গ্রীষ্মের দুপুরে পুরো মহল্লা ঝিমিয়ে পড়েছে। শান বাঁধানো পুকুর পাড়ে দুপুরের তেঁতে ওঠা রোদ টলমল জলের উপর শুয়ে আছে।
বিয়ের দুই মাসের মাথায় প্রথম স্ত্রী জয়তুনের এক ভয়ঙ্কর রোগ ধরা পড়ে। গঞ্জের মিশনারি ডাক্তার বলেছিল, জয়তুনের স্তন ক্যান্সার হয়েছে। এই শুনে রইরই পড়ে যায় মৃধা বাড়িতে। অলুক্ষণে অপয়া জয়তুন এই বাড়ির সবার মধ্যে সেই ভয়ঙ্কর রোগ ছড়িয়ে দেবে। সম্পর্কের টান, আহাজারি, কাকুতি মিনতি কোনোকিছুই জয়তুনের স্বপ্নের সংসারকে টিকিয়ে রাখতে পারলো না। যদিও গঞ্জের ডাক্তার বলেছিল, প্রাথমিক অবস্থাতেই আছে, নিয়মিত চিকিৎসায় ভালো করা সম্ভব। কিন্তু মৃধা বাড়ির সম্মান আর নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে জয়তুনকে তালাক দিতে হবে বলেই সাব্যস্ত হলো। জয়তুনের হাতের মেহেদি শুকাতে না শুকাতেই জগলু মৃধা তালাক দিলো জয়তুনকে। ততোদিনে জয়তুনের মধ্যে পরিবর্তন ঘটেছে। ভ্রূণ বাসা বেঁধেছে জয়তুনের পেটে। সেই জয়তুনের মেয়ে মরিয়ম। মাথা ভর্তি চুল, বড় বড় মায়াময় কালো চোখ, টিকোলো নাক আর ভোরের স্নিগ্ধতা। যাকে দেখলেই মায়াজাগানিয়া একটা আবহ তৈরি হয়। মৃধা বাড়িতে এমন মায়াময় নজরকাড়া চেহারা গত দুই কূলে কেউ পায়নি। জগলু মৃধার দাদি নশকা বেগম এমন ময়াবতী ছিলো। মরিয়মের ফিরে আসা স্বাভাবিকভাবেই উচ্ছ্বাস জাগানিয়া ঘটনা হওয়ার কথা থাকলেও তা আর হলো না। বরং এক অজানা আতঙ্কে আচ্ছন্ন থাকলো মৃধা বাড়ি।
মৃধা বাড়ির সেই পুরনো ঠাট আর প্রতিপত্তি এখন নেই। ক্ষয়ে আসা প্রতিপত্তির স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে শ্যাওলা জমা, পলেস্তারা খসে ভাঙাচোরা ইট বের হওয়া বাড়ির নিরাপত্তা প্রাচীর। আর সেই নিরাপত্তাহীন আর্থিক অবস্থায় মরিয়মের আগমন নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কা আরও একটু বাড়িয়ে দিলো। হঠাৎ মরিয়মের আগমনে তাই কানাঘুষা চলতে লাগলো মৃধা বাড়ির অন্দর ও বাহির মহলে।
জয়তুনকে তালাক দেওয়ার পর আরও দুইটা বিয়ে করেছিল, টেকেনি। প্রথম বউ দীর্ঘদিন সংসার করলেও কোনো সন্তান হয়নি। কবিরাজ-বৈদ্য, তাবিজ-কবজ কম নেয়নি। কিছুতেই কিছু হয়নি। শেষে একদিন রক্তবমি হয়ে মারা গেলো। আর দ্বিতীয় বউটার বয়স কম ছিলো। উড়ুউড়ু মন আর বয়সের চপলতায় কোনোভাবেই জগলু মৃধার সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিল না। বিয়ের ছয় মাসের মাথায় অন্য একজনের সঙ্গে পালিয়ে গেলো। দ্বিতীয় বউয়ের পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই জগলু মৃধা একা হয়ে পড়ে। অপমান আর অপারগতা জগলু মৃধাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। কমতে থাকে জগলু মৃধার সেই প্রতাপ। তারপর আর বিয়ে করেনি জগলু মৃধা। বিয়ে করার মতো শারীরিক অবস্থাও ছিলো না। রোগে-শোকে বয়সের ভারে ন্যুজ হয়ে পড়ে হঠাৎ করেই। পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে হাঁটা তো দূরের কথা, নিজ হাতে খেতেও পারে না। কবিরাজ গলা অবধি মাটিতে পুঁতে রেখে বিভিন্ন রকম ঝাঁড়-ফুঁক দিয়ে চেষ্টা করেছে। কিছুতেই আর সুস্থ হয়ে ওঠেনি। উপযুক্ত যত্ন আর পুষ্টির অভাবে দিন দিন আরও নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। বাড়ির মানুষেরা দু’-চার দিন দেখাশোনাতেই হাঁপিয়ে ওঠে। শেষে তার সেবা করার জন্য পশ্চিমের পালান থেকে পাঁচ শতাংশ জমি লিখে দেওয়ার বিনিময়ে আম্বিকে রাখার সিদ্ধান্ত হয়। আম্বির দায়সারা যত্ন আর নিজের প্রতি বিতৃষ্ণা নিয়ে খুব বেশিদিন আর অপেক্ষা করেনি। মাস ছয়েকের মাথায় একদিন সকালে অভিমান নিয়ে চলে যায় জগলু মৃধা। অবশ্য সকালে আম্বিই তাকে মৃত অবস্থায় দেখতে পায়। লোকজন বলাবলি করছিলো, লাশের যে হাল তাতে মনে কয় রাইতের পয়লা পহরেই মারা গেছে।
জয়তুন বাবার বাড়িতে থেকে মিশনারি ডাক্তারের পরামর্শ ও চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠলেও শরীর থেকে বা-স্তনটা কেঁটে ফেলতে হয়েছিল। সেলাইয়ের হাত ভালো ছিলো জয়তুনের। বিয়ের গহনা বিক্রির টাকা দিয়ে একটা সেলাই মেশিন কিনে বাবার বাড়িতেই স্থায়ী হয়ে গিয়েছিল জয়তুন। ডাক্তার প্রথমে মরিয়মকে পৃথিবীর আলো দেখাতে নিষেধ করলেও জয়তুন গো ধরেছিল সন্তানের মুখ দেখবেই। যা হওয়ার হবে। কিছুতেই সে গর্ভপাত করবে না। শেষমেশ ভালোয় ভালোয় পৃথিবীতে আসে মরিয়ম। তবে বুকের দুধ খাওয়াতে পারেনি মরিয়মকে। জীবনের গতিপথ থেকে ছিটকে পড়া জয়তুন ক্যান্সারের কাছে হার মানেনি। হার মানেনি সামাজিক প্রথা ও আচারের কাছেও। অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর অক্লান্ত পরিশ্রমে মরিয়মকে পড়ালেখা শিখিয়ে বড় করেছে। এলাকায় পড়ালেখায় উদাহরণ হয়ে ওঠা মরিয়ম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিয়োগ পরীক্ষা দিয়ে ওই এলাকায় প্রথম নারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পায়। সে খবর মৃধা বাড়িতেও এসেছিল। সেই মরিয়ম আজ মৃধা বাড়িতে এসেছে। এতোদিন পর মরিয়মের হঠাৎ আগমনে মৃধা বাড়ি শঙ্কায় ঝিম মেরে রইলো। ছেলেপুলেহীন জগলু মৃধার একমাত্র ওয়ারিশ মরিয়ম। এতোদিন পর কি তাহলে ওয়ারিশের দখল নিতে এলো!
পয়মন্ত বিকেলে মৃধা বাড়ির আশঙ্কাকে সত্যি করে নিজের ভাগের জমি চেয়ে বসলো মরিয়ম। মরিয়মের মা জয়তুন খুবই অসুস্থ। ডাক্তার বলেছে হার্টে ব্লক হয়েছে। অপারেশন করাতে হবে। নয়তো আর বাঁচানো সম্ভব না। বলতে বলতে নাকে মুখে ওড়না গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো মরিয়ম। জগলু মৃধার ছোট ভাই চুনু মৃধা সঙ্গেই সঙ্গেই লাফিয়ে বলে উঠলো, সিটা তো হতে পারে না মইরম। তোমার মাও, মানে জয়তুন এ বারির কেউ না। তার চিকিৎসার জন্যে তো মিয়া ভায়ের জমি জিরাত নষ্ট হইবার দিতে পারি না। আর মিয়া ভাইয়ের জমি জিরাত বিশেষ নাইও। অসুখে পইরা মেলাখানি বেঁইচাও ফালাইছে। এখন হিসাব কইরা দেখতে হইবো ভাগে তার আছে কিনা। মনে তো কয় জমি যা ভাগে পাইতো তার বেশিই বেঁচছে। কাঁদা কাঁটি থামাও, হিসেব কইরা দেখবার পারি তুমি কোনো ওয়ারিশ পাও কিনা। ভিতর থেকে চুনু মৃধার বউ আর বড় ভাই হামেদ মৃধার বউ গজগজ করে বলছে, ইডা কিবা কতা গো, মাই মাই মাই। মিয়া ভাই বাঁইচা থাহনের কালে কোনো ওয়ারিশ আছাল না। আর জয়তুন বেগম তো মিদ্ধা বারিতে থাহনের কালে কোনো ছোল-পোল হয় নাই। কওয় নাগে না-আল্লাই জানে। জয়তুন বেগম মাইয়া পাইলো কোন হানে!!
শুনে মরিয়মের গান গরম হয়ে উঠলো। নিজের কানকে সে বিশ্বাস করতে পারলো না। যেনো মনে হলো, তার কানে গরম সিসা ঢেলে দিচ্ছে কেউ। কান্নার দামকে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। কথাও আর বাড়াতে পারলো না।
এবার হামেদ মৃধা বলতে শুরু করলো, দেহ মইরম, আমরা কিছু কইতে চাই না। এতো দিন পর হঠাত কইরা আইয়া ওয়ারিশ চাবা, আর আমরা দিয়া দিমু-হিড়া হইবার পারে না। হিসাব নিকাশের দরকার আছে। কতো অংশ তুমি পাবা হিডাও তো হিসাব করন লাগবো। সুময় নিয়া একদিন আইয়ো হিসাব পাতি করি। মরিয়ম কাঁন্না কোনোরকম সামলে বললো চাচা, মা আমার বাঁচবে না। একটা কিছু করেন। চুনু মৃধা, ভেংচি দিয়ে বলে উঠলো, একটা কিছু করেন! এইডা কইলেই তো আর করা যাবে না। দান বাসকো খুইলা তো কেউ বইয়া থাহে না। যাও যাও। পরে আইয়ো।
মায়ের অবস্থা ভালো নয়। ডাক্তার মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে বলেছেন। যেকোনো সময় যেকোনো কিছু হয়ে যেতে পারে। কিছুতেই মন বসাতে পারছে না মরিয়ম। মরিয়মের শরীর আজ চলছে না। বুকটা ভার হয়ে আছে। কেমন ভারহীন লাগছে নিজেকে। আজ কিছু একটা হয়ে যাবে মরিয়মের জীবনে। কী হবে তখন মরিয়মের। সে যে একা হয়ে যাবে। কেউ আর তার নিজের বলে থাকবে না। শত ঝড়-ঝাপটায় মাথার উপর যে বট গাছটা ছিলো তা ধীরে ধীরে পাতাশূন্য হয়ে যাচ্ছে। এক এক করে ডালপালা ভেঙে বট গাছের ছায়া দেওয়ার ক্ষমতা যেমন কমতে থাকে, মরিয়মের মায়ের অবস্থাও ঠিক তাই হচ্ছে। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। এক এক করে ডালপালা কেটে নিলে যেমন গাছটাকে আর গাছ বলে চেনা যায় না- হাত পা নিস্তেজ হয়ে, দুর্বল হয়ে যাওয়া জয়তুন বেগমকেও তেমনি আর মানুষ বলে চেনার উপায় নেই। একেবারে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। চোখ-গাল ভিতরে বসে গেছে।
কিছুতেই কিছু করা গেলো না। দেড় লাখ টাকা চাট্টিখানি কথা না। চাচাদের কাছে মামাকে নিয়ে আজই গিয়েছিল মরিয়ম। হিসেব করে দেখিয়েছে, মরিয়ম নাকি ভাগ বাটোয়ারার পর দশ শতাংশ জমির মালিক হয়। ভাই না থাকায় মৃত বাবার ওয়ারিশ তাদের চাচা-ফুপুরাও হয়েছে। বাকি জমি নাকি বেঁচে থাকতে চিকিৎসার জন্য দুই চাচার কাছে বিক্রি করে গেছে বাবা। দশ শতাংশ জমি বাবদ চাচারা ত্রিশ হাজার টাকা দিতে পারবে বলে রাজি হয়েছিল। কিন্তু এক হাতে ঢেরা দিলে তবেই অন্য হাতে টাকা পাওয়া যাবে বলে ছোট চাচা বলে দিয়েছে। অন্যথায় কোনো টাকা নয়। কাছারি খুলতে আরও দুই দিন। সেই রোববার।
রাত শুনশান। মরিয়মের ঘুম আসছে না। হাসপাতালের বারান্দার ওই মাথায় টিমটিম করে হলুদ আলো নিয়ে একটা বাতি জ্বলছে। পাশের বেডে মোবাইলের লাইট জ্বলে উঠলো। মেসেজ এলো মনে হয়। নিচতলা থেকে একযোগে কতোগুলো ডুকরে ওঠা গলার শব্দ শোনা গেলো। কেউ মারা গেলো হয়তো। ধুক করে উঠলো মরিয়মের বুকটা। যেনো হার্টবিট মিস হলো। অন্ধকারে হাতড়ে পানির জগ খুঁজতে গিয়ে পানিসহ জগটা পড়ে গেলো। শব্দ পেয়ে পাশের হার্টের রোগী ভজন শীলের স্ত্রী মালতি জেগে গিয়ে বললো, কিগো বইন ঘুমাও নাই। কতো আর জাইগা থাকবা? নিজে অসুখে পড়লে দেখবো কেডা। ঘুমাও ভগবান দখবো। বলেই পাস ফিরলো মালতি।
নিচের রাস্তায় কতোগুলো কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে। রাতের নীরবতা ছিন্ন করে মালবোঝাই ট্রাক ছুটছে ঘরঘর শব্দ করে। নিচে একটা অ্যাম্বুলেন্স এসে থামলো। ধরাধরি করে একজনকে নামানো হলো। কমবয়সী একজনকে আহাজারি করে ডাক্তারকে বলতে শোনা গেলো, ওনাকে যেভাবে পারেন বাঁচান ডাক্তার। নয়তো আমার সন্তান যে জন্মের আগেই বাবাহারা হয়ে যাবে ডাক্তার।
আর দাঁডাতে পারছে না। ফিরে এসে মায়ের কপালে হাত রেখে বুকটা ধক করে উঠলো মরিয়মের। কেমন ঠাণ্ডা হয়ে আছে। হাত ধরে নাড়াতে গিয়ে দেখলো কোনো সাড়া নেই। মাগো বলে চিৎকার করে উঠলো মরিয়ম। মাথা আছড়ে, ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে মা-মা বলে ডাকছে। সাড়া দেওয়ার কোনো নাম নেই জয়তুনের। আমি যে একা হয়ে গেলাম মা। কোনো ওয়ারিশ আর থাকলো না। বাবার বাড়ি থেকে না-ওয়ারিশ করে দিয়েছে চাচারা। আজ তুমিও আমায় বে-ওয়ারিশ করে চলে গেলে মা। মরিয়মের বিলাপে ভারী হয়ে উঠলো পরিবেশ, এ-ও চোখে আঁচল চাপা দিলো। ভোর হয় হয় করে অ্যাম্বুলেন্স বেরিয়ে পড়লো। ঝিরঝির বাতাস বইছে। সূর্য উঠবে উঠবে করছে। চারদিক ফর্সা হয়ে আসছে। কাকগুলো এলোমেলো ওড়াউড়ি আর ক্যা ক্যা করে তারস্বরে ডেকে যাচ্ছে। হুস হুস করে গাড়ি পিছনে ফেলে সাইরেন বাজাতে বাজাতে ছুটে চলেছে অ্যাম্বুলেন্স। সবকিছুই আগের মতোই চলছে। চলবেও। শুধু মরিয়ম বে-ওয়ারিশ হয়ে গেলো। ভেতর থেকে উথলে এলো কান্না। মামাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। আপাদমস্তক ঢাকা মায়ের নিথর দেহ পড়ে রয়েছে সামনে। একটানা সাইরেন বাজাতে বাজাতে ছুটে চলেছে অ্যাম্বুলেন্স।
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৮ ঘণ্টা, আগস্ট ০২, ২০১৬
এসএনএস