ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ধাতববৃষ্টি ও কুঁকড়ে যাওয়া জন্মের উত্তরাধিকার | আহমেদ বাসার

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩, ২০১৬
ধাতববৃষ্টি ও কুঁকড়ে যাওয়া জন্মের উত্তরাধিকার | আহমেদ বাসার

সপ্রতিভ নাগরিক মনোভঙ্গি আর হার্দ্য সুদৃঢ় শব্দাস্রের চমৎকারিত্ব নিয়ে বাংলাদেশের কবিতায় শহীদ কাদরীর দীপ্ত আবির্ভাব। বাংলা কবিতার মৃদু কোমল অলস প্রকৃতি-বন্দনার উত্তরাধিকার অস্বীকার করে তিনি তাতে যোগ করলেন স্থাপত্যের জমাট লালিত্য।

বাংলা কবিতার প্রথাগত বৃষ্টি-বন্দনা তার চৈতন্য-প্রিজমায় ‘বিদ্যুতের উড়ন্ত বল্লম’ হয়ে ধরা দেয়। যান্ত্রিক সভ্যতার মমত্বহীন চিৎকার যেন বৃষ্টির উন্মাদনায় ভাষা পেয়ে যায়- ‘বজ্র-শিলাসহ বৃষ্টি, বৃষ্টি: শ্রুতিকে বধির করে / গর্জে ওঠে যেন অবিরল করাত-কলের চাকা/ লক্ষ লেদ মেশিনের আর্ত অফুরন্ত আবর্তন’। এই বৃষ্টি উল্লাস বাংলা কবিতায় একেবারেই অভিনব। বাঙালির চিরন্তন রোমান্টিক বৃষ্টি-দৃষ্টি এখানে এসে যেন বড় ধরনের হোঁচট খায়। জল হয়ে ওঠে ‘খল’ আর তীব্র ‘হিংস্র’। এই বৃষ্টি ধুয়ে মুছে ফেলে ভ্রমণ-পথের চিহ্ন। ‘সভ্যতার ভবিতব্যহীন নানা স্মৃতি আর রঙ বেরঙের দিনগুলি’। যেন মুছে ফেলতে চায় ভাবালু সময়ের যত স্মৃতিচিহ্ন আর ঠেলে দেয় এক দুঃসহ ও নির্মম বাস্তবতার কণ্টকাকীর্ণ নগ্ন উঠোনে। এই বৃষ্টি শুষে নেয় ক্ষমতার উত্তাপ আর বাউণ্ডুলে, উদ্বাস্তু আর আজীবন ভিক্ষুকের জীবনে আনে মুক্তির অফুরন্ত উল্লাস। বহমান সময়ের অনাকাঙ্ক্ষিত স্থিতিশীলতাকে দুমড়ে মুচড়ে নাগরিক জীবনে এই ধারালো বৃষ্টি-সন্ত্রাস যেন অভিনব এক জীবনবোধ ও মুক্তির সুপ্ত অভিলাষ নিয়ে ধরা দেয়।

দুই.
নগর-জীবনের নানা অনুষঙ্গ তার কবিতায় অভিনব ভাষাভঙ্গি নিয়ে জীবন্ত হয়ে ওঠে। শহীদ কাদরী ত্রিকালদর্শী টিরেসিয়াসের দৃষ্টি দিয়ে দেখেছেন ‘টাইপরাইটারে ছাওয়া সারা দেশ, কি মুখর, উন্মুখর/ কত না রঙ্গ জানে শো-কেসের সাজানো শেমিজ, শাড়ি/ ঝলমলে ছোটবড় ঘড়ি’। শামসুর রাহমানের মানবিক নগর-দর্শনের বিপরীতে এ যেন এক অতিমানবিক যন্ত্র-উল্লাসের বিভৎস উৎরোল হয়ে ধরা দেয়। শামসুর রাহমান শহরের সব দুঃখ নিজের মুখের ভাঁজে গেঁথে এক বিনষ্ট নগরের দিকে হেঁটে গেছেন। যেখানে- ‘রুক্ষ জনশূন্যতায় পথ ফেলে দীর্ঘশ্বাস ঘনঘন/ ঘূর্ণ্যমান পুরনো কাগজ/ ল্যাম্পোস্টের নিচে খুব শীতকাতুরে পাখির মতো / পড়ে আছে, গাছগুলি বিধ্বস্ত পাথুরে মূর্তি যেন’। শহীদ কাদরীর হাতে এই নির্জীব নগরী যেন টিরোনসিরসের মতো নড়ে ওঠে। আপাত নিরীহ নগর-অনুষঙ্গও এখানে ভয়াল দর্শী ও সশস্ত্র হয়ে ওঠে আকস্মিক। ফলে কবি জন্মেই কুঁকড়ে যান মাতৃজরায়ন থেকে নেমে- ‘সোনালি পিচ্ছিল পেট আমাকে উগরে দিলো যেন/ দীপহীন ল্যাম্প পোস্টের নিচে, সন্ত্রস্ত শহরে’। শহর তার কাছে সন্ত্রস্ত, ছদ্মবেশী আর নীল গলির গোলক-ধাঁধা। যেখানে- ‘ অবিশ্বাস, মখমলের কালো নক্ষত্রখচিত টুপি পরে / সশব্দে দরোজা খুলে এক-গাল হাওয়া খেয়ে’ বেড়ায় বাগানে। ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ারের নগর-ভাবনার সঙ্গে শহীদ কাদরীর ঘনিষ্ঠতা সহজ লক্ষ্য। বোদলেয়ারের নগরে মাতাল, জুয়াড়ি আর গণিকার আধিপত্য। গতিময় নগর-সভ্যতায়মানুষের হৃদয়ই বিলুপ্ত প্রায়। বোদলেয়ারের ভাষায়- Do not look for my heart any more, the beasts have eaten it. নগর-জীবন তার কাছে হাসপাতাল বই কিছু নয় This life is a hospital where each patient is possessed by the desire to change his bed. ফলে মাতলামিই যেন অনিবার্য নিয়তি হয়ে ওঠে এই শহরে-  It is hour to be drunken! To escape being the martyred slaves of time, be ceaselessly drunk. শহীদ কাদরীর নগরেও হেঁটে বেড়ায় উদ্বাস্তু, উন্মুল আর ছদ্মবেশী সব মুখ।

তিন.
শহীদ কাদরীর কাছে ‘রাষ্ট্র মানেই রাষ্ট্রসংঘের ব্যর্থতা / রাষ্ট্রসংঘের ব্যর্থতা মানেই / লেফ্টরাইট, লেফ্ট-!’ যেন এক নির্মম বাস্তবতার দুঃসহ স্মৃতি তার অস্তিত্বে বিদ্ধ অহর্নিশ। স্বদেশকে তিনি দেখেন- ‘ উদ্ধত তলোয়ারের মতো দীপ্তিমান ঘাসের বিস্তারে’। স্বদেশের প্রতি তার গহীনগহনে পুঞ্জীভূত অফুরন্ত অদৃশ্য টান। ফলে তিনি নির্দ্বিধায় বলতে পারেন- ‘একটি আংটির মতো তোমাকে পরেছি স্বদেশ/ আমার কনিষ্ঠ আঙুলে’। ঘরে ফিরবার ব্যাকুল প্ররোচনা ও তার ভিতরে কম ছিল না। কিন্তু বাস্তবতা ছিল প্রতিকূল। বাংলা ভাষার প্রতি তার মমত্ববোধ ও অসামান্য। ‘একুশের স্বীকারোক্তি’ কবিতায় তিনি যখন বলেন- ‘যখনই চীৎকার করি/ দেখি , আমারই কণ্ঠ থেকে / অনবরত/ ঝরে পড়ছে অ, আ, ক, খ ’। তখন মাতৃভাষার প্রতি তার আজন্ম নাড়ির টান হৃদয়গ্রাহ্য হয়ে ওঠে। সর্বশেষ প্রকাশিত ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’ কাব্যগ্রন্থের কবিতায় ও বাংলার প্রতি কবির অকৃত্রিম ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশসহ জলক্ষ- ‘হে নবীনা, এই মধ্য-ম্যানহাটানে বাতাসের ঝাপটায়/ তোমার হঠাৎ খুলে যাওয়া উদ্দাম চুল/ আমার বুকের ‘পর আছড়ে পড়লো/ চিরকালের বাংলার বৈশাখের ঝঞ্ঝার মতন’। বাংলা, বাঙালি ও চিরন্তন বাংলাদেশ কবির সত্তার গহীনে নিরন্তর জাগরুক।
 
ফলে প্রিয়তমা বাংলাদেশকে তিনি অভয় দেন অভিনব শব্দমালায়- ‘ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো/ বন-বাদাড় ডিঙিয়ে/ কাঁটা-তার, ব্যারিকেড পার হয়ে, অনেক রণাঙ্গনের স্মৃতি নিয়ে/আর্মড কারগুলো এসে দাঁড়াবে/ ভায়োলিন বোঝাই করে/ কেবল তোমার দোরগোড়ায় প্রিয়তমা’।

কবি এমন একটি রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেন যেখানে রাষ্ট্রপ্রধান জেনারেলদের হুকুম দেবেন রবীন্দ্রচর্চার, মন্ত্রীদের কিনে দেবেন সোনালি গিটার আর ব্যাঙ্কারদের বানিয়ে দেবেন কবিতার নিপুণ সমঝদার। প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র নাহলেও এমন রাষ্ট্র যে অত্যন্ত মানবিক রাষ্ট্র হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

শহীদ কাদরী মননে চেতনায় একজন তুখোড় নাগরিকের অভিব্যক্তি নিয়ে তাকিয়েছেন জীবন, সমাজ ও সুবিশাল জনপদে; দেখেছেন সভ্যতার লৌহকঠিন বর্মরূপ। নিঃশব্দে দেখেছেন ‘প্রেমিকের দীপ্তমুখ থেকে জ্যোতি ঝরে গেছে’। একজন আগন্তুকের মনোভঙ্গি নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন গ্রাম-জনপদে। সর্বোপরি, স্বদেশকে তিনি দেখেছেন ব্যক্তিগত অন্তরঙ্গ দৃষ্টিকোণ থেকে। ফলে দীর্ঘ প্রবাস জীবনেও মাইকেল মধুসূদন দত্তের কপোতাক্ষ নদের মতো কবির হৃদয়ে সদাজাগরূক ছিল তার স্বদেশ ও স্বভূমি।

বাংলাদেশ সময়: ১৬১০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৩, ২০১৬
এমজেএফ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।