অচিরেই। সাক্ষ্য রেখেছে ইতিহাস। যে জীবিত ইতিহাস একজন মহিলা লেখককে দেখেছে প্রায় আইকনের মত করে। অথচ ৯১ বছরের মানুষটি আজো ক্রিয়াশীল, উন্মুখ, তাঁর প্রতিবাদ অথবা আবেগকে পৌঁছে দিতে মানুষের কাছে।
এক সাক্ষাৎকারগ্রহীতা লক্ষ্য করেছেন, ইদানীং মহাশ্বেতা দেবী বিশুদ্ধ শিল্প সৃষ্টি থেকে যেন বেশি উদ্দীপনা বোধ করেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অংশ নিতে। মনীশ ঘটকের কন্যা তিনি। কল্লোল যুগের এই কবির সঙ্গে জড়িয়ে আছে যে গল্পকথা, তাও মহাশ্বেতা সন্দেশ পত্রিকার পাতায় অসামান্য সব ছোটগল্পে বিবৃত করেছেন। ‘ন্যাদোশ’ এর মত অদ্ভুত বই-টি একেবারেই “ওয়ান –ইন –ইটস –ক্লাস” বললেও কম বলা হত। কিন্তু বাঙালি আলোকবান মধ্যবিত্ত ইনটেলেকচুয়াল পরিবারের শৈশবের সব চিহ্নও যেন ঝেড়ে ফেলে দিতে সক্ষম হয়েছেন পরবর্তীর মহাশ্বেতা দেবী।
থেকে গেছে এর পর পাতার পর পাতা লেখা। হাজার চুরাশির মা অথবা অরণ্যের অধিকারের মত উপন্যাসের লেখকের পাশাপাশি একজন গল্পলেখকের ‘দ্রৌপদী’, “চোলি কে পিছে” বা ‘ভাত’ এর মত গল্প ছুঁড়ে দিয়েছেন আমাদের দিকে, বিস্ফোরকের মত। যাঁর প্রতিটি লেখাই , আজো সারা ভারতের লড়াকু মানুষকে উদ্দীপনা দেয়।
মণিপুর কলাক্ষেত্রের সাবিত্রী হেইসনাম মহাশ্বেতা দেবীর আদিবাসী মেয়ে ‘দ্রৌপদী’ কে মঞ্চে দেখিয়েছিলেন। যে দ্রৌপদী রাষ্ট্রের প্রতিভূ সেনানায়ককে আজো প্রশ্ন করছে, ‘কাপড় কী হবে, কাপড়? লেংটা করতে পারিস, কাপড় পরাবি কেমন করে? মরদ তু?... হেথা কেও পুরুষ নাই যে লাজ করব। কাপড় মোরে পরাতে দিব না। আর কী করবি?’ পরনের কাপড় খুলে ফেলে সেনানায়কের সামনে নগ্ন হয়ে দাঁড়ায় দোপদি মেঝেন, আর নিজের শরীর-অপমানবোধকে, নগ্নতাকে নারীত্বের পরাজয়ের দিকে না ঠেলে দিয়ে, এক চূড়ান্ত প্রতিরোধের তাচ্ছিল্যে ঘুরিয়ে দিতে পারে তার প্রতিবাদের ভাষাকে। মহাশ্বেতা কান্নাকাটির , হা হুতাশের লেখক কোনদিন নন। সত্যিই তো, এ লেখার বহু দিন পরেই ঘটেছে মণিপুরের রমণীদের নগ্ন হয়ে প্রতিবাদের ঘটনা। আর সে প্রতিবাদের পরে রূপকের মত সাবিত্রী হেইসনেমের অভিনয়ে আবার জেগে উঠেছে দ্রৌপদী, মঞ্চে। আর, আজো ঘটছে সেনাবাহিনীর হাতে প্রতিদিন আদিবাসী নারীর লাঞ্ছনা, ছত্তিসগঢ়ে অথবা মধ্যপ্রদেশে।
ভাত গল্পের “উচ্ছব ... খাবল খাবল ভাত খায়। ভাতে হাত ঢুকিয়ে দিতে সে স্বর্গসুখ পায় ভাতের স্পর্শে। চন্নুনির মা কখনো তাকে এমন সুখ দিতে পারেনি। খেতে খেতে তার যে কী হয়। মুখ ডুবিয়ে দিয়ে খায়। ভাত, শুধু ভাত। বাদার ভাত। বাদার ভাত খেলে তবে তো সে আসল বাদাটার খোঁজ পেয়ে যাবে একদিন। আছে, আরেকটা বাদা আছে। সে বাদাটার খোঁজ নির্ঘাৎ পাবে উচ্ছব। আরো ভাত খেয়ে নি। চন্নুনিরে! তুইও খা, চন্নুনির মা খাও, ছোট খোকা খা, আমার মধ্যে বসে তোরাও খা! আঃ! এবার জল খাই, জল! তারপর আরো ভাত। ভোরের টেনে চেইপে বসে সোজা ক্যানিং যাচ্চি। ভাত পেটে পড়েচে এখন ঝানচি ঝে ক্যানিং হয়ে দেশঘরে ঝেতে হবে।
উচ্ছব হাঁড়িটি জাপটে, কানায় মাথা ছুঁইয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। “
মনে পড়ে শবরদের সঙ্গে মহাশ্বেতার শালপাতায় ভাত ইঁদুরের মাংস খাবার কাহিনিকথা। মিথ।
মহাশ্বেতা দেবীকে কোন পুরস্কার কখনো পুরোটা ধরতে পারবেনা। ম্যাগসেসে , জ্ঞানপীঠ, পদ্মশ্রী, পদ্মবিভূষণ...বঙ্গবিভূষণ, সাহিত্যব্রহ্মা... সব বড় পুরস্কার পাবার পরেও তিনি পুরস্কারের চেয়ে বড় থেকে যাবেন। এই অখন্ড চরিতার্থতার ইতিহাস রচনা করবেন গবেষকরা। ইতিমধ্যেই করেছেন। সে বিষয়ে আমাদের কোন সংশয় নেই। সে চেষ্টা আমার নয়, শুধু আমি বলতে চাইছি, একজন মানুষের এই দীর্ঘ সৃষ্টিশীলতা এবং কাজের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বগুলি ধরার চেষ্টা প্রায় গত ষাট সত্তর বছরের বাঙালির ইতিহাসই ধরার চেষ্টা হয়ে উঠবে না কি? নিশ্চিতভাবেই উঠবে। কেননা অনেক পথ পার হয়েও, দেখি সেই মহাশ্বেতাকে, যিনি অশীতিপর হয়েও এগিয়ে এসেছিলেন সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়ে, নানা বয়সী প্রতিবাদীদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। সেজ (sez) নিয়ে লেখা বই অনুবাদ করে প্রচার করতে চান। দেখি সেই মহাশ্বেতাকে, যিনি শান্তিনিকেতনের খোয়াই ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ঘটনাকে বন্ধ করতে উদ্যোগী হন, যখন বুধসমাজ মুখ ফিরিয়ে থাকেন।
দেখি সেই মহাশ্বেতাকে, যিনি পাশের ঘরের একটি ছোট শিশুর জন্য উদ্বেল হন। সে শিশুকে কাজের লোক খ্যাপাচ্ছে, তার বুদ্ধি চুরি করে নিয়েছে বলে। সে বিচলিত হয়ে কাঁদছে “আমার বুদ্ধি ফেরত দাও” বলে। মহাশ্বেতা পাশের ঘরে বসে, বলছেন, ‘ওর বুদ্ধি ওকে ফিরিয়ে দিলেই হয়, কাঁদাচ্ছ কেন?’
দেখতে চাই সেই মহাশ্বেতাকেও, যিনি, পাড়ার সবার পরিচিত। ইস্ত্রি করার লোক, উনুনে কয়লা দেওয়া মেয়ে, চায়ের দোকানি , হকার। সবাই যাঁকে চেনে। যাঁর বাড়ি চেনে।
সেই মহাশ্বেতা, যিনি বড় অ্যাপার্টমেন্ট এ গেলে, প্রথমে যে কথা ভাবেন, তা হল, বাড়িটা বড় হলে, খেড়িয়া শবরদের কেউ কেউ কলকাতায় এলে ওঁর কাছেই তাদের থাকার ব্যবস্থা ভালভাবে করতে পারবেন ।
মনে রাখি এক অক্লান্ত অক্ষরসেবককে, অক্লান্ত লেখাকর্মীকে, অক্লান্ত সমাজকর্মী, অ্যাক্টিভিস্টকেও। বাংলা সাহিত্যে লেখক অ্যাক্টিভিস্ট এতটাও কিছু সুলভ নয়। মহাশ্বেতা একজনই।
কিন্তু সেই বিশালতার পরেও, আমরা দেখি তাঁর ব্যক্তির পরিচয়। ব্যক্তিপরিচয়ে যাঁরা এসেছেন মহাশ্বেতার কাছাকাছি, তাঁদের নানা কথা থেকে উঠে আসে একটাই সুর। বিশাল মাপের লেখক মানুষটিকে ছাপিয়ে গেছে তাঁর অন্য কাজ। আর তাকেও ছাপিয়ে গেছে তাঁর ব্যক্তিত্বের দার্ঢ্য, তাঁর সারল্য, ভাণহীনতা। একের পর এক মানুষের চারণে আমরা একটি এমন মানুষকে দেখি , টিভির পর্দাতেও , সময়ে অসময়ে যাঁর আড়ালহীন ভাণহীন অবয়ব আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মেধাসাম্রাজ্যের ভেতর বসবাস করেও মুহূর্তের জন্য বাস্তবের মাটি ছেড়ে পা নড়েনি তাঁর। হয়ত বা গরিব মানুষের কাছাকাছি থাকা, তাঁদের জন্য ভাবা, গরিব মানুষের কাজ করাটা নিশ্বাস প্রশ্বাসের মতই সহজ সরল, এমন এক প্রজন্মের কতিপয় মানুষের মধ্যে তিনিও একজন।
আর, যারা এখনো তাঁর স্বামীর সঙ্গে অথবা তাঁর পুত্রের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ঘিরে কথা বলতে বেশি ভালবাসে, তাঁর নিজস্ব কাজের বৃত্ত বাদ দিয়ে , তাঁদের দিকে ফিরিয়ে দিতে পারি নিজেদের উপেক্ষার মুখ।
বাংলাদেশ সময়: ১৩২১ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০১৬
এসএনএস