ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

শরতের অরূপ আলোর অঞ্জলি | জোবায়ের মিলন

মুক্তগদ্য ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৫৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৭
শরতের অরূপ আলোর অঞ্জলি | জোবায়ের মিলন শরতের অরূপ আলোর অঞ্জলি

ষড় ঋতুর বাংলাদেশে বর্ষা কেবল গত হলো এই তো কয়েকদিন। এখনও মাঠ-ঘাট, খাল-বিল, নদ-নদী জলে টলমল। পথ-প্রান্তর কাদায় থকথক, ডোবায় শ্রাবণের শেষ বৃষ্টির সাক্ষী লেগে আছে স্পষ্ট। জনমনে মেঘমেদুর আড়মোড়া ভাঙেনি সবটা— এরই মধ্যে আকাশের বিশাল শরীরে ফুটে উঠছে স্বচ্ছ কাঁচ রোদ।

কোথাও কালো মেঘের আঁচড় নেই, ঘন হয়ে দলা বেঁধে জমাট নেই— শাদা শাড়ি পড়ে কোনো এক শুভ্র কিশোরী যেনো তাথৈ তাথৈ পায়ে নেচে বেড়াচ্ছে ঘুঙুর পায়ে। সারা শরীর নীল।

নীল রঙ রোপণ করা একটা জমির মতো বিস্তৃর্ণ আকাশ। সে আকাশে নিড়ান দেওয়া জমির মতো শাদা নীলের অরূপ মিশ্রণ। মনে হয়, প্রকৃতি গ্যালারিতে প্রকৃতিরই বিচিত্র চিত্রপ্রদর্শনী। আর নিচে নদীর চরে চরে বালুময় ধু ধু, জলবালুর সামান্য আশ্রয়ে কাশবন— ধবল ধূতিপরা সনাতনের ন্যায় হাঁটছে হেলে দুলে অপার আনন্দে। নদীর পাশ দিয়ে ছুটে গেলে শুধু কাশবন আর কাশবন। জলে মৃদু ঢেউ ছলছল চলে দিগন্ত থেকে দিগন্তে। এসবের ভিতর দিয়ে পরিষ্কার বায়ুরূপ জানান দেয়— এখন শরৎ কাল।

শরৎ কেবল তার অরূপ রূপ-কাঠিতে মেঘ, আকাশ, নদী, চর, কাশবন, ছলছল জলতরঙ্গকে রাঙায় না। তার দেবী রূপে কেবল প্রকৃতিই সাজে না, শরৎ থেকে বিমোহিত রঙ ছিটকে পড়ে কবির মনেও। কবিও শরৎ থেকে রঙ তুলে আঁকতে চায় কবিতার শরীর অথবা শরৎকে দিতে চায় আরও একটি অলংকার পরিয়ে। যেনো দেবলীনার রূপের মতো ফুটে ওঠে শরতের মিহি রূপ; না হয় কবিই যেনো শরতের রূপে হয়ে উঠতে পারে দুধে ধোয়া এক ধবল মানব। তাই তো দাবানলের মতো তেজী আর ইস্পাতের মতো মজবুত বিদ্রোহী কবিও মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারেননি শরতের সুশ্রী থেকে। আপ্লুত হয়ে রচেছেন—
‘‘কোদালে মেঘের মউজ উঠেছে গগনের নীল গাঙে/ হাবুডুবু খায় তারা-বুদ্বুদ, জোছনা সোনায় রাঙে/ তৃতীয়া চাঁদের ‘শাম্পানে’ চড়ি’ চলিছে আকাশ-প্রিয়া/ আকাশ-দরিয়া উতলা হ’ল গো পুতলায় বুকে নিয়া/ তৃতীয়া চাঁদের বাকী ‘তের কলা’ আব্ছা কালোতে আঁকা/ নীলিমা-প্রিয়ার নীলা ‘গুল রুখ’ অবগুন্ঠনে ঢাকা। (চাঁদনী-রাতে, কাজী নজরুল ইসলাম)

রোদের ফাঁকে ফাঁকে ধূসর মেঘ উঁকি দিতে চায় শুরুর দিকে, ভয় দেখিয়ে ঝপাৎ করে নামতে চায় দুই এক আজলা ফোঁটা। গুড়গুড় ডাক দিয়ে অকারণ মাতায় ভাদ্রমাস। কবিও রসিকতা করে লেখেন তার ছেলেখেলা—
‘‘ঘনকালো মেঘের আঁধার একটু হাসে একটু কাঁদে/ রোদের সাথে লুকোচুরি খেলাটা বেশ জমিয়ে তোলে/ এই যে এখন মনটা ভালো / কখন কী হয় সবাই ভীতু- এমনই যে শরৎ ঋতু। ’’ 
(একটু হাসে একটু কাঁদে, আলাউদ্দিন আল আজাদ)

শরৎ যেনো একটু বেখায়ালী। একটু চটপট। কখন কী করে বুঝে ওঠা যায় না। না হয় হয়তো ভুলতে পারে না সাথের বোনকে। না হয় মাত্র বর্ষা পেরিয়ে আসা প্রকৃতি ভুল বসতই ঝরে যেতে চায় একটু আধটু। স্বভাব বসত। এই দুই রূপ টানাটান শরৎও বেশ আনন্দের সুর লাগিয়ে দেয় কবি মনে। কবি পুরনোকে ধরে না। নতুন নিয়ে মাতে সুখে উল্লাসে। হঠাৎ দেখা চরিত্র তুলে রাখে পেন্সিল খোঁচায় খাতার ভাঁজে—
‘‘শরৎ এলো কী উল্লাসে কাঁপছে নদীর জল/ পাখনা মেলে বেড়ায় খেলে প্রজাপতির দল!/ বাজলো কাঁসর সাজলো আসর চলরে সবাই চল/ মন-গালিচায় বন গালিচায় নামলো খুশির ঢল!!’ 
(ভবানী প্রসাদ মজুমদার, শরৎ এলো কি উল্লাসে)
 
ছয় ঋতুর দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। এর কোনো একটি ঋতু কোনো একটি ঋতুর চেয়ে কম রূপ নিয়ে জাগে না। তার বছরময় রূপের প্রতিযোগী হয়ে একে অন্যকে হারাতে ভেসে ওঠে নিজস্বতা নিয়ে। তাতে প্রকৃতি কখনও হয় প্রাণোচ্ছ্বল চঞ্চলা তরুণী, কখনও হয় দীপ্ত চক্ষু শীর্ণ সন্নাসিনী, কখনও বর্ষশীলা ক্রন্দনরতা অভিমানিনী, কখনও নিষ্প্রভ জরাগ্রস্ত বৃদ্ধা আবার কখনও বা শান্তশিষ্ট স্নেহময়ী ভগ্নি। এই যে তার পরিবর্তন, এই যে তার আসা যাওয়া, এই নানান রূপকে কবি ধরতে চান। কবি মিশতে চান এর সাথে। কবি কিছু নিতে চান। কবি কিছু আঁকতে চান জাগতিক পটরেখায়—
‘‘যে শাদা দেখি ঐ বকের পাখাতে/ সে রঙ চায় ওকি আকাশে মাখাতে/ বোঝে না পাখি সে কি নীলের শিথানে/ কী ফুল ফুটে আছে আকাশ-বিতানে?/ আলেয়া ঝিকিমিকি সন্ধ্যারাতে। / যে নীল বয়ে যায় মনের অতলে/ কে গোণে ঢেউ তার রূপালি সে জলে। / কে আঁকে বনে ঐ সবুজ কাহিনী/ লাজুক চোখে তুলে আজও তো চাহিনি,/ কী মায়া আছে ঐ সেগুন-শাখাতে। ’’ 
(নীলের শিথানে, আল মাহমুদ)

শরৎ এক অপূর্ব শ্রী ধারণ করে আসে শান্ত স্নিগ্ধ কোমল রূপ নিয়ে, যেখানে নেই কোনো মলিনতা, আছে কেবল নির্মল আনন্দ আর অনাবিল উচ্ছ্বাস। কী অপূর্ব রঙের খেলা, কী অপূর্ব মায়াবী রঙিন ভুবন সাজায় প্রকৃতি শরতের কালে— তা চোখে না দেখলে তার চিত্রপট কল্পনায় আঁকতে অপারগ যেনো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিত্রকরও। শরতের নিজস্ব রূপবিন্যাসে সোনালী রোদে ধোয়া কুটির, খোলা হাওয়ায় কাশবন, নদীর তরঙ্গ— সবই যেনো হয়ে অনন্যময়। তবে কি তার কোনো দুঃখ নেই? তারও আছে কিছু। কবিই তা দেখেন সব চোখের অতলে অন্য এক চোখ দিয়ে—

‘‘তুমি তোমার অসম্বৃত যৌবনকে ঢেকে রাখো/ পর্দার মতো একখণ্ড মেঘের আড়ালে। / তুমি তোমার রূপসী চাঁদকে অনুপস্থিত রাখো,/ হে শরৎ, তুমি তোমার উদ্বত সূর্যের উত্তাপে/ নির্মল ঝিলের স্মৃতিগুলো আকাশে মিলিয়ে দাও;/ আর আমি স্মৃতির দংশন থেকে মুক্ত হয়ে বাঁচি।  
(শরৎ, নির্মলেন্দু গুণ)

তুলোর মতো থোকা থোকা শাদা মেঘ— সারি বেঁধে উড়ে যায় এক গাঁও থেকে আরেক গাঁয়ে, এক নগর থেকে আরেক নগরে, পানার মতো ভেসে চলা এ যে বক-পালক আহ্। কোদালী আকাশ জাল বিছিয়ে নিড়ান দেওয়া মাঠের মতো। তার ফাঁকে ফাঁকে সাহসী সূর্যটা কখনও হেসে ওঠে কখনও মন ভার করে আড়াল হয় শাদা মেঘের আড়ালে—
‘‘আজি শরততপনে প্রভাতস্বপনে/ কী জানি পরান কী যে চায়!/ ওই শেফালি শাখে কী বলিয়া ডাকে/ বিহগবিহগী কী যে গায়!/ আজি মধর বাতাসে হৃদয় উদাসে,/ রহে না আবাসে মন হয়!/ কোন্ কুসুমের আশে কোন্ ফুলবাসে/ সুনীল আকাশে মন ধায়!/ আজি কে যেন গো নাই, এ প্রভাতে তাই/ জীবন বিফল হয় গো/ তাই চারিদিকে চায়, মন কেঁদে গায়-/ ‘এ নহে, এ নহে, নয় গো। ’’ (আকাঙ্ক্ষা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

নদীর চর, বালুময় উদ্যান, ধু ধু অঞ্চল জুড়ে কাশবন। নদীতে তরঙ্গ। উদাস কিশোর ঘাটের কাছে দাঁড়ায় ভাবুক মনে। জলে ঢেউ, মনে বাতাস। অবসর আসে অফুরাণ কাজের পরে। হোগলা পাতার কোলে হেলান দিয়ে কবি মন গাছের পাতায় লেখে না জানা কতশত কথা, ব্যথা, স্মৃতি। রাতের উজ্জ্বল আকাশ তলে কল্পআবেশে উড়ে উড়ে আসে কতনা ছোট-বড় ভাবনা. . .

‘‘শিউলি ফোটা- ভোরবেলার মতো শরৎকাল/ সন্ধ্যা আকাশ/ এই আকাশখানিরে ভালোবেসে আমার দু’চোখ/ঝাপসা হয়ে আসে; কত শৈশব/ কত শিউলি ফুলের মালাগাঁথা/ কত নদীর জীবনীপাঠ,/ আমি খুঁজতে খুঁজতে কোন বিষাদঅরণ্যে হারিয়ে যাই। / সেখানে সাদা মেঘের চিত্রকলা, অক্ষরের মতো/ শিশির বিন্দু/ আমি চোখ ফেরাতে পারি না, মন ফেরোতে পারি না/ কড়জোর দাঁড়িয়ে থাকি। ’’ (শরৎসন্ধ্যার সংবেদনা, মহাদেব সাহা)

সতেজ শরৎ কালের মোহনীয় রূপবৈভবে আছে বাঙালির প্রাণের বাঁশি। এ বাঁশির সুরে আকাশে বাতাসে অনুরণিত হয় উদার মুক্তির আহ্বান। বাঁধন ছিঁড়ে অফুরাণ সৌন্দর্যে ভেসে যেতে চায় মন। বৃষ্টির গৃহবন্দি জীবনের অবসান ঘটিয়ে ক্লান্তি ভুলতে প্রকৃতি নেমে যায় রূপ বদলিয়ে। গায়ে গতরে অন্তরে অন্দরে বৃহৎ ওঠে শরৎকাল। শরৎ যেনো জননী জন্মভূমির রূপসী মানসকন্যা। বাংলার প্রাণের প্রতিমাপ্রতিম।
‘‘আকাশ এখন শাদা মেঘে/ ছেঁড়া ছেঁড়া তুলোয় ভরা/ সেসব নিয়ে আমরা গড়ি স্বপ্ন সুখের পরস্পরা/ কাশের বনে নদীর চরে/ বকের সারি উড়ে চলে/ স্বচ্ছ বিলের জলের ঢেউয়ে/ মহানন্দে মনটি দোলে/ ...শুভ্রশরৎ আকাশ বাতাস/ ওই ওপরে মেঘের জমি/ সব বাঙালির প্রাণের নিবাস/ সব মানুষের পূণ্যভূমি। ’’
(শুভ্র শরৎ আকাশ বাতাস, রবিউল হুসাইন)
 
‘‘অনেক দিন পরে কাল মেঘবৃষ্টি কেটে শরতের সোনার রোদদুর উঠেছিল। পৃথিবীতে যে রোদদুর আছে সে কথা যেন একেবারে ভুলে গিয়েছিলুম; হঠাৎ যখন কাল দশটা এগারোটার পর রোদদুর ভেঙে পড়লো তখন যেন একটা নতুন জিনিস দেখে মনে অপূর্ব বিস্ময়ের উদয় হল। দিনটি বড়ো চমৎকার হয়েছিল। আমি দুপুর বেলায় স্নানাহারের পর বারান্দার সামনে একটি আরাম-কেদারার উপরে পা ছড়িয়ে দিয়ে অর্ধশয়ান অবস্থায় জাগ্রতস্বপ্নে নিযুক্ত ছিলুম। আমার চোখের সামনে আমাদের বাড়ির কমপাউনডের কতকগুলি নারকেল গাছ- তার ওদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় কেবলই শস্যক্ষেত্র, শস্যক্ষেত্রের একেবারে প্রান্তভাগে গাছপালার একটুখানি ঝাপসা নীল আভাস মাত্র। ঘুঘু ডাকছে এবং মাঝে মাঝ গোরুর গলার নূপুর শোনা যাচ্ছে। কাঠবিড়ালি একবার ল্যাজের উপর ভর দিয়ে বসে মাথা তুলে চকিতের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে হচ্ছে। খুব একটা নিঝুম নিস্তব্ধ নিরালা ভাব। বাতাস অবাধে হু হু করে বয়ে আসছে, নারকেল গাছের পাতা ঝর ঝর শব্দ করে কাঁপছে। দু-চার জনা চাষা মাঠের এক জায়গায় জটলা করে ধানের ছোট ছোট চারা উপড়ে নিয়ে আঁটি করে বাঁধছে। কাজকর্মের মধ্যে এইটুকু কেবল দেখা যাচ্ছে। (ছিন্নপত্র: ৩৪, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
 
বাংলাদেশ সময়: ১২৫১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৭
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।