ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

মুঘল গ্রন্থপ্রেম ও গ্রন্থাগারপ্রীতি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭০৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৮, ২০১৭
মুঘল গ্রন্থপ্রেম ও গ্রন্থাগারপ্রীতি মুঘল গ্রন্থপ্রেম ও গ্রন্থাগারপ্রীতি

বাংলাদেশ বা উপমহাদেশের পাঠাভ্যাস, নন্দন সৌন্দর্য, শিল্প সুষমা, সভ্যতা, শিক্ষা, সুরুচি ও সংস্কৃতির প্রথম আধুনিক ও বিশ্বজনীন প্রকাশ ঘটে মুঘল আমলে।

প্রতিষ্ঠাতা মুঘল সম্রাট বাবর গ্রন্থাগারের মতোই বাগান খুবই ভালোবাসতেন। পুষ্পময় কাশ্মীর ছিলো তার অতি প্রিয় স্থান।

কাশ্মীরকে বাবর বলতেন, ‘আমার ব্যক্তিগত বাগিচা। ’ বাবরের গ্রন্থাগারপ্রেম ও উদ্যানপ্রীতি তার অধঃস্থন সব নৃপতিই বজায় রেখেছিলেন। দক্ষিণ এশিয়ায় মুঘলদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-চিত্রকলা-গ্রন্থাগারপ্রীতি এবং নান্দনিক-সাংস্কৃতিক-পরম্পরা আসলেই ছিলো ঐতিহ্যগত উত্তরাধিকার। তাদের হাতে বিকশিত হয়েছে বহু ঐতিহাসিক গ্রন্থ, গ্রন্থাগারের ভিত্তি, মিউজিয়াম ও চিত্রকলার আদি উদ্যোগ। নৃত্য-গীত, ভাস্কর্য, প্রাসাদ, উদ্যান আর তাজমহলসহ বিশ্ববিশ্রুত বহু স্থাপনার সাংস্কৃতিক ঔজ্জ্বল্যের সঙ্গে সঙ্গে মুঘলদের মধ্যে দেখা গেছে গ্রন্থ, গ্রন্থাগার-জাদুঘর, ইতিহাস সংক্রান্ত দ্যুতিময়তা।

মুঘলরা এক হাতে ধর্ম আর অন্য হাতে কৃপাণ নিয়ে আসেননি, এসেছিলেন অগ্রসর চিন্তা, সংস্কৃতি আর আধুনিকতাকে নিয়ে। তাদের সঙ্গে এসেছিল কামান আর গোলাপ। অর্থাৎ অগ্রসর প্রযুক্তি আর সুকুমার সংস্কৃতি। প্রতিষ্ঠাতা বাবর ছিলেন একজন চাগতাই তুর্কি, বিশ্বজয়ী তৈমুরের বংশধর আর মায়ের দিক থেকে আরেক দ্বিগবিজয়ী চেঙ্গিস খানের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং সমকালীন নৃপতিদের রেনেসাঁর রাজপুরুষ সমতুল্য, পণ্ডিত নেহেরুর ভাষায় ‘অন্যতম শ্রেষ্ঠ নৃপতি, বীর, সাহসী, মুক্তমনা সাহিত্য ও শিল্পরসিক, সুন্দর অভিযাত্রী, মধ্য এশিয়া-ইরানের মার্জিত ইসলামিক রুচির প্রবর্তক, ইতিহাসের একজন বিখ্যাত জীবনস্মৃতিকারক, লালিত্যময় মুঘল সংস্কৃতির স্রষ্টা’।

ইসলাম ধর্ম নেওয়ার পূর্বে বাবরের বংশধারা খ্রিস্ট-পূর্ব দেড় শতক থেকে বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী ছিলো। বিশ্বজয়ী চেঙ্গিস খানও এক প্রকার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন। তৈমুর রাজবংশ প্রখ্যাত তিমুরিজ সভ্যতার প্রবর্তক, যার মধ্যে মধ্য এশিয়ায় অনুপম স্থাপত্য ও শিল্পকলা ছাড়াও বিজ্ঞান চর্চা অন্তর্ভুক্ত ছিলো। মুঘলদের উত্তরাধিকারের মধ্যে ছিলো উলুগ বেগের মানমন্দির, আল বেরুনির কিতাবুল হিন্দ বা ভারত সমীক্ষা, ফেরদৌসীর পারসিয়ান জাতীয় মহাকাব্য শাহনামা, রুমী-হাফিজের মরমীবাদ, শেখ সাদীর মানববাদ, ওমর খৈয়ামের বৈপ্লবিক সমাজ চিন্তা আর ছিলো প্রাচ্যের র‌্যাফেল রেহজাদের চিত্রকলা, যাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে মুঘলদের বিশ্ববিখ্যাত মিনিয়েচার আর্ট।

ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের জনক এই সিংহ কিংবা বাঘের মতো মানুষটার পুরো নাম জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর, যার হাত থেকেই একদিন পাওয়া গিয়েছিল দুটো দীর্ঘস্থায়ী-মূল্যবান উপহার। প্রথমটা তার আত্মচরিত, যার নাম বাবরনামা, যাকে মনে করা হয় সেন্ট অগাস্টিন আর রুশোর কনফেশনস আর গিবন ও নিউটনের মেমোয়ার্স-এর সমকক্ষ। আর দ্বিতীয় হলো বাগান বা গুলিস্তান, যাকে মুঘলরা মনে করতো স্বর্গ।

বাবরের আরও অনেক গুণাবলী ও মানবিক মূল্যবোধের পরিচয় রয়েছে তার বিচিত্র জীবন এবং মাতৃভাষা তুর্কিতে লেখা অমর আত্মচরিতে। আত্মচরিত হলো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, ব্যক্তি স্বাধীনতাবোধের পরিচায়ক, আত্মপ্রকাশের শ্রেষ্ঠ বাহন ও আধুনিক উপন্যাসের পূর্বসূরী। তার জীবনস্মৃতি থেকে কাব্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রীতি, চিত্রকলাপ্রীতি, দুর্ধষ যুদ্ধপ্রিয়তার বিবরণের সঙ্গে সঙ্গে তৎকালীন ভারতবর্ষের সমকালীন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সর্বোপরি প্রাকৃতিক বর্ণনার মহামূল্যবান ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত জানা যায়। সংস্কৃতিবান, বুদ্ধিদীপ্ত, রসিক, বন্ধু-বৎসল, সৌন্দর্যপ্রিয় রাজপুরুষের উদাহরণ তিনি। হিন্দুস্তানি সমাজ ও জীবন-যাত্রার এতো নিঁখুত পর্যবেক্ষণ বাবর ছাড়া কেউ করতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে হয় না। তিনিই প্রথম বাঙলার অধিবাসীদের বাঙালি অভিধায় চিহ্নিত করেন। তবে একজন স্পর্শকাতর, সংবেদনশীল ও প্রবল অনুভূতিসম্পন্ন মানুষ হিসাবে প্রৌঢ় বয়সে বিজিত ভারত তার কাছে প্রিয় হলেও ভালো লাগেনি। স্বদেশের বরফের শরবত বা মাস্ক মেলন বা সরদা খরমুজের জন্য আপেক্ষ করেছেন।  

পুত্র হুমায়ুন বাবরনামা তুর্কী থেকে ফারসিতে তর্জমা করেন। আকবরের শাসনামলে ১৫৯০ সালে বিখ্যাত বৈরাম খাঁর সন্তান আবদুর রহিম খান খানান বাবুরনামা-এর পূর্ণাঙ্গ টীকা-ভাষ্যসমেত একটি প্রতিনিধিত্বশীল সংস্করণ তৈরি ও প্রকাশ করেন। ১৮৫৭ সালে গ্রন্থটি এম. ইলমিনস্কি কর্তৃক কাজানে এবং ১৮৭১ সালে এম. প্যাভেট দ্য কোর্টিলা কর্তৃক ফরাসি ভাষায় অনূদিত হয়। তবে, এরও আগে, একটি মূল্যবান ভূমিকা ও বিশদ টিকা-ভাষ্যসহ জন লেডেন এবং উইলিয়াম এরসকিন ১৮২৬ সালে এর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন।

তত্ত্বগতভাবে বলা হয়, রাষ্ট্রিক ইতিহাস জন্ম নেয় রাজসভায়; রাজন্যবৃত্তই রাষ্ট্রচর্চার আদি আঁতুড়ঘর। এ কারণেই রাজপুরুষদের আত্মকাহিনী ও স্মৃতিচর্চা ইতিহাসের একটি বড় উপাদান। ভারতীয় উপমহাদেশে ইতিহাস অন্বেষার এই ধারার জন্মচিহ্ন স্পষ্টতর। রাজা, মন্ত্রী, সেনাপতি, সভাসদ রাজকর্মচারী ও বিজেতাদের নানাবিধ আত্মজীবনী, ভ্রমণকথা ও স্মৃতিতর্পণ উপমহাদেশীয় ইতিবৃত্তের একটি মৌল অধ্যায়। এই ধারার জন্ম হয়েছিল বাবরের হাতে। তৈমুরের বংশধর বাবর ভারতবর্ষে শুধু সাম্রাজ্যই প্রতিষ্ঠা করেননি, আত্মজীবনী লেখাও শুরু করেছিলেন। বাবর এক্ষেত্রে একজন প্রতিকৃৎ। কারণ ধর্ম, জাতি, সম্প্রদায় ও পরিবারের গণ্ডি পেরিয়ে ব্যক্তির আত্মপ্রকাশ তখন খুব পরিচিত রীতি ছিলো না। স্বভূমির মায়া, যৌবনের সংরক্ত স্মৃতি ও ভারতে সাম্রাজ্যের সংস্থাপনে বৈধতার দাবি ইত্যাদি নানা কারণে বাবরনামার প্রকাশÑআশ্চর্য সে কাহিনী। হুমায়ুন ভগ্নিকে দিয়ে এ ধারা চালু রাখেন। আকবর নিজে কিছু লিখে যেতে না পারলেও আবুল ফজল ছিলেন তারই সভাসদ, তারই নির্দেশে ইতিহাসকার। জাহাঙ্গীর পূর্বপুরুষদের পথ ছাড়েননি। এভাবেই শ্রেষ্ঠ মুঘলদের উপাখ্যানকে আশ্রয় করে মধ্যযুগের ভারতবর্ষের ইতিহাস মূর্ত হয়েছিল। গ্রন্থ ও গ্রন্থাগারের বিকাশ ঘটেছিল।

ইতিহাস বলছে, মুঘল রাজপুরুষরা বাবরের ঐতিহ্য অনুসরণ করে অনেকেই হয়েছিলেন স্বয়ং ইতিহাসকার। বস্তুত, বহুশ্রুত ‘তারিখ’ (বাংলায় ইতিহাস বা কালপঞ্জি) ঘরানার ইতিহাসচর্চায় মুঘল রাজপুরুষদের অবদান সর্বজন স্বীকৃত। ভারতবর্ষের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ক্রমশ ছড়িয়েছে মুঘল শক্তি ও সংস্কৃতি এবং সেই উত্তেজনার কাহিনী লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন বিজেতারা। মুঘলরচিত সেইসব ‘তারিখ’-এ তরবারির রোমান্স আছে, মধ্য এশিয়ার উৎসাহ আছে, নতুন বিজয়ের আবেগ আছে এবং সবকিছুকে ছাপিয়ে বাবরের দেখানো আদর্শ অনুযায়ী তন্ময় তথ্যনিষ্ঠাও আছে।   

যে যুগে, যুগনায়ক হালাকু-চেঙ্গিসের ঐতিহ্যকে ধারণ করে কোনো শহর দখলের পর লুটপাটের জন্য যুদ্ধবাজ সৈনিকদের মুক্তভাবে ছেড়ে দেওয়ার প্রচলন ছিলো, সেখানে বাবর সুকৌশলে তার নেতৃত্বের গুণে সামরিক ফৌজকে শৃঙ্খলাবদ্ধ রেখে বহু মানবিক-সাংস্কৃতিক বিপর্যয় ও প্রাণহানি রোধ করাসহ অনেক সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ শহর-জনপদ ও সভ্যতাকে রক্ষা করেন। মধ্যযুগের পৃথিবীর ইতিহাসে বাবর ছাড়া অন্য কোনো নৃপতি শিল্প-সংস্কৃতি-সভ্যতা-সুকুমারবৃত্তির প্রতি এমন উচ্চতর দরদ আর ভালোবাসা দেখাতে পারেননি।  

বাবর একজন সত্যিকারের কবি ছিলেন। তার আত্মজীবনীর ছিঁটেফোঁটা শ্লোকগুলো ছাড়াও তার রচিত এমন অনেক তুর্কি গীতিকবিতা পাওয়া গেছে, যেগুলোকে তার যুগের শ্রেষ্ঠ কবিতাসমূহের সঙ্গে তুলনা করা যায়। ইতিহাসে কোনো দিগি¦জয়ীর পক্ষে একজন প্রসিদ্ধ কবি হওয়ার দৃষ্টান্ত খুব কমই দৃষ্টিগোচর হয়। জুলিয়ান সিজার ও নেপোলিয়ন যদিও বিদ্বান ছিলেন, তথাপি বাবর তুর্কি ভাষায় এমন একজন কবি ছিলেন যে, সৈনিক বা শাসক হিসেবে খ্যাতি না থাকলেও কবি হিসেবে তিনি সুখ্যাতি লাভ করতে পারতেন। মুবাইয়েন নামে বাবর একটি ধর্মীয় কাব্যগ্রন্থও রচনা করেন। এমনকি, যুদ্ধাক্রান্ত জীবনের শেষ দু’বছর তিনি প্রসিদ্ধ খাজা আহরার রচিত বাবর-পিতার জীবনীমূলক গ্রন্থ রিসালাতে ওয়ালিদিয়া নামক আরবি পুস্তক তুর্কি ভাষায় অনুবাদ সম্পন্ন করেন। বাবর প্রকৃতি ও সত্যপ্রেমিক কবি ছিলেন, যিনি সঙ্গী ও অন্যান্য নন্দনকলায়ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।

মাত্র ৪৮ বছর বয়সে তিনি যখন মারা যান তখন তার ২৬ বছরের বাদশাহি জীবন অতিবাহিত হয়েছে, যার মধ্যে শেষ চার বছর তিনি ছিলেন ভারতেশ্বর। বাবরের অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী কাবুলের এক বৃক্ষচ্ছায়াতলে অবস্থিত পার্বত্য ঝরনার পাড়ে তাকে সমাহিত করা হয়। সম্রাট বাবর নিজে কাবুলের পাহাড়-ঘেরা স্থানে উদ্যান নির্মাণ করে সেখানে তার কবরের জন্যে একটি স্থান চিহ্নিত করেছিলেন এবং বাগানঘেরা স্থানটিকে তিনি ‘সবচেয়ে মনোরম জায়গা’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। বিশাল ভারত জয় করে নিজেরই অলক্ষ্যে দীর্ঘকাল সেখানে শাসনের ভিত্তি রচনা করলেও বাবরের হৃদয়ময় অবস্থিত ছিলো মধ্য এশিয়ার স্মৃতি। সেই স্মৃতির টান তিনি কখনোই ভুলতে পারেননি। ভুলতে পারেননি মৃত্যুর কথাও। বিভারিজের অনুবাদে বাবরনামায় মৃত্যু বিষয়ক একটি কবিতায় ফুটে আছে তার দার্শনিকতা:
            এ দুনিয়ায় এসেছেন যিনি, তাকে মরতেই হবে
            বেঁচে থাকবেন শুধু আল্লাহ, তিনি চিরঞ্জীবী।
            জীবনের মেলায় যিনি প্রবেশ করেছেন,
            তাকে শেষে মরণের পেয়ালা থেকে পানীয় গ্রহণ করতে হবেই।
            যিনি জীবনের সরাইখানায় এসেছেন,
            তাকে পরিণামে বিশ্বের দুর্গতির আলয় ত্যাগ করে যেতে  হবেই।

পুত্রে পিতার গুণ বর্তে, সর্বদৃষ্টান্তে ইতিহাস এ কথা সপ্রমাণ করে না। বাবর যেসব গুণে অলঙ্কৃত ছিলেন, উপযুক্ত হয়েও হুমায়ুন সেসব গুণের সম্পূর্ণ উত্তরাধিকারী হননি। তিনি ৯১৩ হিজরির ০৪ জিলকদ মঙ্গলবার কাবুলে জন্ম নেন। তার জন্মলগ্নে অস্তাচলের সূর্য আরক্তিম ছিলো। হুমায়ুনের জন্মসালে বাবর এই মর্মে ফরমান জারি করেন যে, এখন থেকে তাকে ‘বাদশাহ’ সম্বোধন করতে হবে। ইতিপূর্বে তাকে শুধু মির্যা বাবর সম্বোধন করা হতো। সেকালে শাহজাদাদের মির্যা বল হতো। বাবর তার এই পুত্রকে সুলতান হুমায়ুন খান এবং শাহ ফিরোজ কদর নামে অভিহিত করতেন।  

বাবর যেসব রাজ্য করায়ত্ত করেন, হুমায়ুন সুশৃঙ্খলভাবে সেগুলো পরিচালনা করতে পারেননি; এমনকি, তাকে রাজ্যহারা হয়ে পথে পথ ঘুরতেও হয়েছিল। সন্ধিবিগ্রহেÑমিত্রলাভে হুমায়ুনের দক্ষতা কিছু কম ছিলো; শত্রুও হয়েছিল অনেক; যদিও তিনি ছিলেন কোমল হৃদয়, স্বপ্নাতুর, ভাবপ্রবণ এবং আরও বহু-মানবিক ও কাব্যিক গুণের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। হুমায়ুন সম্পর্কে পত্নী হামিদা বানুর একটি বিখ্যাত উক্তি রয়েছে, ‘আপনি দুর্বল সম্রাট কিন্তু অত্যন্ত সবল একজন কবি। ’

তথাপি বাবরের পর হুমায়ূন একটি অস্থির পরিস্থিতি অতিক্রমের মধ্যেও অবিস্মরণীয় স্মৃতি রেখে গেছেন রোমাঞ্চকর জীবনী বর্ণনার গ্রন্থ, যা লিপিবদ্ধ করেন বাবরকন্যা, তারই ভগ্নি গুলবদন বেগম হুমায়ূননামায় এবং মুঘল সাম্রাজ্য রক্ষার অশেষ প্রচেষ্টার পর সশস্ত্র সফলতায়। হুমায়ুন জ্যোতির্বিদ্যা, অঙ্কশাস্ত্র, দর্শন ও কাব্যচর্চার একনিষ্ঠ অনুরাগী ছিলেন। তার ছিলো তুর্কি, ফারসি ও আরবি ভাষার বিশেষজ্ঞজনোচিত জ্ঞান। গ্রন্থকীট হুমায়ুনের নিত্যসঙ্গী ছিলো সূফি কবি রুমি, হাফিজ, শেখ সাদি, ওমর খৈয়ামের কাব্যসমূহ। নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ, গণিতজ্ঞ, নৃত্য-গীতপ্রিয় এবং বিশাল ব্যক্তিগত পাঠাগারের অধিকারী হুমায়ুনকে বলা হয় ‘মধ্যযুগের বুদ্ধিজীবী’।

হুমায়ুনের সমাজচিন্তা ছিলো মধ্যযুগের বিবেচনায় বৈপ্লবিক। রাজ্যের জনগণকে তিনি জাতি বা ধর্মভেদে নয়, বিভক্ত করেন গুণাগুণের বিচারে। যেমন আহলে দৌলত বা ধনিক শ্রেণী, আহলে সাদত বা সুধীজন, আহলে মুরাদ বা রসিকজন। সরকারি দফতরকেও তিনি প্রশাসনিক শৃঙ্খলাবদ্ধ করেন। যেমন, আতশি বা আগ্নেয়াস্ত্র বিভাগ, হাওয়ায় বা বায়বীয় বিভাগ, আবি বা জলজ বিভাগ, খাকি বা মৃন্ময় বিভাগ। স্থাপত্যশিল্পে অবদান রাখার সময় বা সুযোগ না হলেও তিনিই প্রথম বাস্তুশিল্পে প্রচুর কাঠের ব্যবহার করেন। তার বিলাসবহুল সুরুচির ঐতিহ্য লক্ষণীয় যমুনা নদী বক্ষে আড়ম্বরপূর্ণ জলযানে, যা হাল আমলের আধুনিক বজরা বা হাউসবোটের সমতুল্য। তার ছিলো ভাসমান উদ্যান, ভাসমান প্রাসাদ, ভাসমান বিপণীবিতান। সম্ভবত ক্ষমতায় স্থির হতে না পারার জন্যই তিনি তার সকল আয়োজনকে ভাসমানরূপে নির্মাণ করেন।  

এতোকিছু করা তারই পক্ষে সম্ভব যিনি কি-না ষোল বৎসরের রাজত্বকালের এগারো বছরই অতিবাহিত করেন পারস্য রাজ্যে শরণার্থী হয়ে। এবং যেকোনো পরিস্থিতিতেই তার সঙ্গে ভ্রাম্যমান পাঠাগার ও জ্ঞানভাণ্ডার সঙ্গী থেকেছে। এবং তার মৃত্যুর সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে পাঠাগার। বইপাগল হুমায়ুন প্রাণত্যাগ করেন নাটকীয়ভাবে। মাগরিবের আজান শুনে বিশাল পাঠাগারের সোপান হতে দ্রুত অবতরণ করতে গিয়ে পদস্খলিত হয়ে মারাত্মকভাবে মস্তকে আঘাত পান। জ্ঞান হারিয়ে আর জ্ঞান ফিরে পাননি। একদিকে জ্ঞান-পিপাসা আর অন্যদিকে প্রার্থনা-পিপাসাকে রেখে তার সংক্ষিপ্ত অথচ ঘটনাবহুল অতৃপ্ত জীবনের ইতি টানেন।  

হুমায়ুনের মৃত্যুর পর যে সমাধি সৌধ স্থাপিত হয়, সেটার ঐতিহাসিক ও স্থাপত্য মূল্য অপরিসীম। তদুপরি মুঘল ইতিহাসের যবনিকাপাতের সকরুণ অধ্যায়েরও স্বাক্ষী এই কবরগাহ। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ তথা ভারতের প্রথম স্বাধীনতার আন্দোলন ব্যর্থ হলে শেষ মুঘল সম্রাট ও বিপ্লবের নেতা বাহাদুর শাহ জাফর ১৯ সেপ্টেম্বর বুঝতে পারলেন, মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে তার আর বেশি দেরি নেই। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র কেশ রক্ষিত যে বাক্সটি তার কাছে ছিলো, সেটি ইংরেজ ও তাদের দোসরদের দ্বারা কলঙ্কিত হওয়ার ভয়ে তিনি সেটি হজরত নিজামুদ্দীন আউলিয়ার মাজারের তত্ত্বাবধায়নকারীর হাতে সঁপে দিলেন এবং নিজে সপরিবারে হুমায়ুন মাকবারা বা হুমায়ুনের সমাধিস্থলে আত্মগোপন করে রইলেন। কুখ্যাত ইংরেজ সেনাপতি হডসন সেখান থেকে নির্দয় অপমান সহকারে সম্রাটকে বন্দি এবং মুঘল বংশের শাহজাদা ও অন্যান্যদের প্রকাশ্য দিবালোকে নির্মমভাবে হত্যা করে। হুমায়ুন কিংবা অপরাপর মুঘল বীর-পূর্বপুরুষরা নীরব দর্শক ছিলেন সেই পতন অধ্যায়ের।

মুঘল জ্ঞানমার্গের প্রতিভূ বলা যায় আকবরকে। ঐতিহ্যগতভাবেই চিত্রশালা বা সুরৎখানা, কুতুবখানা বা পাঠাগার মুঘল পরম্পরার উচ্চাঙ্গের সাংস্কৃতিক সত্তার পরিচায়ক। অনেক মুঘল রাজপুরুষ ও নারীর নিজস্ব ব্যক্তিগত অ্যালবাম ছিলো। স্ত্রী নাদিরাকে প্রদত্ত দারাশিকোহর এইরূপ একটি অ্যালবাম ইতিহাসে সুপরিচিত। মুঘলরা মনে করতেন যে, জ্ঞান সঞ্চয় ও জ্ঞান বিস্তারের স্থান হলো পাঠাগার, যেখানে মহান পূর্বসুরীরা জীবন্ত থাকেন। বাবর কেবল আগ্নেয়াস্ত্র প্রবর্তন করেননি, পাঠাগারের বিকাশ ঘটিয়েছিলেন। হুমায়ুন পাঠাগারের সিঁড়ি থেকে পদস্খলিত হয়ে মারা যান।  

আকবর মুঘল পাঠাগারের সুচিত্রিত চিত্রকলাশোভিত বই-এর সংগ্রহ, মিনিয়েচার আর্ট, ক্যালিগ্রাফির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, পাঠাগারের জন্য সুদক্ষ লিপিকার নিয়োগ এবং একটি পৃথক স্টুডিও যুক্ত করেন।  ছাপার যুগ ছিলো না বলে আকবর স্বউদ্যোগে উন্নত কাগজ, বই-এর আলঙ্কারিক, বাঁধাইকারী বা দপতুরি সমেত একটি জোরালো প্রতিষ্ঠান গড়েন পাঠাগারকে কেন্দ্র করে এবং এর শ্রীবৃদ্ধির জন্য। তিনি উচ্চ পদমর্যাদাসম্পন্ন একজন মনসবদারকে পাঠাগারের অধ্যক্ষ বহাল করেন। তার বেতন ছিলো তৎকালীন চার হাজার টাকা। লিপিকার নকল করত, আলঙ্কারিক অক্ষরে আর চিত্রকর লেখার ভাব অনুসারে আঁকত, বাঁধাই হতো উচ্চমানের চামড়া দিয়ে, প্রচ্ছদে নকশা কাটা হতো। সেসব বইকে একটা ক্যাটালগে লিপিবদ্ধ করে পাঠাগারে এক বা একাধিক কপি সংরক্ষণ করা হতো। আবুল ফজলের হিসাবে সম্রাট আকবরের পাঠাগারে হাতে লেখা চব্বিশ হাজারের মতো পুস্তকের সংগ্রহ ছিলো। এর মধ্যে ধর্ম, দর্শন, বিশেষ করে আরবিতে অনূদিত গ্রিক দর্শন, ইতিহাস, কাব্য, সাহিত্য, আত্মজীবনী, রোজনামচা এবং কিছু চিকিৎসা বিজ্ঞান ও প্রকৃতি বিজ্ঞানের গ্রন্থ ছিলো। আকবর সংস্কৃত ভাষায় মহাভারত, রামায়ণ সংগ্রহের সঙ্গে সঙ্গে এসব গ্রন্থের ফারসি অনুবাদও সংরক্ষণ করেন। এই তর্জমার মাধ্যমে আকবর হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থকে মুসলমানদের কাছে পরিচিত করেন। আবার আরবি দর্শন চর্চার মধ্যে ইমাম গাজালি বা ইবনে সিনার দর্শন উপমহাদেশে পরিচিত হওয়ার ব্যবস্থা করেন। পাশাপাশি গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল এবং গেলেন প্রভৃতি চিকিৎসা বিজ্ঞানীর গ্রন্থরাজি স্থানীয় ভাষায় পাঠের ব্যবস্থা করে দিয়ে দর্শন ও চিকিৎসা বিজ্ঞান চর্চার গোড়াপত্তন করেন। আকবর পর্তুগিজ পাদ্রিদের দ্বারা ফারসি ভাষায় বাইবেল এবং রোম সাম্রাজ্যের ইতিহাসও অনুবাদ করান।  

যেসব গ্রন্থ পাঠে আকবর আনন্দ পেতেন, সেসব প্রিয় পাঠ্য তালিকায় স্থান পেয়েছে ইমাম গাজালির কিমিয়ায়ে সাদত, শেখ সাদির গুলিস্তা, বোস্তান, হাফিজের দেওয়ান, আমির খসরুর কাব্য এবং ভারতীয় মহাকাব্যদ্বয়- মহাভারত ও রামায়ণ।  

আকবর নিরক্ষরদের জন্য দ্রুত ও নতুন শিক্ষাদানের ব্যবস্থা স্বরূপ ‘তিন সপ্তাহে শিক্ষিত’ করার একটি পাঠ্যক্রম চালু করেন। আকবর নির্দেশ দেন: প্রত্যেক বালকের পক্ষে নীতিকথা, অঙ্ক, কৃষি, যুক্তিবিদ্যা, শরীরচর্চা, জ্যোতিষ বিদ্যা, গার্হস্থ্য বিদ্যা, রাজনীতি, চিকিৎসা, পদার্থ বিদ্যা, রসায়ন শাস্ত্র ও ইতিহাস জ্ঞানের মৌলিক বিষয়বস্তু শিক্ষা নিতে হবে।
 
মুঘল পরম্পরায় গ্রন্থাকার ক্রমে ক্রমে পরিবৃদ্ধি লাভ করতে করতে শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের আমলে বিশ্বের অমূল্য জ্ঞানভাণ্ডারে পরিণত হয়। কিন্তু বাহাদুর শাহ প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ বা সিপাহী বিদ্রোহ শেষে পরাজিত হলে এই মহামূল্য সম্পদ আরও অনেক সম্পদের সঙ্গে ইংরেজ সৈন্যদের দ্বারা লুণ্ঠিত ও বিনষ্ট হয়। লুণ্ঠিত পাঠাগারের অনেক অসামান্য গ্রন্থ ও বিরল চিত্রকলা ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন যাদুঘর ও ব্যক্তিগত সংগ্রাহকদের হাতে চলে যায়। বিদগ্ধ মুঘল নারী জাহানারা ও জেবুন্নিসার ব্যক্তিগত সমৃদ্ধ পাঠাগার এবং মহান কবি মির্যা আসাদুল্লাহ গালিবের পাঠাগারটিও ১৮৫৭ সালে লুণ্ঠিত হয়।  

বাবর-হুমাযুন প্রতিষ্ঠিত এবং আকবর প্রমুখ কর্তৃক সঞ্জীবিত মুঘল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক গৌরবময় ও ঐতিহ্যবাহী পরম্পরার এহেন মর্মান্তিক-কাপুরুষোচিত বিনাশ শুধু ভারত বা উপমহাদেশেরই নয়, সমগ্র বিশ্বসভ্যতার অমূল্য ভাণ্ডারের প্রভুত ক্ষতি সাধন করেছে। ১৬০৫ সালের ২৬ অক্টোবর আকবরের মৃত্যুর পর দেশের অবস্থা কেমন হয়েছিল, তা ফারগাস নিকল, শাহজাহান: দ্য রাইজ অ্যান্ড ফল অব দ্য মুঘল এম্পায়ার গ্রন্থে জৌনপুরের একজন জৈন ধর্মাবলম্বী প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় উল্লেখ করেছেন: ‘আকবরের অবর্তমানে দেশে গভীর আতঙ্ক দেখা দেয়। নিরাপত্তার স্থায়িত্ব সম্পর্কে সন্দেহ তৈরি হয়। জাহাঙ্গীর নাম ধারণ করে যুবরাজ সেলিম সিংহাসনে বসেন। তিনি আকবরের ধর্মীয় সহিষ্ণুতার নীতি পুনপ্রবর্তন করেন। চিশতি পরিবারের সুফি সাধকদের প্রতি রাজপরিবারের উৎসাহ বজায় রাখেন। তিনি আকবর প্রবর্তিত সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় বহুত্ববাদ অটুট রাখেন’।

আকবরের পর সম্রাট জাহাঙ্গীর অমিতাচার আত্মরতির মৌতাতে ডুবে থাকার ফাঁকেও ভুলে যাননি মুঘল সাংস্কৃতিক পরম্পরার ঐতিহ্যানুযায়ী ভারতের হাতে নিজের দু’টি স্মরণীয় উপহার তুলে দিতে। প্রথমটি তার আত্মচরিত সম্রাট জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনী বা তুজকে জাহাঙ্গিরী আর দ্বিতীয়টি তারই নির্দেশে এবং স্বতোৎসারিত আগ্রহে শিল্পীর তুলিতে আঁকা ভারতীয় জীবজন্তুর অ্যালবাম, পরে যেটি বিশ্বখ্যাত ‘মুঘল মিনিয়েচার আর্ট’ ঘরানা নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। ব্যক্তিগতভাবে জাহাঙ্গীর অপরাপর মুঘল সম্রাটদের চেয়ে নানাদিক থেকে ব্যতিক্রমী। তিনি ছিলেন বিলাসী, সুরুচিবান, প্রথম তামাকসেবী সম্রাট। আকবরের শেষ জীবনের একমাত্র জীবিত সন্তানরূপে জাহাঙ্গীর আদর্শ মুঘল প্রিন্সের জীবনযাপন করেন। তার সিংহাসনপ্রাপ্তিও ঘটে বেশ দেরিতে, চল্লিশোর্ধ বয়সে। তার যৌবনকাল কেটেছে কাব্য, সাহিত্য, চিত্রকলা, সঙ্গীত চর্চা, বিশেষত হিন্দি ভজন, নাচগান, শিকার, শরাব-কাবাব ও নৃত্যগীতের লীলা-লাস্যের মধ্য দিয়ে।

মুঘল পরম্পরার ঐতিহ্যানুযায়ী সম্রাট জাহাঙ্গীর চিত্রকলার পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াও ফুল আর সুগন্ধির ভক্ত ছিলেন। তারই প্রণোদনায় সম্রাজ্ঞী নূরজাহান গোলাপের আতর আবিষ্কার করেন।
 
চিত্রকলায় জাহাঙ্গীরের অবদান প্রবাদপ্রতীম। মুঘল চিত্রকলা, যা মিনিয়েচার আর্ট নামে বিশ্বখ্যাত, তা প্রখর ব্যক্তিসত্তাবোধসম্পন্ন প্রতিকৃতি বা পোট্রেট চিত্রাঙ্কনের একটি আধুনিক ঘরানারূপে তৎকালীন জগতে বিস্ময়ের উদ্রেগ করে। ব্যক্তিত্ব ছাড়াও জীবনযাত্রা আর সমাজের বাস্তব দিক প্রতিফলিত হয় এতে। উপমহাদেশের অজন্তা গুহাচিত্র শিল্পের হাজার বছর পর মুঘলরা আবার ভারতীয় চিত্রকলাকে প্রবল নিরীক্ষার মাধ্যমে শ্রেষ্ঠরূপ দান করে আন্তর্জাতিক সম্ভ্রমের স্থরে পৌঁছে দেন।  

বস্তুতপক্ষে, চৈনিক চিত্রকলার শৈলী আফগানিস্তানের হিরাত অঞ্চলের বেহজাদ নামক চিত্রশিল্পীর হাতে স্থানীয় উপাদানের সংমিশ্রণে এক স্বাধীন, স্বতন্ত্র ও অপূর্ব শিল্পরূপ পরিগ্রহ করে। প্রাথমিক অবস্থায় বাদশাহ হুমায়ুন তার নির্বাসিত জীবনে এই চিত্রকলার সংস্পর্শে আসেন। আকবরের রাজসভায় এই শিল্পের প্রাতিষ্ঠানিক সূচনা ঘটে। জাহাঙ্গীরের রাজত্বকাল মুঘল চিত্রকলার উৎকর্ষের যুগ। সম্রাট স্বয়ং ছিলেন চিত্ররসিক, প্রকৃতিপ্রেমিক ও পক্ষী পর্যবেক্ষক। শৈলবিহারী জাহাঙ্গীর কাশ্মীর ভ্রমণের সময় কেবল শিকারী নয়, একদল চিত্রকরকেও সঙ্গে নিয়ে যেতেন। কোনো জীবজন্তু, পাখি ও ফুল সংগ্রহ করলে সঙ্গে সঙ্গে চিত্রকর দিয়ে আঁকিয়ে নিতেন। চিত্রসংক্রান্ত বিষয়ের গুরুত্ব সম্রাটের কাছে এতোটাই ছিল যে, চিত্রশিল্পীদের রাজপ্রাসাদের আবাসিক এলাকায় বসবাসের সুযোগ দেওয়া ছাড়াও উচ্চবৃত্তি ও খেতাব দিয়ে মর্যদাবান করা হয়। জাহাঙ্গীরের শিল্পজ্ঞান ও শিল্পবোধ ছিলো প্রখর এবং উচ্চাঙ্গের। একটা চিত্রশিল্পকর্মে যদি একাধিক শিল্পীর সমবেত কাজ থাকত, তাহলে তিনি কোনো অংশটি কার, সেটা অভ্রান্তভাবে বলে দিতে পারতেন। আন্তর্জাতিক চিত্রকলা সম্পর্কেও তার সজাগ নজর ছিলো। তিনি রেমব্রান্ট ও ইংরেজ চিত্রশিল্পীদের শিল্পকর্মের প্রতিও আগ্রহ প্রদর্শন করেন। জাহাঙ্গীরের নির্দেশে মুঘল চিত্রসমূহ উচ্চমানের কাগজে এবং গজদন্তের সূহ্ম পাতেও আঁকা হতো। বাঁধাই করা হতো শৈল্পিকভাবেÑসোনারূপা, মণিমুক্তার কারুকার্য করা ফ্রেমে। ইউরোপের বিখ্যাত সম্রাজ্ঞী মারিয়া থেরেসা তার একটি বিলাস কক্ষে সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে অঙ্কিত ষাটটিরও বেশি মুঘল চিত্র দিয়ে সাজিয়েছিলেন। ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট ভবনের অলিন্দে একটি সুবৃহৎ তৈলচিত্র রয়েছে, যেখানে রাজা জেমসের দূত স্যার টমাস রো তাঁর পরিচয়পত্র সম্রাট জাহাঙ্গীরের নিকট পেশ করছেন।

বিশেষজ্ঞরা চিত্রকলার ক্ষেত্রে জাহাঙ্গীরের অবদানকে অপরাপর মুঘল নৃপতির চেয়ে উপরে স্থান দিয়েছেন। বলা হয়, চিত্রকলার ব্যাপারে তিনি ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন সমগ্র তৈমুর-তাতার-মোঙ্গল ট্র্যাডিশনকে। পারস্যের নাদির শাহের ভারত হামলাজনিত লুটপাটের সময় সম্রাট জাহাঙ্গীরের সুবিখ্যাত সুরৎখানার অসামান্য চিত্রশিল্পচিহ্নরাজি তছনছ হয়ে যায়। পরে এগুলোর কিছুকিছু নানা হাত ঘুরে বিশ্বের বিভিন্ন সংগ্রহশালা ও যাদুঘরে স্থান পায়।  

চিত্রশিল্প ছাড়াও সম্রাট জাহাঙ্গীরের ছিলো এন্টিকপ্রীতি। সমকালের বিবেচনায় প্রাচীন ও আধুনিক রুচিসম্পন্ন অভিনব দ্রব্যসামগ্রীর সমঝদার ছিলেন তিনি। তার সংগ্রহের মধ্যে ছিলো ইউরোপীয় বণিকদের নানা উপঢৌকন, ঘড়ি, চিত্রকলা, শিল্পকর্ম, আরশি, মিঙযুগের চীনের তৈজসপত্র, পশ্চিম এশিয়ার অস্ত্র ইত্যাদি। জাহাঙ্গীর তার রাজপ্রাসাদে ‘চীনা মহল’ নামে একটি পৃথক চীনে মাটির সৌখিন পাত্রের দফতর স্থাপন করেন। সেখানে তৎকালের বিবেচনায় অত্যাধুনিক রকক্রিস্টাল কাটগ্লাসের সামগ্রী ছিলো। জাহাঙ্গীরের সংগ্রহের মধ্যে আরও ছিলো আইরিশ গ্রেহাউন্ড, ইংলিশ বুলডগ, ওয়াটার স্পেনিয়াম প্রভৃতি উঁচু জাতের কুকুর, বাফকোট হানটিং ব্রিচেস গালার কাজ করা জাপানি পাল্কি, মধ্যপ্রাচ্যের তামার কারুকার্য করা শামাদান, শিকারের ইউরোপীয় পোশাক ইত্যাদি। জাহাঙ্গীর সোনার বাঁশি পেয়ে মুগ্ধ কৌতুহলে আধ ঘণ্টা ধরে তা বাজাতে থাকেন। পর্যটক তাভেনিয়ন তার ভ্রমণ কাহিনীতে সম্রাট জাহাঙ্গীরের উপঢৌকন সংক্রান্ত তথ্য জানিয়েছেন: ‘নবাব পুত্রকে উপহার দিলাম সোনার জলে মীনেকরা বাক্সে একটি ঘড়ি, রৌপ্যখচিত একজোড়া ছোট পিস্তল, অতি সুন্দর একখানা ম্যাগনিফাইং গ্লাস। সম্রাটকে আমি আরও দিয়েছিলাম স্ফটিক পাথরের যুদ্ধ-কুঠার, তাতে কিনারায় খচিত ছিলো চুণী ও মরকত মণি। স্ফটিকের উপরে ছিলো স্বর্ণাবরণ। তাকে আরও যা দেওয়া হয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তুর্কি রীতিতে তৈরি একটি ঘোড়ার জীণ। সেটার গায়ে ছিলো ছোট ছোট চুণী, মুক্তাবালী ও হীরার অলঙ্করণ’। ইংরেজ দূত স্যার টমাস রো সম্রাট জাহাঙ্গীরকে বিখ্যাত ল্যান্ডো গাড়ি উপহার দেন, যা তিনি নূরজাহানের বিবাহ বার্ষিকীতে ব্যবহার করার মাধ্যমে উপমহাদেশের ইতিহাসে প্রথম মোটর গাড়ি ব্যবহারকারীর সম্মান লাভ করেন।  

পরবর্তীতে শাহজাহান এক তাজমহলের কারণেই বিশ্ববিখ্যাত হয়েছেন। শৈল্পিক বোধের জন্য রবীন্দ্রনাথ থাকে ‘কবি’র মর্যাদা দিয়েছেন। মুঘল সম্রাটদের ধন-ঐশ্বর্য কিংবদন্তীর অংশ--এই খ্যাতির প্রকৃত ঐতিহাসিক মূল্য সম্পদের রুচিশীল-সুকুমার ব্যবহার এবং দক্ষ আর্থনৈতিক-প্রশাসনিক গুণের মধ্যে নিহিত। মুঘলরা সম্পদেকে শিল্পকলা-নন্দনকলার মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক উপযোগিতার ভিত্তিতে আনন্দের সামগ্রীতে রূপান্তরিত করে যে প্রাগ্রসর সৃজনী মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন, সেটাকে ‘আভিজাত্যের দ্যুতি’ বলা যায়। এমনকি, দায়িত্বশীল জীবনের শেষে অবসর কালকেও তারা সুষমামণ্ডিত করেছেন। ফলে দৈনন্দিন কর্মবহুল বসবাসকে ‘জীবনশিল্প’ আর অবকাশ বিনোদনকে ‘সৃজনশীল-রুচিসম্মত’ সাংস্কৃতিক উৎকর্ষতার স্তরে উত্তীর্ণ গিয়ে তারা সম্পদের খরচের দিকে তাকাননি-- তাকিয়েছেন সৌন্দর্য, সুষমা আর আনন্দকে।
আলমগীর-আওরঙ্গজেব অমর হয়ে আছেন ইসলাম ধর্মের আইন ও বিধি-বিধানের কাঠামোগত বিন্যাসের কৃতিত্বে। পঞ্চাশ খণ্ডের সুবিশাল ও সুবিখ্যাত ধর্মীয় আইন গ্রন্থ ফতোয়া-ই-আলমগিরি সে স্বাক্ষ্য বহন করছে। সম্রাট আওরঙ্গজেব নিজে ছিলেন প্রগাঢ় জ্ঞানের অধিকারী এবং জ্ঞানী-গুণী সমাদরও তিনি অকুণ্ঠ চিত্তে করতেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের গ্রন্থাবলী ছিলো তার নিত্যদিনের সহচর। অতীতের জ্ঞান ভাণ্ডার থেকে তিনি সযতেœ আহরণ করতেন মুক্তা-মাণিক্য। ধর্মীয় গ্রন্থাদি ছিলো তার বিশেষ প্রিয়। মেশকাত শরিফ, সিয়াহ সেত্তাহ, ইলমে মারেফতের উপর লেখা গ্রন্থাবলী, ইসলামী দর্শনের গৌরবমুকুট আল্লামা গাযালী (রহ.)-এর ‘ইয়াহ ইয়াউল উলুমুদ্দিন’, ‘কিমিয়ায়ে সা’দত’ প্রভৃতিগ্রন্থ পড়ে তিনি অগাধ জ্ঞান সঞ্চয় করেন। সে জ্ঞান ছিলো তার জীবন পথের পাথেয়। সেই জ্ঞানের ভিতের ওপর গড়ে ওঠেছিল তার ধর্মজীবন ও কর্মজীবন। জ্ঞান ও শক্তির দ্বারাই তিনি সবচেয়ে বেশি দিন ক্ষমতায় ছিলেন এবং রাজ্য সীমাকে আফগানিস্তান থেকে বার্মা পর্যন্ত বিস্তার করেছিলেন। ফারসি গদ্যসাহিত্যে সম্রাট আওরঙ্গজেব ছিলেন একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠিত সুলেখক। সেকালের বিখ্যাত সাহিত্যিকদের মধ্যে তার স্থান ছিল অনেক উচ্চে। তার বর্ণনাভঙ্গির সংযম তাকে অনন্য গৌরবের অধিকারী করে। তিনি তার রচিত পত্রাবলীতে যে প্রতিভার ছাপ রেখে গেছেন, তা ইতিহাস, রাষ্ট্রনীতি, ধর্মতত্ত্ব ও ফারসি সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। তার পত্রাবলী ‘রোকাত আলমগীরি’ আজও জনপ্রিয়তা হারায়নি। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় প্রথম বাংলায় অনুবাদ করেন। পরে আরও অনেকেই অনুবাদ করেছেন।

ইসলামের সঠিক বিধি-বিধান অনুসারে বিশাল মুঘল সাম্রাজ্যের শাসন ও শৃঙ্খলা সুনিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে তিনি ইরান, তুরান ও হিন্দুস্তানের মশহুর আলেমদের নিয়ে ফেকাহ শাস্ত্রের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থাবলী পর্যালোচনা করে সমসাময়িকতার ভিত্তিতে সঙ্কলন ও সম্পাদনা করেন অবিস্মরণীয় গ্রন্থ ‘ফাতাওয়ায়ে আলমগীরি’। এটি বর্তমান কালেও ব্যবহৃত বিশ্ববিখ্যাত মুসলিম আইন ও ফতোয়ার কিতাব। ব্যক্তিজীবন থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা, আহার-নিদ্রা থেকে সমাজ পরিচালনা ইত্যাদি সব বিষয় এ সুবিশাল গ্রন্থে রয়েছে। বাংলাসহ পৃথিবীর উল্লেখ্যযোগ্য ভাষায় এ গ্রন্থ অনূদিত হয়ে অনৃসৃত হচ্ছে। সুন্নি দেশগুলোর ফতোয়ার অন্যতম প্রধান গ্রন্থ। মাদ্রাসা শিক্ষা কার্যক্রমের অবশ্যপাঠ্য বিষয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলায় অনুবাদ করেছে। তবে প্রায়-প্রতিটি মাদ্রাসায়ই আরবি ভাষ্যের খণ্ডগুলো রয়েছে।

আওরঙ্গজেবের মত গোঁড়া শরিয়তপন্থী মুঘলও হাস্যরস বিমুখ ছিলেন না। কথিত আছে যে, তিনি যখন রাজদরবারে নৃত্যগীত নিষিদ্ধ করেন, সঙ্গীতশিল্পীরা তখন প্রতিবাদে বাদ্যযন্ত্রের এক শবযাত্রা বের করে সম্রাটের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালান এই বলে যে, তারা সঙ্গীতকে কবর দিতে নিয়ে যাচ্ছেন। শাস্ত্রনিষ্ঠ বাদশাহ গম্ভীরভাবে উত্তর দেন, ‘খুব ভালরূপে কবর দাও, যেন সঙ্গীতের রব কবর থেকে উঠে না আসে। ’

তিনি ছিলেন বহুভাষাবিদ। সংস্কৃত ভাষার সমঝদার। ফারসি গদ্যের মাস্টার। পুত্রকে লিখিত তার পত্রাবলী চেস্টারফিল্ডের পত্র কিংবা রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রের মত বিখ্যাত।  

বিক্রমশালী মোঘল পরম্পরার ক্ষীয়মাণ শেষ অধ্যায়ের সর্বশেষ প্রান্তে পাওয়া যায় এমন একজন হতভাগ্য শাসককে, যিনি ইতিহাসের নির্মম সাক্ষীরূপে বিশাল সাম্রাজ্যের যবনিকাপাত করতে বাধ্য হন এবং ঘটনাচক্রে তিনি ছিলেন একজন কবি, যদিও একই সময় মোগল সাংস্কৃতিক-বৃত্তে আরেকজন অনন্য-ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মহৎ কবির সন্ধান পাওয়া যায়, যার নাম মির্জা আসাদুল্লাহ গালিব। বিশাল সাম্রাজ্যের মতোই তাদের ছিলো সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার। শুধু রাজন্যই নয়, মুঘল নারীদেরও নিজস্ব গ্রন্থাগার ছিলো। যে কারণে তারা কাব্যচর্চা, আত্মচরিত রচনা, দর্শনসহ বিভিন্ন বিষয়ে মূল্যবান রচনা উপহার দিয়ে গেছেন। মুঘল ক্ষমতার অন্যতম ভাগীদার দারাশিকোহ ক্ষমতা না পেয়েও বিখ্যাত হয়ে আছেন ধ্রুপদী ভারতীয় মহাকাব্য ও গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থসমূহের ফারসি অনুবাদের জন্য। ফলে মুঘলরা কেবল ক্ষমতার জগতেই বাস করতেন না; জীবন-যাপন করতেন গ্রন্থভুবনে, শৈল্পিক জগতে। ব্রিটিশ উপনিবেশিক আক্রমণে যে ঐতিহ্যের জগত লণ্ডভণ্ড ও লুটপাটের মাধ্যমে ধ্বংস করা হয়। বিশ্ব হারায় সৃজনশীল মেধা-সম্পদ।

বাংলাদেশ সময়: ১৩০৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৮, ২০১৭
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।