ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

এই সময়ের গল্প-২০

বাঁশি | হুমায়ূন শফিক

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬১৮ ঘণ্টা, আগস্ট ২০, ২০১৭
বাঁশি | হুমায়ূন শফিক বাঁশি | হুমায়ূন শফিক

লোকটার নাম হামিদ, হ্যাঁ আব্দুল হামিদ। তার দাদা মধুর কণ্ঠে তাকে ডাকত। দাদা মরে যাওয়ার পরে কেউ তাকে আব্দুল হামিদ বলে ডাকে না। সবাই শুধু হামিদ বলে ডাকে। লোকটার দুঃখ এটাই।

তার সম্পূর্ণ নাম ধরে কেউ কেন ডাকে না, ঠিক তার দাদার মতো। তাই সে মনের দুঃখে একদিন একটা বাঁশি কিনে আনল।

বাঁশি সে বাজাতে পারে না। তবে শিখে নিতে কতক্ষণ। বাঁশির সারেগামা শিখে নিলেই বাজানো যাবে বলে তার ধারণা।

পশ্চিম আকাশে সূর্য যখন হেলে পড়ে রক্তবর্ণ ধারণ করেছে, তখন সে বেড়িবাঁধের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে সুনজিৎ সরকারের নিকট যাচ্ছে। সূর্যের এতো রুপ, তবু দেখার প্রয়োজনবোধ করছে না। সূর্যের তেজ তাকে খুব একটা পছন্দ করে বলে মনেও হয় না। তখন আলতো বাতাস তার শরীর-মনকে শান্ত করে দিচ্ছে। নামের ব্যাপারটা ভুলে থাকার জন্যই, সে বাঁশি বাজানো শিখবে বলে পণ করেছে। যেকোন মূল্যে তাকে শিখতেই হবে।

বেড়িবাঁধের নিচেই একটি মন্দির। মন্দিরটি বাঁধাই করা। অনেকগুলো সিঁড়ি পার হয়ে মন্দিরে উঠতে হয়। সিঁড়িগুলোতে রঙ করা, লাল রঙ। সাথে সবুজ রঙও আছে। লাল-সবুজের খেলা। ফোনে সে সুনজিৎ সরকারকে বলেছিল, দাদা, আপনার কাছে বাঁশি বাজানো শিখব। শেখাবেন?

চলে আসো। কেন শেখাব না?

কোথায় আসব, বলুন?   

আমাদের মন্দিরে।

আচ্ছা। আজ বিকালেই আসব। বলে সে ফোন কেটে দিয়েছিল।

মন্দিরের সিঁড়িগুলো তার মনকে আকর্ষণ করল। সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে দেখতে পেল, সুনজিৎ সরকারকে। সে একমনে বসে বসে আকাশে কী যেনো খুজছে? হয়তো সুর।

সে নিচ থেকেই ডাকল, দাদা। চলে এসেছি।

ঠিক সময়েই এসেছ, তাড়াতাড়ি উপরে ওঠো। জুতা খুলে খালি পায়ে সে হালকা উত্তপ্ত সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে উঠছে। মন্দিরের ভিতর থেকে চেয়ে আছে কালি মা। তার জিহ্বা বের করা। হাতে কাটা মস্তক।

পাশাপাশি বসে, সে বলল, দাদা, বাঁশি আমাকে শিখতেই হবে।

শিখবে। কিন্তু সে তো সাধনার জিনিস। পারবে তো?

পারব।

তার আগে তোমাকে সুর চিনতে হবে।

কীভাবে?

চুপ করে বসে থাক। চার-পাশের শব্দ শোনো মনোযোগ দিয়ে। দেখ, সেখানে কোন সুর খুঁজে পাও কিনা?

আব্দুল হামিদ চুপ করে বসে বসে শুনল, পাশেই বাঁশঝাড়, বাতাসে বাঁশ পাতার সংঘর্ষে খচমচ খচমচ আওয়াজ। একজন গৃহিণী পুকুর থেকে রান্নার পানি নিয়ে যাওয়ার সময় কিছুটা পানি ঝাকি দিয়ে পানিতেই ফেলে দিলো, সেই পানিতে পানি পড়ার শব্দও সে শুনতে পেল। একটা পাখি ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে চলে যাচ্ছে, সেই সুর। তাদের নিঃশ্বাসের শব্দ। মানুষের কথাবার্তার শব্দ। এমনকি ডাহুক পাখির গলার আওয়াজও তখন পেল।

দাদা।

সে তার মুখে আঙুল চেপে ধরল। আস্তে করে বলল, ভিতরের সুর শুনতে হবে। আমরা সুরের কাঙাল।

সে এবার চোখ দু’টো বন্ধ করে সবকিছু শোনার চেষ্টা করল।

শুনতে পেল বাতাসের মধুর সুর। দেয়ালের সাথে বাতাস ধাক্কা লেগে যে শব্দ হয়, সেটা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলো। এমন সুর বা শব্দ যাই বলুন না কেন সে কখনও শোনেনি। আশ্চর্য! নিজের বুক ওঠা-নামার ফলেও একটা মৃদ গুঞ্জন হয়। চারপাশের সবকিছু যেনো তাকে সুর দিতে উঠে-পড়ে লেগে গেলো। প্রত্যেকটা বস্তু থেকে সুর পেলো। কোনো কোনো সুর অতি-সুমধুর, কোনো কোনোটি হয়তো কেউ কখনও শোনেওনি।

তুমি আজ চলে যাও। কাল আবার আসবে।

চোখ খুলে দেখল। ইতোমধ্যে অন্ধকারে ছেয়ে গেছে সারা পৃথিবী। গাছ-পালায় পাখিরা হয়তো ফিরে এসে কলরব করছে। মনটা তার আনন্দে ভরে গেলো। সে যা শোনে সবই যেনো সুর হয়ে ধরা দিচ্ছে তার নিকট।

আজ কিছু তো শিখলাম না।

তোমার ট্রেনিং শুরু হয়ে গেছে। যাও।

ধীরে সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় নিজের প্রত্যেকটা পদক্ষেপের শব্দ শুনতে পেল। যখন চটিটা পায়ে দেবে, তখনও মৃদু একটা শব্দ তার কানে এসে আঘাত করল। শব্দ মৃদু কিন্তু আঘাত প্রচণ্ড। জীবনকে সুর দিয়ে পরিবর্তন করতে হবে, সে ভাবল। নাম দিয়ে শুধু শুধু ভাবছিলাম, নিজে নিজেই হাসল। আগে কেন সুর শিখতে চায়নি। বেড়িবাঁধের দিকে হাঁটতে লাগল। প্রত্যেক পদশব্দ তার কানে এসে বাড়ি মারছে। যেনো ঝাপটা বাতাস এসে কানে লাগছে। ঝড় বইছে। সুরের ঝড়। সে ঝড় কি থামবে?

বাড়িতে পৌঁছে নিজের ঘরে প্রবেশ করল। খাওয়া-দাওয়ার কথা একদম ভুলে গেলো, তার মা তাকে ডাকতে এসে বলল, কিরে বাবা খাবি না?

না, মা ক্ষুধা নাই। তুমি খাও।

কী, বলছিস? ক্ষিধা নাই ক্যান? খাইছোস কিছু?

হু। এইটুকু বলল। তার মা চলে গেলো। সে বাঁশিতে ফুঁ দেবে কিনা ভাবছে। সুনজিৎ সরকার তো তাকে কিছু বলে দেয়নি। না, থাক। খাটের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে সুর শোনার চেষ্টা করল, চারপাশের। রাত্রি প্রায় ১০টা। গ্রামের জন্য মধ্যরাত। টিনের ঘরের উপর কাঁঠাল গাছের পাতা লেগে ঘষঘষ আওয়াজ করছে। হঠাৎ করে কেউ টিউবওয়েলে থেকে পানি তোলা শুরু করল, সেই শব্দও সুরে পরিণত হয়ে তার কানে ধরা দিলো। দরজা খোলার ধুপধাপ শব্দ। খটর-মটর শব্দ। কাঠ-পোকাগুলো কাঠ কাটছে ‘ট্যাট ট্যাট’ শব্দ করে। বাতাস ঢুকছে জানালার ফাঁক-ফোকর দিয়ে সেই মৃদু ধ্বনি, শা শা শব্দ, তবে এই শব্দ অনেক ধীর। যেমন শুধু শা শব্দটা যদি একবার শব্দে পরিণত হতে পাঁচ সেকেন্ডে সময় নেয় যেরকম শোনাবে তেমনভাবে বাতাস শা….শব্দ করে ঘরের ভিতরে ঢুকছে। ঠিকরে ঠিকরে কেউ কাঁদছে, সেই সুরও শুনতে পেলো। একেকটা সুর একেক রকম। প্রত্যেকটার চরিত্র ভিন্ন। একটা মানুষের সাথে যেমন আরেকটা মানুষের মিল নেই, তেমনি সুরগুলো আলাদা আলাদা। সব যখন মিলে-মিশে একাকার হয়ে যায়, তখন সৃষ্টি এমন মোহনীয় সুর, যে সুরে পাগল হয়ে মৃত ব্যক্তিও জিন্দা হতে পারে।

‘‘সুরের তালে তালে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, বলতে পারব না। প্রত্যেকদিনের মতো রাতের বেলা যতোটুকু সময় ফেসবুকে অ্যাক্টিভ থাকি, আজ ফেসবুকে ঢোকার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। যখন গভীর ঘুমে পৃথিবী আচ্ছন্ন, তখন আমিও ঘুমের গভীরে। পৃথিবীর মানুষগুলো এখন হয়তো স্বপ্ন দেখছে, তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিয়ে। কেউ কেউ অচেনা যুবতীর সাথে স্বপ্নে সেক্স করায় ব্যস্ত। কিন্তু আমার স্বপ্ন সম্পূর্ণ ভিন্ন। সুরকে দেখছি। সুর কি দেখা যায়, না যায় না। অনুভব করা যায় মাত্র। তবে স্বপ্নে আমি স্পষ্ট দেখলাম, সুর আমার নিকট এসে আমার কানের সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হচ্ছে। ’’

হামিদ, ওঠ, হামিদ, ওঠ। মা সকালের বিরুক্তিকর কণ্ঠে ডাকলেন। সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।

উঠছি, মা। তার কণ্ঠটা কিছুটা ভারী শোনাল। শরীরে এক ধরণের পূর্ণতা লক্ষ্য করল। ধীরে ধীরে উঠে বসে, চোখ দু’টো কচলাতে কচলাতে মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে, তার মুখে হাসি। বহুদিন মায়ের মুখে খুব একটা হাসি দেখেনি। মাঝে মাঝে তিনি হাসেন, তখন তার কাছে মনে হয় স্বর্গে আছে।

তাড়াতাড়ি করতো। খাবি না।

এতো সকালে কী খাব?

তুই হাত-মুখ ধো। তারপর আয়।

ঠিকাছে। বলে উঠে দাঁড়িয়ে সে চটি পরে নিলো। টয়লেটে ঢুকে আগে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে, দাঁত ব্রাশ করতে করতে কাঁঠাল গাছের নিচে দাঁড়ায়। সুর বিষয়ক ভাবনা ঘুম থেকে ওঠার পর, কিছুটা ভুলে গিয়েছিল। আবার সুর উঠল, দাঁত ব্রাশ করার সুর। হাত-মুখ ধুয়ে, খাবার ঘরে ঢুকে দেখে বাপজান তার আগেই বসে আছেন। খুব আগ্রহ নিয়ে বসে দেখে বিশাল এক আয়োজন, সকাল সকাল এতো খাবার দেখে পেট এমনিতেই ভরে গেলো। রোস্ট, গরুর মাংস, পোলাও, সুস্বাদু দই। আরও কয়েক রকমের ভর্তা-ভাজি। খাওয়া শেষ করল তৃপ্ততা নিয়ে। আঙুলসহ চেটে-পুটে খেয়ে ঢোক ঢোক শব্দ করে পানি পান করে, ঘর থেকে বের হয়ে বাঁশির নিকট গিয়ে হাত দিয়ে তুলে নিয়ে, বাঁশিতে ঠোঁট ঠেকিয়ে ফুঁ দিলো। একটা গুঞ্জন সৃষ্টি হয়ে বাজতে শুরু হলো। সুরটা খুবই পরিচিত। কিছুক্ষণ বাজানোর পর, দেখে মা এসে দাঁড়িয়েছেন, থামিয়ে দিলো বাজানো।

থামলি কেন? 

তুমি বিরক্ত হচ্ছ, তাই।

দূর, হাদা। সুন্দর হইতেছিল। বলে হাসলেন।

 

দাদা, আজও কি আসব? ফোনে সুনজিৎ সরকারকে জিজ্ঞেস করল।  

কেন আসবে না? তিনি উল্টো প্রশ্ন করলেন।

সেই মন্দিরে?

না, আজ তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাব।

কোথায়?

আসো, তখনই বলব।

ঠিকাছে, বলে সে ফোন কেটে দিলো। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে, একটা পাঞ্জাবি পরে, পকেটে বাঁশিটা পুরে বাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা বেড়িবাঁধের দিকে হাঁটা শুরু করল। বটতলায় দেখল, লোকজন হাসি-তামাশা করছে। মাঠে বাচ্চারা খেলছে। দূর থেকে তাদের দেখে খেলার লোভ সামলাল। প্রত্যেকদিন সে মাঠে খেলে, কিন্তু গতকাল থেকে খেলার ব্যাপারে সে উদাসীন।

বেড়িবাঁধে উঠতেই দেখে সুনজিৎ সরকার সিগারেট টানছে। ধোঁয়া যখন বের হচ্ছে, তখন গোল গোল বৃত্তের সৃষ্টি হয়ে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। ধোঁয়াগুলো মেঘের সাথে মিশে যাচ্ছে।

দাদা, চলে এসেছি। বলে হাসল।

চল, রওনা দেওয়া যাক। বলেই তিনি হাঁটা শুরু করলেন।

কোথায় যাব?

পদ্মার পাড়ে।

সে আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। তার পাশাপাশি হাঁটা শুরু করল। পায়ে পা মেলাতে মেলাতে অনেকটা পথ এগিয়ে গেলো তারা। ঘোষাইল বাজার থেকে পশ্চিমে একটি রাস্তা গেছে। সেই রাস্তা বরাবর হাঁটলেই পদ্মা। ইটের রাস্তা। এখানে-সেখানে ইট উঠে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।

দাদা, সুরতো আমাকে পাগল করে দেবে। বলে হাসল।

সুর! তুমি সুরের কাঙাল, সুর তোমাকে ছাড়বে কেন? এতোদিন বুঝতে পারোনি। এখন পেরেছ, এটাই তোমার পথ।

আব্দুল হামিদ আর কিছু বলল না। চিন্তার সাগরে ডুবে গেলো।

সামনেই পদ্মা। দু’জনে চোখে-চোখে তাকায়।

দাদা, চলে এলাম তো। এখন?

আজ আমরা এখানে রাত্রি-যাপন করব।

কথাটা শুনে কিছুটা হতবাক হলো সে। রাত্রি-যাপনের জন্য তাদের সঙ্গে কিছুই নেই। কীভাবে এইখানে থাকবে বা আত্মীয়-স্বজনও নেই।

কীভাবে?

ওই যে দেখ, স্টিমার। দূরে একটি স্টিমার দাঁড়িয়ে আছে। বিশাল বড়। পেটের দিকে চওড়া, দুই দিকে সরু। দেখতে পটলের মতো। স্টিমারের কাছে যেতেই লুঙ্গি পরা এক লোক এসে সুনজিৎ দাদাকে বলল, এতো দেরি করলেন। আমরা তো ছাইড়া চইলা যাইতাম, আরেকটু দেরি হইলে।

সুনজিৎ দাদা হাসলেন। চলুন ওঠা যাক। বলে লোকটার পিছু নিলেন। আব্দুল হামিদও লোকটার পিছু পিছু হাঁটছে। কাছাকাছি আসার পরই স্টিমারে ওঠার সিঁড়ি চোখে পড়ল। খাড়া সিঁড়ি। ধরার জন্য দুইপাশে রেলিং দেওয়া আছে, কিন্তু ওঠা যতোটা সহজ ভেবেছিল, ততো সহজে উঠতে পারল না। সারা শরীরের ভর দুই হাতে রেখে তারপর উঠতে হয়। সুনজিৎ সরকার ও লুঙ্গি পরা লোকটা নিমিষেই উঠে গেলো। কিন্তু হামিদের উঠতে ঘাম ছুটে গেলো। ওঠার পর, তার হৃদপিণ্ডর ওঠা-নামা বেড়ে গেলো।

এইটুকু উঠতেই এই অবস্থা। হাসলেন সুনজিৎ সরকার।

আব্দুল হামিদও হাসল। বলার কিছুই নেই। সুনজিৎ সরকার আবার একটা সিগারেট ধরিয়ে গোল গোল আকৃতির ধোঁয়া বের করছেন।

আমরা যাব কোথায়? সে বলল।

স্টিমার যেদিকে যায়, আজ তারা ফরিদপুরের দিকে যাবে, মাল আছে, সেখানে মাল পৌঁছে দিয়ে আগামী কাল ফেরত আসার চেষ্টা করবে।

বাড়িতে বলে আসা দরকার ছিলো।

ফোন করো।

বাড়িতে ফোন করতেই তার মা বলল, যেখানে যাবি যা, কিন্তু পরে কিছু হইলে আমার দোষ না। হেসে ফোনটা রেখে দিলো।

সন্ধ্যা হয় হয় করছে। অন্ধকার নেমে আসতে চাইছে। কিন্তু সূর্যের আলোতে ব্যর্থ হচ্ছে। তবে সূর্য যখন ডুব দিলো, তখন অন্ধকারের সাহস বেড়ে গেলো, কয়েকগুণ। সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারে চারপাশ ছেয়ে গেলো। হুট করেই যেন রাত নামল। পদ্মার পাড়ে এইরকমই হয়। চারপাশে সে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করল। পশ্চিম দিকে ঈষৎ লাল দেখা যাচ্ছে। অন্ধকারে ক্ষীণ আলোর রশ্মিকে মনে হয় জীবনের মতো।

হঠাৎ করেই কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলো চারপাশ। স্টিমারের একটা কক্ষে গুটি-সুটি মেরে বসে আছে হামিদ। কুয়াশা কিল-বিল করে ঢুকে পড়ছে সেই কক্ষে। সুনজিৎ সরকার ও লুঙ্গি পরা লোকটা আরামে সিগারেট টানছে। স্টিমারের আরও পাঁচজন লোক আছে, তারা বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত।  

দাদা, আমরা ফরিদপুর গিয়ে কী করব?

কিছু করব না, আমাদের কাজ এই পদ্মা নদীতে। তুমি আরেকটু পরে মনোযোগ দিয়ে চারপাশের ধ্বনিগুলো শুনতে থাকবে। সুর পাবে, ভাই।

নদীতে সুর পাব?

সে হাসল, হ্যাঁ, পাবে। এখন বাঁশিতে ফুঁ দাও তো দেখি কেমন বাজাতে শিখেছ।

একদিনের ট্রেনিংয়ে আবার কেমন হবে।

তবু, বাজাও।

সে বাঁশিটা বের করল। বাম হাতের তিন আঙুল ও ডান হাতের তিন আঙুল দিয়ে ছয়টি ছিদ্র চেপে ধরল। সপ্তমটিতে ঠোঁট লাগাল। সঙ্গে সঙ্গে অতি-মধুর একটি সুর বেজে উঠল। লুঙ্গি-পরা লোকটি ও সুনজিৎ সরকার মনোযোগ দিয়ে শুনল। চারপাশ এতোটা সুনসান যে মনোযোগ না দিয়ে উপায়ও নেই।

কিছুক্ষণ পরে বাজানো থামিয়ে দিলো। ঠোট থেকে বাঁশিটা সরাল। তার হাত-পা তিরতির করে কাঁপছে।

বাহ! বাহ! তুমি দারুণ বাজালে ভাই। তোমার ভিতরেই ঈশ্বরের সুর আছে। এতোদিন তুমি বুঝতে পারোনি কেন?

সে কিছু বলল না। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখল সুনজিৎ সরকারের উজ্জ্বল মুখখানা।

কিছুক্ষণ সবাই চুপ থেকে আব্দুল হামিদ বলে উঠল, আচ্ছা, দাদা, এই বাঁশির সৃষ্টি কীভাবে?

লম্বা ইতিহাস। সে হেসে বলল। আমরা তো তেমন গবেষণা করি না, তবে অনেক প্রাচীন সংস্কৃতিতে বাঁশির মতো সরল যন্ত্রের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। সেগুলোকে ধরা হয়, মিশর, গ্রিস ও ভারতের। তাছাড়া চীনেও বাঁশির প্রচলন ছিলো।

বাঁশি তো আজকের না। অনেক জীবন কাহিনীর সঙ্গে বাঁশির সম্পর্ক রয়েছে।

হ্যাঁ, তা আছে। কৃষ্ণ ও রাধার প্রেম কাহিনীর সাথে বাঁশি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

বাঁশির কি ক্ষমতা আছে?

সুর। সুরই হচ্ছে একমাত্র ক্ষমতা। তুমি যদি সেই সুরের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারো, তাহলে দেখবে সুরের জাদুতে কী হতে পারে!

আচ্ছা, দাদা, মৃত্যুর কোনো সুর কী আছে?

এ বড়ই কঠিন প্রশ্ন। মৃত ব্যক্তি ফিরে আসে না। তাহলে জানা যেত।

তবু?

তবু কী?

আপনি এই ব্যাপারে কিছুই জানেন না?

মৃত্যুর সুর থাকতে পারে। সে সুর শুনলে হয়তো লোকজন বোঝে তার মৃত্যু সন্নিকটে, তখন হয়তো তার বলার ক্ষমতা আর থাকে না।

আমি একটি সুর শুনতে পাচ্ছি। সুরটা ঠিক কিসের বুঝতে পারছি না। স্লো…..মৃদু…পাখিদের কলরবের মতো।

সুনজিৎ সরকার কিছু না বলে, সিগারেট জ্বালালেন। লুঙ্গি পরা লোকটা বোধহয় বিরক্ত হয়ে চলে গ্যাছে। সুর নিয়ে আলাপ-আলোচনা সবার তো ভালো লাগবে না।

স্টিমার কখন চলতে শুরু করে দিয়েছে, তারা বলতে পারবে না। সুনজিৎ সরকার সিগারেট টানতে টানতে বের হয়ে আসে। তার পিছনে আব্দুল হামিদ। কাউকে আশে-পাশে দেখা যাচ্ছে না।

শোনো, এখন তুমি বাতাসের সুর শুনবে, শোনার চেষ্টা করবে। চোখ বন্ধ করে এখানে বসো। বলে একটা জায়গা দেখিয়ে বসতে বলে সুনজিৎ সরকার। সে সেই মতন বসে পড়ে। চোখ বন্ধ করে, ধীরে ধীরে চিন্তার জগতে প্রবেশ করে। সেই চিন্তায় শুধুই সুর খুঁজে বেড়ায়, পাগলের মতো। সুরকে কেউ এতোটা ভালবাসতে পারে, তার আগে জানা ছিলো না। সুরই যে একজনের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হতে পারে, সেটা ভেবে আতংকিত হয়। কারণ, ইতোমধ্যে সুরকে সে ভালোবেসে ফেলেছে। সুরের প্রতি এমনই প্রেম সবকিছু ছাড়তে প্রস্তুত। ধীরে ধীরে সুরের জগতে প্রবেশ করে। নিজের বুকের ওঠা-নামার গুঞ্জন আবার টের পায়।

একবার চোখ খোলে। তাকিয়ে দেখে-কালো আর কালো। পানির ধ্বনি ছাড়া অন্য কোনকিছু শোনা যাচ্ছে না। চোখ বন্ধ করে ফেলে। তাকে মৃত্যুর সুর শুনতে হবে।

দূর থেকে সুমধুর সুরে কেউ বাঁশি বাজাচ্ছে। সেই সুর শুনে আচমকা বুকের ভিতর ধক করে উঠে। এতো রাতে এই নির্জন পদ্মায় কে বাজায় বাঁশি। সেই সুরে যে পৃথিবী একাকার হয়ে যাচ্ছে। নদীর পানিও সেই সুর শুনে এক মনে বয়ে চলছে। স্টিমারও সেই দিকে ছুটে চলেছে। তার হৃদয়ও। সুনজিৎ সরকার কি সেই সুর শুনতে পাচ্ছে, সে ভাবল?

সুরগুলো খুব পরিচিত মনে হলো, আবার মনে হলো, না অচীন দেশের সুর। যে সুর কেউ কোনোদিন শোনেনি। অসাধারণ! কিন্তু কে বাজায়?

সে উঠে দাঁড়ায়। তার কাছে মনে হয়, দূরের কোনো চর থেকে এই সুর বাজছে।

দাদা, দাদা, কোথায় গেলেন? সে চিৎকার করে ওঠে।

কী হয়েছে? বের হয়।

শুনতে পাচ্ছেন।

কী?

একটা সুর। দেখেন বেজেই চলছে।

কই?

আপনি সত্যি শুনতে পাচ্ছেন না? তার চোখে আকুতি।

না। সত্যি না।

কেউ চর থেকে বাঁশি বাজাচ্ছে। এতো মধুর সুর, আমি কোনোদিন শুনিনি। আমি দেখতে চাই কে বাজায়?

কী বলছ? কোনো সুর বাজছে না, তুমি উল্টা-পাল্টা বকছ।

ওই সামনের চরে স্টিমার ভিড়াতে বলেন, আমি নামব।

এইরকম করে না, ভাই। তুমি যাও ভিতরে গিয়ে শুয়ে পড়গে।

না, আমি দেখব। তার কাছে সুর বিষয়ক অনেক কিছুই জানার আছে।

কিন্তু স্টিমার তো ফরিদপুর যাবে। তোমাকে নামিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করার সময় তো তাদের নেই।

আপনি আমার সাথে যাবেন। কাল কোনো নৌকা পেয়েই যাব।

না। আমারও ফরিদপুর যেতে হবে। তুমি কাল এসে দেখ?

না, আজই, এক্ষুণি।

তুমি পাগলামি করছ?

হ্যাঁ। না ভিড়ালে বলেন। সে বাঁশিটি কোমরে গুঁজে মোবাইল-খানা সুনজিৎ সরকারের হাতে দিয়ে স্টিমার থেকে লাফিয়ে পড়ে। সুনজিৎ সরকার কিছু বুঝে ওঠার আগে সাঁতরাতে শুরু করে।

সুনিজিৎ সরকার চিৎকার করে সবাইকে ডাকে। তাদের বলে, তাড়াতাড়ি ওকে ওঠানোর ব্যবস্থা কর। নইলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এতোদূর সাঁতরাতে গেলে নির্ঘাত মারা যাবে, তাছাড়া শীতকাল। জমে যাবে তো।

পাওয়ার-ফুল লাইট জ্বালিয়ে তাকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু সে অদৃশ্য হয়ে গেছে। এতো তাড়াতাড়ি পাড়ে উঠে যাবে, সে কী করে সম্ভব। কোনো চরও দেখা যাচ্ছে না।

সবাই পদ্মার পানির দিকে তাকিয়ে থাকে। আব্দুল হামিদ কোথায় হারিয়ে গেলো, কেউ ভেবে পায় না। সবাই শুধু একটা অচিন সুর শুনতে পায়।

বাংলাদেশ সময়: ১২১৯ ঘণ্টা, আগস্ট ২০, ২০১৭
এসএনএস

আরও পড়ুন
হাতঘড়ি | সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
যে দুঃসংবাদ স্বস্তি বয়ে আনে | সাব্বির জাদিদ
চেরাইকল এবং দুই খণ্ড পৃথিবী | শামীম আরেফীন
অমরাবতী | রাসেল রায়হান
হারুন | শাফিনূর শাফিন
ঘৃণার গল্প | মুহাম্মদ ফরিদ হাসান
লাইক শেয়ার কমেন্ট | মাহবুব ময়ূখ রিশাদ

সেকেন্ডহ্যান্ড | মাহমুদ নোমান
পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন | মাসউদ আহমাদ
গিলরয় | ফারাহ্  সাঈদ
ঘর | নুসরাত নীলা
প্রেম-অপ্রেমের কাব্য | নাহিদা নাহিদ
জীবনের ছুটি নেই । জব্বার আল নাঈম
বোবা সুখ | নাদিরা মুসতারী

খুচরো আলাপ | কিঙ্কর আহ্‌সান
 যেভাবে এহসানের ট্রেন বিষয়ক গল্পে ঢুকে পড়ি | এনামুল রেজা
যেভাবে অনিকেতের মৃত্যু হয়েছিল | আবু উবায়দাহ তামিম
 আদিম | আবদুল্লাহ আল ইমরান
টান । আকাশ মামুন
এই সময়ের এক কুড়ি গল্প পড়ুন বাংলানিউজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।