সেলিম আল দীনের সঙ্গে উইলিয়াম ফকনারের মানসিকতার একটা মিল ছিল। ফকনার অনেকটা এমন করেই বলেন যে, ‘অন্যরা কী লিখল তার চেয়ে আমি নিজে কী লিখলাম বা লিখছি-- সেটিই লেখালেখির প্রধান বিবেচনা হওয়া উচিত।
আলফ্রেড কাযিন মনে করেন, ফকনারের অসম্ভব সৃষ্টিশীলতার একটি দিক এই যে, তিনি লিখতে গিয়ে কখনোই মনে করতেন না এই লেখা ছাপা হবে এবং এই জিনিস কারো পড়ে বুঝতে হতে পারে। তার সামনে কোনো পাঠক থাকত না। নিজে যেটা প্রকাশ করতে চাইতেন সেটি ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারলেন কিনা-- এটা ছাড়া তার আর কোনো বিবেচনা ছিল না। ফলে নিজে যেহেতু নিজের চেয়ে ভালো লিখবেন, এ কারণে তার লেখা তিনি না চাইতেও আলাদা হয়ে যেত। অবশ্য এই ধরনের মানসিকতা শেষে দিকে তার যে তিটি করেছিল বলে সমালোচকরা মনে করেন, তা হলো পরের দিকের লেখাগুলো আর আগের লেখাগুলোকে কোনো দিক থেকেই পেরিয়ে যেতে পারেনি।
ওই নিজের মতো লিখে যাওয়া, কোনো পাঠকের কথা না-ভাবার মতো সেলিম আল দীনও লেখার সময় বোধ করি এই ভাবনা মাথা থেকে দূর করে দিতেন যে, তার এই রচনা আদৌ মঞ্চায়িত হবে কিনা। মঞ্চায়িত হলেও এর কোনো দর্শক থাকবে কিনা, বা কারা হতে পারে এর দর্শক-- এই সব বিবেচনার কোনোটাই গ্রাহ্য না করে সেলিম আল দীন নিজের শিল্পকর্ম তথা নাট্যকে আপাতঅর্থে তার আমৃত্যু শিল্পসহযোগী নাসিরউদ্দীন ইউসুফের জন্য দুর্গম থেকে দুর্গম করেছেন, অন্তত মঞ্চে সেটিকে উপস্থাপনা করার জন্য।
তাঁর এর পেছনে প্রেরণা ছিল গ্যেটের ‘ফাউস্ট’, যা বোধ করি গ্যেটের জীবদ্দশায় পুরোটা কখনোই মঞ্চায়িত করা যায় নি। আবার ‘ফাউস্ট’ কেবল নাটকই নয়। এর বিন্যাস ও কাহিনী-কথনের ভেতরে যে বিচিত্রগামী অভিযান আছে সেটি একে প্রচলিত নাট্যাঙ্গিক থেকে মুক্ত করে দিয়েছে বা দিতে বাধ্য করেছে। ছিল তলস্তয়ের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিসে’রও প্রণোদনা। কারণ উপন্যাস বলতে ইউরোপীয়রা যা বুঝত তার বিপরীতে দাঁড়িয়েছেন তলস্তয়। এই বিপরীতে যাওয়ার উদ্যোগ ও আয়োজন ‘ওয়ার অ্যান্ড পিসে’র আদ্যোপান্তজুড়ে বিদ্যমান।
সেলিম আল দীন প্রথম দিকে পাশ্চাত্য ধারায় কয়েকটি নাটক লিখেছিলেন। ‘শকুন্তলা’ থেকে তার পথ পাল্টে যায়। তিনি প্রথমে ধ্রুপদী বাস্তবতায় নিজের সৃষ্টিকে অভিষিক্ত করতে চাইলেন। সেখান থেকে চলে এলেন মহাকাব্যিক বাস্তবতায় (‘কেরামতমঙ্গল’, ‘কীত্তনখোলা’, ‘হাত-হদাই’)। তারপর তিনি এলেন কথানাট্যে (‘চাকা’, ‘যৈবতী কন্যার মন’, ‘হরগজ’)। এরপর পাঁচালী-রীতিতে (‘প্রাচ্য’, ‘বনপাংশুল’, ‘ধাবমান’) এবং শেষাবধি সবকিছুর সম্মিলনে তার যে লেখাগুলো রচিত-- ‘স্বর্ণবোয়াল’ বা ‘পুত্র’ এবং ‘নিমজ্জন’ তার উদাহরণ হিসেবে রাখতে পারি।
এতবার নিজের অভীষ্ট কেন বদল করেছিলেন তিনি? এর উত্তর হলো তিনি আসলে পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে একটি লক্ষ্যেই পৌঁছাতে চেয়েছেন। আর তা হলো মহাকাব্যিক নির্মাণ-- যাকে সাবলাইম বলতে পারি, সেই সাবলাইম-ই ছিল তার চূড়ান্ত লক্ষ্য। ফলে তার সামনে ছিল মহাকাব্য, আর তিনি খুঁজছিলেন কাঠামোগত মহাকাব্য কীভাবে নির্মিত হতে পারে তার রূপরেখা। এই দুই-ই সেলিম আল দীনের শিল্পযাত্রার অন্যতম অবলম্বন হয়ে উঠেছিল। ‘প্রাচ্য’ লিখবার আগে থেকেই তিনি এর ভেতরে কাঠামোগত মহাকাব্যের চিন্তা করেছিলেন, যেহেতু বাঙালির সেই অর্থে কোনো মহাকাব্য নেই-- যার নান্দনিক আলো ও তাপ আমাদের চিরদিন শিল্পসজীব করে রাখতে সহায়তা করবে। ফরহাদ মজহার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘সেলিম আল দীন নাটককে উপন্যাসের স্তরে নিয়ে যেতে চান, এটি করতে গিয়ে তিনি তার মূল পথ থেকে সরে গেছেন। ’ তার মতে, সেলিম ‘চর কাঁকড়ার ডকুমেন্টারি’ মতো যে নাটকগুলো লিখেছিলেন সেগুলোতেই ধরা পড়েছিল তার স্বাতন্ত্র্য। কিন্তু সেলিম আল দীন তো নাটক বিষয়টিকেই মনে রেখে দীর্ঘদিন আর কোনো নাটক লিখছিলেন না। তার রচনা মঞ্চস্থ হতে পারে কি না-পারে এই বিবেচনা ভুলে তিনি তার ওই ল্যাভিমুখে উপনীত হতে উদ্যোগী ছিলেন।
সেলিম আল দীনের এই বিদ্রোহটি অনেকেই ধরতে পারেননি। বিদ্রোহটি ছিল পাশ্চাত্যনির্ধারিত শিল্পাঙ্গিকের বিরুদ্ধে; এবং তার এই বিদ্রোহটাকে তিনি শুরুতে নাট্যাঙ্গিকে মোকাবিলা করছেন। পশ্চিমাদের নির্ধারণ করে দেওয়া মহাকাব্য-নাটক-কবিতা-উপন্যাস-গল্প প্রভৃতি যে শিল্পমাধ্যম-- এর কোনোটাকেই তিনি আর মানছিলেন না। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়রা লেখার বিষয় হিসেবে যেমন সমাজ, রাষ্ট্র ও ব্যক্তিগত জীবনের যেসব বিশ্বাস প্রচলিত তার কোনোটাকেই মানতেন না বলে নতুন ধরনের উপন্যাস লিখছিলেন, সেলিম আর দীন সেইখানে ভাঙন ধরালেন শিল্পের উপস্থাপনায় বা আঙ্গিকে। এই ভাঙচুর ছাড়া কোনো লেখক তার শিল্পপথের যাত্রাকে অব্যাহত রাখতে পারেন না। এই ধ্বংস আর নির্মাণের মধ্যে দিয়ে আমরা লেখকের লড়াই, তার জেদ ও অর্জনকে প্রত্য করি।
নতুন ও স্বনির্ভর নির্মাণে সেলিম আল দীনের এই দায়টি প্রকট করে দিয়েছিল আদতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তিনি মনে করতেন শিল্প-- তা সাহিত্য কি প্রযুক্তি দুই দিক থেকেই ধরল-- এতে স্বনির্ভরতা ও আত্মনির্মাণের স্বাতন্ত্র্যই আমাদের দেশের উন্নয়নে প্রকৃত ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের নিজের কিছু থাকা মানেই তো হাত-পাতা মন-মানসিকতার থেকে মুক্তি পাওয়া। তাই বাঙালির নিজস্ব নাট্যরীতি ও শিল্পাঙ্গিকের সন্ধানে তিনি যে খনন শুরু করেছিলেন এবং এর ফলেও তিনি এই চেতনায় উন্নীত হতে পেরেছিলেন যে আমরা কোনো দিক থেকেই নিঃস্ব-রিক্ত কোনো জাতি নই। আমাদের হাতের মুঠোয় হাজার বছর এবং আমাদের গতিপথ সামনের দিকে। এই যে অতীতকে গ্রহণ করে সামনে দিকে যাওয়ার প্রেরণা-- সেটিই সেলিম আল দীনের সমস্ত সৃষ্টির মূল প্রেরণা হয়ে উঠেছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রত্যেকটি জনসম্প্রদায়ের নিজস্ব শিল্পাঙ্গিক আছে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নাট্যরীতির যে অনুসন্ধান তিনি করেছিলেন তা এরই ফল। তিনি কেবল নিজের নির্মাণে ওই খনন চালাননি, একসঙ্গে অন্যরাও যাতে সেই অভিযাত্রা শুরু করে সেই দিকনির্দেশনাও দিয়েছিলেন।
২.
তাঁর প্রতিটি লেখায় তার আগেরটিকে অতিক্রম করে যাওয়ার প্রয়াস থাকে। অন্যদিকে পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক আবহের চেতনা, তার প্রায় প্রতিটি নাটকের অবকাঠামো গড়ে দিয়েছে। যদিও সরাসরি হৈহল্লাময় রাজনৈতিক উন্মাদনা তার কোনো নাটকেই দেখা যায় না। কিন্তু তিনি এও বুঝেছিলেন, মানবজাতির সংকট কেবল একটি-দুটি দেশের বিষয় নয়, এটি পৃথিবীজুড়ে ছড়ানো। তথাকথিত বিশ্বায়ন ও নব্য-ঔপনিবেশবাদ ও যুদ্ধের আড়ালে আদতে ব্যবসা চালানোর মতো হিংস্র-ক্রূর বিষয়গুলোকে তিনি তুলে আনলেন ‘নিমজ্জনে’র মতো রচনায়। রবীন্দ্রনাথ ‘সভ্যতার সংকট’ লিখে মানবপরিস্থিতির যেখানটাকে শনাক্ত করতে চেয়েছেন-- আগ্রাসী মনোভাব, সম্পদের লোভ আর উগ্র জাতীয়তাবাদ ও উগ্র জাতীয়তাবোধ বিশ্বকে এর গভীর সংকটে পতিত করে দিয়েছে-- সেলিম আর দীন তার ‘নিমজ্জনে’ ঠিক সেই কথাটিই নতুন করে বলেছেন। নাৎসি ও ফ্যাসিস্টদের দিকে ইঙ্গিতের স্থলে সেলিম আল দীন অঙুলি নির্দেশ করেছেন মার্কিনিদের যুদ্ধব্যবসার দিকে। দেশে দেশে জাতিগত সংঘাতে মানবতার যে চূড়ান্ত অপমান তারা করছে এটা তাদের মজ্জাগত, কারণ আমেরিকার মূল অধিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের নিশ্চিহ্ন করতে যে ভয়ংকর গণহত্যা তারা ঘটিয়েছিল, গণহত্যার সেই স্বাদই তারা এখনো নিয়ে চলেছে ইরাকে-আফগানিস্তানে এবং আফ্রিকার দেশে দেশে। একজন সত্যিকার লেখক হিসেবে এবং বিশ্ববোধে উদ্দীপ্ত শিল্পস্রষ্টা হিসেবে তিনি তাই কোনোভাবেই আর বিশ্ব-রাজনীতির পাঁকচক্রের চক্রান্তটি না দেখিয়ে স্বস্তি পাচ্ছিলেন না।
৩.
সেলিম আল দীনের বেশ কয়েকটি অলিখিত নাট্যও ছিল যার মধ্যে ছিল ‘শরৎসম্ভোগ’, ‘ময়ূরযান’, ‘হাড়হাড্ডি’ এবং যেটির কথা তিনি খুব কম বলতেন তেমন একটি রচনা ছিল ‘পৌঁছানো’। এর কোনোটাই তিনি লিখে যেতে পারেননি। ‘রুক্ষ্মবর্ণ’ রূপ পেয়েছিল ‘নিমজ্জন’ হিসেবে, কিন্তু এর অনেক কিছুই ‘নিমজ্জনে’র বাইরে থেকে গেছে। কিন্তু তার উদ্যোগের মূল দিকগুলো (বোধ করি তিনি যে অসম্ভব সাধনের দিকে পা বাড়িয়েছিলেন) বিবেচনা করলে তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের লেখক হিসেবে তার এই যাত্রার সমাšতরাল উদাহরণ পাওয়া দুষ্কর।
বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যে সেলিম আল দীনের ভূমিকা বা অবদান যাই বলি, এর হিসাব নিলে আমরা দেখতে পাবো, এক নাটককে অবলম্বন করেই তিনি এ দেশের আত্মনির্মাণের মূল সূত্রটি (মানে আত্মনির্ভরতা) আবিষ্কার করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। শিল্পর মাধ্যমে নিজেকে জানাই কেবল নয়, নিজেকে জানানোর ঘটনাটি ঘটানো সম্ভব। শিল্পের সাহসেই যে উদ্যমী, চেতনায় সুদীপ্ত জাতি গড়ে উঠে বাঙালি পৃথিবীতে মাথা তুলে দাঁড়াবে-- এমন বিরাট শিল্প-রাজনৈতিক বিশ্বাস দিয়ে গড়া ছিল তাঁর সত্তা। ফলে তার নিজের নাট্য রচনা, দেশজুড়ে গ্রাম থিয়েটার আন্দোলন, বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ প্রতিষ্ঠা, নাট্য গবেষণার মাধ্যমে বাঙালি জাতির নিজস্ব নন্দনতত্ত্ব বা দর্শন আবিষ্কারের দিগন্তে পা বাড়িয়ে ছিলেন তিনি। ফলে লেখক হিসেবে, সংগঠক হিসেবে এবং শিল্পকলার শিক হিসেবে তিনি তাঁর ভূমিকাকে একটি বিশেষ মাত্রায় কেবল নিজের দিকেই ধরে রাখেননি-- তা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন নানানভাবে। যেমন তরুণ লেখক-কবিদের সান্নিধ্যের উত্তাপে তিনি নিজেকে যেমন সজীব রাখতেন, তাদের সঙ্গে তর্কে ও দ্বন্দ্বসমন্বয়ে বুঝে নিতে চেয়েছেন সমকালের শিল্পের গতিপ্রকৃতিকে। আর তাদের পরিচিত করাতে চেয়েছেন তার মতো লেখকের নান্দনিক লড়াইয়ের সঙ্গে।
সেলিম আল দীনের নির্মাণপথের দিকে যে যাত্রা করেছিলেন তা তার নিজের জন্যই এক দুঃসহ অভিযান ছিল। তিনি পণ্যসভ্যতার ক্ষত ও রণ দেখে যাচ্ছিলেন, অন্যদিকে জীবনজীবিকার ক্ষেত্রে তাকে পালন করতে হয়েছে নানান প্রাতিষ্ঠানিক দায়। সেখান থেকে তার স্বভাবের অনেক বৈপরীত্য তুলে আনা যায়, কিন্তু এমন কাজ আরো অনেককেই করতে হয়েছে যারা কেউ সেলিম আল দীনের মতো নাটক লেখেননি, এবং প্রতিনিয়ত নিজের বিরুদ্ধে নিজের আত্মহননের ছোরায় শান দেননি। জীবনের জটিলাবর্তে ঘুরপাক, স্রোত ও প্রতিস্রোতের মুখোমুখি তার চলাটিকে শেষবাধি বিনম্রচিত্তে স্মরণ করতে হয়।
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১২১৫, আগস্ট ১৮, ২০১০