ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপন্যাস

ধারাবাহিক উপন্যাস

মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্‌সান (পর্ব-১১)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৬
মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্‌সান (পর্ব-১১)

১১.
আলো নেই, রাত নিঝুম,
বুজলেই চোখ, আসে ঘুম।
.....................................................................................................................................
বুনোর মা আমাদের ঘর ছাড়তে বলেছেন।


আদেশ নয় ঠিক, অনুরোধ। বুনোর কারণে আদেশের সাহস হয়নি। মামার সাথে কথা বলেছেন। হাত ধরে বলেছেন, ‘সমাজে থাকি। বাইরের দেশের মানুষ ভাড়া দেওয়াটা আশপাশের মানুষের পছন্দ না। নিরাপদ না। রাগ করবেন না। বাসাটা ছাড়েন। ’ মামা কিছু বলেনি। আমরা তো আর খুব বেশিদিন থাকবো না। মামা সপ্তাহ দুই সময় চায় কিন্তু বুনোর মা মানতে রাজি নয়। আমরা তো চিরদিন থাকবো না। মা সুস্থ হলেই চলে যাবো কিংবা মা... থাক। কে চায় নিজের দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও দিন কাটাতে। আমি অন্তত না।

বুনোর মায়ের রাগের কারণ কিছুটা আঁচ করতে পারি। বুনোর সাথে আমার মেলামেশা পছন্দ করছেন না। সেই প্রথম দিন থেকেই আমি তার কাছে দূরের কেউ। দোষ দেই না। মেয়ের মায়েরা এমনই হয়।
আমি বুনোকে নিয়ে চিন্তিত। বুনোকে এড়িয়ে যেতে চাচ্ছি। কিন্তু মেয়েটা পিছু ছাড়তে চায় না। দুর্বল হয়ে যাচ্ছে ও। যত দুর্বল হচ্ছে আমি তত আগ্রহ হারিয়ে ফেলছি। ধরা-ছোঁয়ার বাইরে কিংবা পাওয়া কঠিন এমন জিনিসের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেশি থাকে। আমার কাছে বুনোকে এখন সহজলভ্য মনে হচ্ছে। বুনো কোনো একটা ঝামেলায় আছে। যন্ত্রণায় আছে। চোখের নিচে কাকের পায়ের ছাপ দেখে বোঝা যায় যে যন্ত্রণায় ওকে জেগে থাকতে হয়। বুনো বলছে না কারণটা। আমি জানতে পারছি না।
 
‘এই মহিলা কি চায়? এই বয়সে টকটকে গাড় লিপস্টিক দিয়ে ঘুরে। ’ মামা বলে কানের পাশ থেকে। তার মেজাজ খারাপ। বুনোর মায়ের কথা সে নিতে পারেনি। টাকা পয়সা তো ঠিকই দেওয়া হচ্ছে। সে মানুষ খারাপ তাও তো না। তাহলে এই বাড়িতে থাকতে কি সমস্যা! মামা আর এ বাড়িতে থাকবে না। যত দ্রুত সম্ভব হোটেলে উঠবেন। খরচ বেশি হোক তবুও উঠবেন।
মেজাজ খারাপ মামার কোন কিছুই সহ্য হচ্ছে না এ মুহূর্তে। বাবার বান্ধবী খুঁজে খুঁজে চলে এসেছে বুনোর বাসায়। তার উপস্থিতি সহস্য করা যাচ্ছে না। এমনকি আমারও ভালো লাগছে না। একসময়ের পছন্দের মহিলাটি এমন অপছন্দের হয়ে উঠলো কিভাবে কে জানে!

রুবি তার সামনে বসে আছে। কোল ভর্তি চকলেট। চকলেট নিয়েও খুব একটা খুশি মনে হচ্ছে না রুবিকে। কারণ মহিলা বকবক করেই যাচ্ছে। নানান প্রশ্ন করছে পড়াশোনা নিয়ে।
‘পরীক্ষা তো দিতে পারো নাই রুবি। তাই না?’ বলে মহিলা।
‘হ্যা। ’ মুখ শুকনা করে বলে রুবি। চোখ তার চকলেটের দিকে।
‘এভাবে তো বাচ্চাদের পড়াশোনা হয় না। বারো মাসই অসুস্থ তোমার মা। প্রব্লেম। তা বই খাতা নিয়ে এসেছো সব সাথে?’
‘হ্যা। ’
‘পড়াশোনা করো বলে তো মনে হয় না। তোমার দিকে কারো কোনো খেয়াল নাই। আমি খেয়াল রাখবো। ওকে?’

রুবি জবাব দেয়না এবার। বুনো চলে আসে রুবির কাছে। ছাদে যাবে। রুবির বয়সী আরও কিছু ছেলে মেয়েরা আসবে। এই সময়টা রুবির জন্য আনন্দের। পৃথিবী জুড়ে রুবির বয়সী ছেলে মেয়েদের চিন্তা-ভাবনা, ব্যবহার, খেলাধুলা সব মনে হয় একই রকম।
ভিনদেশের ছেলে মেয়েগুলোর সাথে রুবি খুব সহজেই মিলে যায়। ঝগড়া করে, খাবার ভাগ করে খায়, খেলতে খেলতে সময় ভুলে যায়।
রুবিকে নিতে আসার ব্যাপারটা পছন্দ হয় না বাবার বান্ধবীর। সেটা জানিয়ে দিতেই যেন বুনোকে দেখেই সে আপন মনে বলে, ‘বুনো-এ আবার কেমন নাম? এই নাম কেন? আজগুবি। ’
‘বনে থাকতো তো ছোটবেলায় তাই নাম বুনো। ’ বুনোর হয়ে রুবিই জবাব দেয়। খিলখিল করে হাসে। মহিলাকে আচ্ছাসে শিক্ষা দেওয়া গেল এইজন্য যেন। বুনো আর রুবিকে দুই প্রাণের বান্ধবী মনে হয় এই সময়ে দেখে। একজন আরেকজনের সামান্যতম সম্মান ক্ষুন্ন হতেও দেবে না যেন। কোন একজনের কেউ ক্ষতি করার চেষ্টা করলেই তার বিরুদ্ধে ক্রোধে উন্মত্ত সাপের মতন ফুঁসে উঠবে যেন।

দুইজনকে এভাবে দেখে বাবার বান্ধবী আর কথা বলবার সাহস পায় না। বুনো চলে যায় রুবিকে নিয়ে। এরপর বাবার বান্ধবী একা বসে থাকে। কথা বলার কেউ নেই। আমি আর মামা দূরে আড়াল থেকে সব দেখি। কাছে যাই না। কাছে গেলেই কথা বলতে হবে। এই মহিলার সাথে কথা বলার এখন কোন মানেই হয় না।

‘শোন্‌ আমি গেলাম হাসপাতালে। তুই থাক। কথা বল। ’ মামা আমাকে বলে। কি সুবিধাবাদী! মহিলার কাছে আমাকে রেখে নিজে উধাও হবেন।
‘না না। থাকো তুমি। আমাকে যেতে হবে। তাছাড়া মাকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব। ’ এই বলে চোখটা ছলছল করে তোলার চেষ্টা করি আমি। মুখে ছদ্মবেশী বিষাদ মেখে শুকনো মুখে মামার দিকে তাকাই। মাকে দেখতে না পারলে মরেই যাবো যেন এমন একটা ভাব!
ভাগনে-ভাগনির মলিন মুখ মামা সহ্য করতে পারেন না। বলে, ‘আচ্ছা যা যা। বুঝছি। থাকতে হবে না। সব ঝামেলা আমার। ’

আহারে বেচারা মামা। আমার হাসিই পায়। মা অই মহিলার সাথে কথা বলার জন্য শুকনো মুখে যান। ভদ্রতা বলেও তো ব্যাপার আছে।
আমি পালাই। মহিলার সামনে পড়তে চাই না। তাকে আমার এখন আর ভালো লাগে না। সে কী চায়? একবারও দেখা করলো মায়ের সাথে! আমাদের সাথে কী? মতলব ভালো না মহিলার। সহ্য হয় না। সহ্য হচ্ছে না একটুও আমার।
বাইরে বের হই। যতই দূরে হোক হাসপাতাল পর্যন্ত হেঁটে যাবো বলে ঠিক করি।
আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ। বিভ্রান্ত। দেখি।
মেঘগুলো কোন দিকে যাবে মনস্থির করতে পারে না। কেউ কেউ সাহস করে একটু যেন পৃথিবীর কাছাকাছি চলে আসার চেষ্টা করে। ভালো লাগে। তবে আমার বাড়ির মতন নয়। আপন ভিলার ওপরে চুপটি করে থাকা এক টুকরো মেঘের মতন নয়।
একটা সময় ইচ্ছে ছিলো পৃথিবী চষে বেড়াব। আমি কোন একটি শহরের নয়, কোন একটি দেশের নয়। আমি পুরো পৃথিবীর। পৃথিবীর সব সাগর, নদী, পাহাড় আমার। ঘুরে ঘুরে সেসব জায়গা ছুঁয়ে দিতে চাই। এক জায়গার মেঘ থেকে আরেক জায়গার মেঘে কোন বেসকম আছে কি না জানতে চাই।
এমনই চাইতাম। কত সুন্দর পৃথিবী আর আমি এর কিছুই দেখব না এ কেমন কথা!
পরে ঘরকুনো হয়ে গেলাম। মধ্যবিত্তের ছেলেদের এমন হয়। তারা ঘরের বাইরে বের হতে ভয় পায়। বিদেশ তাদের কাছে অনেক দূর, ভয়ের আর অজানার। জানা গন্ডির মধ্যেই থাকতে চায় তারা। তুচ্ছ জিনিসের প্রেমে পড়ে। নিজের ঘর, নিজের বাড়ি এইসব অনেক জরুরি বিষয় হয়ে ওঠে।
আমার ক্ষেত্রেও তাই। যখন বুঝে গেছি পুরো পৃথিবীর হয়ে ওঠার যোগ্য আমি নই তখন থেকেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। আপন ভিলাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। অই আমার রাজ্য। আমার ছোট্ট জায়গা।
ইচ্ছেগুলো আমাদের অচিন পাখিই হয়ে থাকে। ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। একটা সময় ভুলেও যাই সব। তারপর যখন হুট করে মনে পড়ে যায় তখন মন উচাটন হয়। ঘর ছাড়তে ইচ্ছে করে। স্বার্থপর হয়ে শুধু নিজের কথা ভাবতে ইচ্ছে করে।
নিজের কথা ভাবলেই স্বার্থপর বলে কেন? নিজের কথা ভাবা কি দোষের কিছু?
হাসপাতালে যাই না। আমি হাঁটতে হাঁটতে অপু ভাইয়ের অফিসের দিকে যাই। হাসপাতালের কাছেই।

অফিসে তালা ঝোলে। ব্যবসায় মার খেয়ে ভাড়া দেবার ক্ষমতাও নেই। অপু ভাই অফিসের কাছে চায়ের দোকানে চুপ করে বসে থাকেন। মনমরা থাকেন। কিন্তু মন খারাপ কেন জিজ্ঞেস করলেই বলে, ‘ধুর ব্যাটা, আমার মনই কি আর সেই মনের আবার খারাপ হওয়া কি! মনটন নিয়া ভাবলে চলে না। বসে বসে ভাবি। চা খাই আর ভাবি কী করা যায়। বোঝা গেছে?’
এই লোককে ভালো না বেসে উপায় নেই।
গিয়ে ঠিক ঠিক চায়ের দোকানে পেয়ে যাই অপু ভাইকে। মন ভালো হয়ে যায়। কিছুটা সময় টেনশন ছাড়া ফুরফুরে মেজাজে থাকা যাবে। অপু ভাইয়ের কথা শুনবো আর হাসবো। আমাকে দেখে অপু ভাই বলে, ‘ভাবনায় ডিস্টার্ব করতে আসলি রে। চা খাবি। ’
‘দাও। ’ আমি খুশি মনে মাথা নাড়াই।
‘তোর মায়ের কী অবস্থা?’ চায়ের ঘটি আমার হাতে দিয়ে বলে অপু ভাই।
‘উন্নতি নাই। একইরকম। ’ আমি বলি।
‘উপরওয়ালারে ডাক। এছাড়া গতি নাই। ডাক্তার ফাক্তার কিছু করতে পারবে না। ’
‘হুম। ’
‘হুম টুম না। ধর্মে মন দিতে হবে। আমিও ঠিক করছি সব বাদ দিয়া ভালো হয়ে যাবো। ’
‘ভালো হইলেও ভালো। ’ আমি চা খাওয়ায় ব্যস্ত। চা টা খুবই ভালো হয়েছে আজ। দুধের সর ভাসছে ওপরে।  
‘কি কথাবার্তা তোর। কোন রসকষ নাই। ঠিকমতন জবাবও দিতে শিখলি না। ’
‘বলো বলো। চা খাই তো। ’
‘আচ্ছা খা। শাকচুন্নিটার খবর কিরে?’
‘শাকচুন্নি কে আবার? অবাক হয়ে বলি আমি।
‘তোর বাবার বান্ধবী। আবার কে। ’
‘মামার কাছে রেখে আসছি। ’ এই কথা বলার সাথে সাথেই দুজনে সজোরে হেসে উঠি। ঘটির চা ছলকায়।
‘আহারে মামা রে। কাজটা ঠিক করিস নাই। ’
‘আর কোন উপায় ছিলো না। আপনি বাঁচলে মামার নাম। ’ আবারও হাসি আমরা। চা খাওয়া শেষ করি।
‘বুনোর কী অবস্থা?’ অপু ভাইয়ের কণ্ঠস্বর বদলায়। সিরিয়াস অনেক।
‘ভালোই তো। ’ আমি বলি। এড়িয়ে যাবার জন্য। অপু ভাই কী জানতে চায় আমি জানি না।
‘দায়সারা জবাব দিস না। ’
‘কী জানতে চাও?’
‘আমি যেটা জানতে চাই তুই সেটা ভালো করেই জানিস। জবাব দেবার দরকারই নাই থাক। শুধু বলবো, তোদের বিষয়টা কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারছি আমি। অন্য একটা দেশে এখন তুই। মায়ের চিকিৎসা করতে এসে এমন কিছু করিস না যাতে সবার ক্ষতি হয়। সাবধান করে দিলাম। ’

আমি কিছু বলি না। অপু ভাই আরেক কাপ চা খাবো কিনা জানতে চায়। আমি ‘না’ বলি। তারপর হুট করেই অপু ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নেই। অপু ভাই অবাক হয় না। আমি এমন করবো এটা যেন জানাই তার। সে শুধু বলে সবার খেয়াল রাখতে আর একটু ফ্রি হলে হাসপাতালে যাবে এটাও জানায়।
আমি চলে আসি। হাসপাতালেই যাবো। অন্য কোথাও না। কিন্তু মায়ের সাথে দেখা করবো না আজ।
হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে চুপচাপ বসে থাকবো। যতক্ষণ বসে থাকা যায়।
সবকিছু জটিল করে ফেলেছি। আমিই দায়ী? জট পাকিয়েছে। কিভাবে ছুটবে জানি না।
আমার এসব আর ভালো লাগে না। ইচ্ছেগুলো আবার জীবিত হয়ে উঠতে চায়। সব ছেড়েছুড়ে পৃথিবী দেখতে ইচ্ছে করে। সাগর, নদীর বুকে ঝাপিয়ে ডুবে মরতে ইচ্ছে করে। অচেনা জায়গায় গিয়ে বাস করতে ইচ্ছে করে। নতুন মানুষ, নতুন জীবন।
এসব হবে না। মধ্যবিত্তের ছেলেদের ভালো থাকার ওষুধ একটাই। সেটা ভুলে থাকা।
ভুলে থাকলেই ভালো থাকা যায়।
আমি ভুলবো। ইশ, যদি বুনো আমার মতন ভুলে যেতে পারত!
অপরাধ করে ফেলেছি। ভয়ংকর অপরাধ।
বুনো ক্ষমা করবে না। কখনও করবে না।
আমি ভুলতে চেয়ে পথ ভুল করি। হাসপাতালে যাওয়া হয় না। কই যাই? কই যাই?
এমন কেন হয় আমার সাথে সবসময়?
পথ চিনি না। চেনা নাই।

(চলবে)

বাংলাদেশ সময়: ১৬০৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৬
এমজেএফ/

আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন-
**মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্‌সান (পর্ব- ১)
** মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্‌সান (পর্ব- ২)
** মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্‌সান (পর্ব- ৩)
** মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্‌সান (পর্ব- ৪)
** মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্‌সান (পর্ব- ৫)
** মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্‌সান (পর্ব- ৬)
** মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্‌সান (পর্ব- ৭)
** মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্সান (পর্ব-৮)
** মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্সান (পর্ব-৯)

** মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্‌সান (পর্ব-১০)

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।