ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

একান্ত সাক্ষাৎকারে নাজমুন নেসা পিয়ারী

‘বিশ্বাস হচ্ছে না কাদরী নেই’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৭, ২০১৬
‘বিশ্বাস হচ্ছে না কাদরী নেই’

সদ্য প্রয়াত স্বল্পপ্রজ কবি শহীদ কাদরী’র দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ বের হয় ১৯৭৪ সালে। সে সময় ঢাকা মাতিয়ে ফেরা নজর কাড়া এক সুন্দরীকে দেখলেই ওই কবিতার চরণ বলে টিপ্পনি কাটতো তরুণীর বন্ধুবান্ধব।

নাম তাঁর নাজমুন নেসা পিয়ারী। জার্মানপ্রবাসী এই লেখক-সাংবাদিক-অনুবাদক কবি শহীদ কাদরীর প্রথম ভালবাসা, সাবেক সহধর্মিনী। জীবনের প্রয়োজনে একসময় কবির সঙ্গে এই কাব্যপ্রেমীর বিচ্ছেদ ঘটলেও একজন নাগরিক কবির উত্থানকালে তিনিই ছিলেন তার কাব্য প্রেরণার অন্যতম উৎস। শহীদ কাদরী ও তাঁর ঔরসজাত সন্তান যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী আদনান কাদরী।
নিউইয়র্কে কবির মৃত্যুর  সংবাদ  জার্মানপ্রবাসী নাজমুন নেসা পিয়ারীর কাছে পৌঁছে ফেসবুকের মাধ্যমে। তিনি তখন ছিলেন বার্লিনের অদূরের আইনস্টাইন সামারহাউজ ক্যাফেতে। খবর পেয়ে মৃত্যপরবর্তী কার্যক্রমে অংশ নিতে পিয়ারী ছুটে আসেন ঢাকায়। কবির বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনায় দোয়া মাহফিলের আয়োজনসহ নানা মৃত্যুপরবর্তী করণীয় করছেন। নিউইয়র্ক থেকে কবির কফিনের সঙ্গে আসা একমাত্র পুত্র আদনান কাদরীর সঙ্গে কাটিয়েছেন কয়েকটি দিন। এখনও তিনি রয়েছেন ঘোর ও অবিশ্বাসের দোলাচলে। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না কবি শহীদ কাদরী আর নেই। এক অন্তরঙ্গ সাক্ষাৎকারে উঠে উসেছে কবিজীবনের জানা অজানা নানা অধ্যায়।


মাহমুদ হাফিজ: আপনি কবির মৃত্যুর শোকসংবাদটি কিভাবে শুনলেন?
নাজমুন নেসা: আমি বার্লিনের অদূরে আইনস্টাইন সামার হাউজ ক্যাফেতে অবকাশযাপনে ছিলাম। সেখান থেকে ফিরে যুক্তরাষ্ট্রে ফোবানা সম্মেলনে যাওয়ার কথা ছিল। আকস্মিক ফেসবুকে একটা ম্যাসেজ এলো নিউইয়র্কের ঠিকানা পত্রিকার সম্পাদক লাভলু আনসারের কাছ থেকে। তিনি লিখেছেন, আপা একটা খারাপ খবর আছে, তাড়াতাড়ি ফোন করুন। আমি সঙ্গে সঙ্গেই ফেসবুকে ব্রাউজ করতে শুরু করি। নিউইয়র্কপ্রবাসী সাংবাদিক আকবর হায়দার কিরণের প্রোফাইলে দেখতে পাই ‘শহীদ কাদরী আর নেই’। আমি যুক্তরাষ্ট্র যাওয়া বাদ দিয়ে দ্রুত ঢাকার টিকেট কাটি। তখন আমার কিছুই বিশ্বাস হচ্ছিল না। এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না কাদরী নেই।

মাহমুদ হাফিজ: আপনার  সঙ্গে কবির পরিচয় হয় কিভাবে?
নাজমুন নেসা: মুক্তিযুদ্ধ শুরুর  আগের বছরে কাদরীর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। তখন আমি সিদ্ধেশ্বরী কলেজে পড়াই। ঢাকার সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আমার উপস্থিতি ছিল নিয়মিত। অনুষ্ঠান-আড্ডা হলেই যোগ দিতাম। এ সময় কাদরী ঢাকার বিউটি বোর্ডিংয়ে কবিদের আড্ডাসহ নানা আড্ডা-অনুষ্ঠানের পরিচিত মুখ। এক অনুষ্ঠানে কথা বলতে গিয়ে কাদরী সুধীন্দ্রনাথ দত্তের একটা কবিতার লাইন মনে করতে পারছিল না। আমি সে লাইনটি বলে দিতেই আমার প্রতি তার নজর পড়ে। আমরা পরিচিত হই। তারপর একসঙ্গে পথচলা শুরু। এখনকার মতো মোবাইল যুগের কথা সেসময় ভাবা যেতো না। ফিক্সড ফোনে কথা বলার ক্ষেত্রেও ছিল নানা বাধা। দেখা করাই ছিল একমাত্র উপায়। কাদরী আমার সঙ্গে নিয়মিত দেখা করতে চাইতো এবং আমরা দেখা করতাম। ঢাকার নানা আড্ডা-আলোচনায় যোগ দিতাম। এটা হবে হয়তো ১৯৭০ সালের নবেম্বর-ডিসেম্বরের কথা।

মাহমুদ হাফিজ: তারপর...
নাজমুন নেসা: এরপর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকায় হামলা করে গণহত্যা শুরু করলে মানুষ ঢাকা ছাড়তে থাকে। আমার বাবা শিক্ষাবিদ এম এ করিম আমাদের তিনবোনকে  ৪৩/১ পুরানা পল্টনের বাড়ি থেকে বুড়িগঙ্গার পারে জিনজিরায় আত্মীয়ের বাসায় পাঠিয়ে দেন। মাস তিনেক পরে পরিস্থিতি একটু শান্ত হলে আমরা ঢাকার বাসায় ফিরে আসি। এ সময় কাদরী বিয়ের ব্যাপারটি ওঠায়। বিষয়টি জরুরি হয়ে পড়ে এ কারণে যে, যাতে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কোথাও গেলে একসঙ্গে যাওয়া যায়। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বিয়ের সামাজিকতার বিষয়টি অনেকটা অকল্পনীয় থাকায় আমরা কোর্টে গিয়ে বিয়ে করে ফেলি। এ সময় আমি আর কাদরী তার ভাইয়ের বাসায় কিছুদিন থাকি। পরে সিদ্ধেশ্বরীতে একটা বাসা ভাড়া নিয়ে সংসার শুরু করি। কাদরী তখন রাশিয়ার একটা নিউজ এজেন্সিতে কাজ করতো। বর্তমান সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামন নূর তখন শহীদ কাদরী’র সহকর্মী ছিলেন। এজেন্সির অফিসটি ছিল ধানমন্ডি। আমার কর্মস্থল সিদ্ধেশ্বরী কলেজ হওয়ায় বাসা থেকে হেঁটেই কলেজে যেতাম।

মাহমুদ হাফিজ: আটপৌরে সংসারজীবনের বাইরে কবির কাব্যজীবন কেমন ছিল?
নাজমুন নেসা: ইতোমধ্যে কাদরীর প্রথম কবিতার বই ‘উত্তরাধিকার’ বেরিয়ে গেছে। ঢাকা ও কলকাতার বড় বড় কবিদের সঙ্গে তার ভাব ভালবাসা প্রগাঢ়। কাদরী’র বুদ্ধিবৃত্তিক উচ্চতা ছিল তার বয়সের চেয়ে বেশি। অনুজ বা অগ্রজপ্রতিম প্রধান কবিদের সঙ্গে মেলামেশায় ও দিন রাত আড্ডা দেয়ার ক্ষেত্রে তার বয়স কোনই বাধা হয়ে ওঠেনি। যে কোন আড্ডা আলোচনায় সে অনায়াসে মধ্যমণি হয়ে উঠতে পারতো তার পঠন ও জ্ঞানের  গভীরতার মাধ্যমে।

মাহমুদ হাফিজ: আপনাদের একমাত্র পুত্র আদনান কাদরীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা সম্পর্কে একটু বলুন...
নাজমুন নেসা: সিদ্ধেশ্বরীর বাসা পাল্টে আমরা বেইলী রোডে বাসা নিই। এ সময় আদনানের জন্ম হয়। তখন দু’জনই চাকরি, সংসার, সাহিত্যচর্চা, আবৃত্তি, সাংস্কৃতিক চর্চা এসব নিয়ে ব্যস্ত। বলতে গেলে, তখন বেড়ে ওঠার সময়। পুরানা পল্টনে মায়ের কাছে পুত্র আদনানকে রেখে দু’জন চাকরিতে যেতাম। রাতে মায়ের বাসায় ছেলেকে দেখে, ঘুম পাড়িয়ে রাতের খাবার খেয়ে বাসায় ফিরতাম। এটা অনেকটা নিত্যকার রুটিন ছিল।

মাহমুদ হাফিজ: একজন তুখোড় আড্ডাবাজ হিসাবে কবির বেশ খ্যাতি। এ নিয়ে ‘অগ্রজের উত্তর’ নামে তার একটা বিখ্যাত কবিতাও আছে। আড্ডা আর সংসার এ দু’য়ের মেলবন্ধন তিনি কিভাবে ঘটালেন তখন?
নাজমুন নেসা: হ্যাঁ, সে আড্ডাবাজ ছিল আগে থেকেই জানতাম। আমাদের মধ্যে চমৎকার বোঝাপড়া ছিল। সে কবি, আমি কবিতার পাঠক ও ভক্ত। তাই আমাদের সংসার কবিতাচর্চা বা আড্ডার বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। সে বিউটি বোর্ডিংয়ের অনুসরণে ঢাকার নানা জায়গায় আড্ডা দিয়ে বেড়াতো। কবি শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন ছাড়াও এলিফ্যান্ট রোডের কবি সিকদার আমিনুল হক, বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে গল্পকার বেটুর সঙ্গে আড্ডা দিতো। কলকাতা থেকে কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ঢাকা এলে আমাদের বেইলী রোডের বাসায় আড্ডা বসতো। তখন কবি রফিক আজাদ, আবু কায়সার, জাহিদুল হকসহ অনেককে এসব আড্ডায় শামিল হতে দেখেছি।
মাহমুদ হাফিজ: স্বাধীনতাত্তোর এই সময়টা মানে ১৯৭৪ সালেই তো কবির ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ কাব্যগ্রন্থ বের হয়।
নাজমুন নেসা: হ্যাঁ এ কাব্যগ্রন্থের নাম কবিতাটি আমার উদ্দেশেই লেখা। এ গ্রন্থে’র উৎসর্গে কাদরী লিখেছিল, “পিয়ারীকে, গানগুলো যেন পোষা হরিণের পাল, তোমার চরণ চিহ্নের অভিসারী”। আসলে কাদরী এ সময় যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্যস্বাধীন দেশের নাগরিক যন্ত্রণার মধ্যে একটি প্রেমকে কাছে পেয়েছিল। তাই এ কবিতায় প্রেমের সঙ্গে সমকালীন জীবনচিত্রকে উঠিয়ে এনেছে সে। যেমন“ভয় নেই/আমি এমন ব্যবস্থা করবো যাতে সেনাবাহিনী/গোলাপের গুচ্ছ কাঁধে নিয়ে/ মার্চপাস্ট করে চলে যাবে/এবং স্যালুট করবে/কেবল তোমাকে প্রিয়তমা। ....ভয় নেই, আমি  এমন ব্যবস্থা করবো/ স্টেটব্যাংকে গিয়ে /গোলাপ কিংবা চন্দ্রমল্লিকা ভাঙালে অন্তত চারলক্ষ টাকা পাওয়া যাবে/একটি বেলফুল দিলে চারটি কার্ডিগান। ”....

মাহমুদ হাফিজ: কবির ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে কিছু বলুন...
নাজমুন নেসা: দেখুন, কাদরী ব্যক্তিজীবনে সাদাসিধে, সহজসরল ছিল। কৌশল, ঘোরপ্যাঁচ সে জানতো না। সে দিলখোলা, আড্ডাবাজ, বোহেমিয়ান টাইপের মানুষ। সাংসারিক জীবনের নিজের প্লেটে খাবারটি পর্যন্ত নিতে পারতো না...লজ্জায়। আমাকে তার প্লেটে খাবার তুলে দিতে হতো। আপাদমস্তক কবি বলেই জীবনের আর সব বিষয়ে তার আনাড়িভাব ছিল। এ কারণে জীবনে ঠকতোও বেশ।

মাহমুদ হাফিজ: আপনাদের বিচ্ছেদ প্রসঙ্গে যদি কিছু বলেন.....
নাজমুন নেসা: দেখুন মানুষের মন আকাশের রঙের মতোন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা বদলায়। আবার তানপুরার অনেকগুলো তারের মধ্যে কোন কোনটি ছিঁড়ে যায়। বিষয়টি সেরকমই। তবে এটুকু বলবো, আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদের পরও আমাদের মধ্যে যোগাযোগ অব্যাহত ছিল।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর আগ্রহ ও সহায়তায় জার্মান বেতারে বাংলা বিভাগ খোলার উদ্যোগ নেয়া হয়। তখন জার্মান বেতারে নারী প্রেজেন্টার নিয়োগের প্রস্তাব আসে এবং ঢাকায় ইন্টারভিউ কল করা হয়। আমি ইন্টারভিউয়ে একশ’জনের মধ্যে প্রথম হই। ডয়েচে ভেলে’তে চাকরি নিয়ে আমি ১৯৭৬ সালে জার্মানি চলে যাই। তখন ছেলে আদনান ছোট থাকায় মায়ের কাছে রেখে যেতে হয়। পরে ১৯৭৮ সালে কাদরী প্রথমে লন্ডন ও পরে  জার্মানি এসে আমার সঙ্গে ছয়মাস কাটায়। পরে আবার ১৯৭৯ সালে সে জার্মানিতে আসে। আমার চুক্তি ছিল তিনবছরের। কিন্তু কাদরী দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়ায় আমিও না ফেরার সিদ্ধান্ত নিই। আমারচুক্তি নবায়ন হয়। তখন ছেলেকে দেখতে আমি প্রতিবছর দেশে ফিরে আসতাম। একসময় কাদরী লন্ডন হয়ে যুক্তরাষ্ট্র পাড়ি জমায়। যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে গিয়ে সে স্বাস্থ্যবিভাগে একটা ভাল চাকরি পায়। এক বিদেশিনীর সঙ্গে জড়িয়ে পড়লে ১৯৮২ সালে দু’জনের সম্মতিতে আমাদের বিচ্ছেদ হয়। কাদরী তাকে বিয়ে করে বোস্টনে তার স্বেচ্ছানির্বাসিত জীবন কাটাতে থাকে। উচ্চশিক্ষার স্বার্থে ছেলে আদনানকে যুক্তরাষ্ট্রে রেখে পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিই দু’জন। আদনান এখন মর্গান স্ট্যানলে’তে ভাল চাকরি করছে।

বাংলাদেশ সময়: ১১০৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৭, ২০১৬
জেডএম/

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।