ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

শতবর্ষে অমলিন ‘আনোয়ারা’ ও ‘দেবদাস’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৭
শতবর্ষে অমলিন ‘আনোয়ারা’ ও ‘দেবদাস’ উপন্যাস থেকে নির্মিত আনোয়ারা ও দেবদাস সিনেমার পোস্টার

অতীত স্মৃতিকে মানুষ ইচ্ছে করলেও মুছে ফেলতে পারে না। ভুলে যাওয়া নয়, মনে রাখাই তো জীবন। অতীতের স্মৃতিমালা তাই মনে থাকে; বার বার মনে পড়ে। কখনো স্মৃতিচারণে কিংবা সাহিত্যে অতীত ফিরে আসে। বারে বারে আসে অমলিন স্মৃতি হয়ে। আসে ভবিষ্যতের শিক্ষণীয় অনুপ্রেরণা হয়ে।

ফিরে আসে মানুষ। পুরনো সমাজের আবছায়া।

পুরনো আমল। হারিয়ে যাওয়া ফ্যাশন। অবলুপ্ত পোশাক। মূল্যবোধ। কখনো ফিরে আসে নতুন অবয়বে কিছু ইতিবৃত্ত, কিংবদন্তী কিংবা চরিত্র। ফিরে আসতে পারে একটি পুস্তকও। শতবর্ষে অমলিন এমন অনেক কিছুই ফিরে ফিরে আসে আমাদের কাছে নবতর আবহে। রিমিক্স শব্দটা এজন্যই এতো পরিচিত মনে হয়, যেখানে অতীতের সমকালীন উপস্থাপনা থাকে। কখনো সঙ্গীতের নতুন ফিউশনে। কখনো শিল্প-সাহিত্যের অন্য কিছুতে, নতুন ব্যাঞ্জনায় ও ভঙ্গিতে অতীতের পুনরাগম ঘটে। আসা-যাওয়া এভাবেই চলে। হয় নতুন ও পুরাতনের মেলবন্ধন।

প্রত্যাবর্তন বা ফিরে আসাটা বেশ চমকপ্রদ। কখনো হয়ত অতীতের স্মৃতির ডানায় ফিরে আসতে পারে। আসতে পারে বর্তমানের পাখনায় চেপে। নানাভাবে সামনে এসে দাঁড়ায় অতীত ও ইতিহাস। এজন্যই মানুষের সামনে থাকে স্মৃতি-সত্ত্বা-ভবিষ্যৎ। তখন একটি জীবন্ত সেতুর মতো মানুষ নিজেকে ছড়িয়ে দিতে পারে অতীত থেকে বর্তমান হয়ে ভবিষ্যতের সীমানায়। মানুষ আর তখন স্থির থাকে না। হয় চলন্ত। অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতস্পর্শী।  

মাঝে মাঝেই অনিন্দ্য নান্দনিকতায় দেখা দেয় অতীত। কখনো বিস্মৃত ও ভুলে যাওয়া উৎসব-আনন্দ-আয়োজনে। কখনো হারানো মায়ের মমতায় স্মৃতি চমকায়। জীবনের কোনও একটি রূপালি বিকেল বা অপসৃয়মান প্রদোষের রঙে ভেসে আসে স্মৃতির মেঘমালা। আসে প্রেমিক বা প্রেমিকার ললাটের শ্বেতদ্যুতিতে। কখনও বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতিচারণে। কিংবা স্মৃতি এসে হানা দেয় বার বার জীবন-সঘন প্রিয় নগরে, চলমান নদীতে, জঙ্গমে, অভিজ্ঞতায়।

দেবদাস সিনেমার পোস্টার।  স্মৃতি থেকে ধাবমান কালের বাস্তব বিন্যাসে দেখা যায়, উপরে বহুতলাচ্ছিদ আকাশ, নীচে পৃথিবীর ঘাসের স্মৃতিময় পারসিক গালিচা, তার ওপর জীবন বিছিয়ে একজন মুগ্ধ কবি অবশেষে কিছুক্ষণের জন্যে বিশ্বায়ন ও বেনেবাদকে এড়িয়ে শুয়ে থাকেন। তখন তাঁর বুকের ‘পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল’ [জীবনানন্দ], তা-ই তাঁকে নিয়ে চলে অস্তিত্বের প্রিয়সরণিতে। কবি তখন স্মৃতিরবহর নিয়ে সঙ্গে থাকেন বর্তমানের। চলেন ভবিষ্যতের সড়কে; আদিঅন্তহীন জীবনের পথে পথে।

মূলত মানুষের অস্তিত্বের একটি চলমান প্রিয়পথ শুধু সামনেই নয়, চলে যায় অম্লান স্মৃতির সরণিতে, ঈদ ও নানা উৎসবের উচ্ছ্বল আয়োজনে। তরঙ্গায়িত পদ্মা-মেঘনা-শঙ্খের নীলাভ জলে ও বেদনায়-বিষণ্নতায় হারানো স্মৃতি ও উৎসবে; যা আজকের তীব্র অব্যবস্থাপনা, যানজট, আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-নৈতিক অবক্ষয়, উগ্রতা ও অধঃপতনে এবং নানা আগ্রাসী দুর্বিপাক-দুর্ভোগের কারণে ক্রমেই অপসৃয়মান। ফলে আজকে স্মৃতি বলতে ব্যস্ত জীবনের নানা যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবিই ভেসে আসে। সংক্ষুব্ধ ভঙ্গিতে নাড়া দেয় উৎসবের সঙ্গে মানুষ, জীবন, সমাজ, প্রকৃতি, পরিবেশ, ধর্ম ও সংস্কৃতির সংঘাতমুখর মেলবন্ধনের জটিল ও কষ্টকর আবহ।

আবার কখনো কখনো স্মৃতিতে এমন একটি চিত্রকল্পও উদ্ভাসিত হয়, যা এখন অতীতের গর্ভে বিলীন কল্পনা মাত্র: “...ভাদ্রমাসের ভোর বেলা। স্বর্গের ঊষা মর্তে নামিয়া ঘরে ঘরে শান্তি বিলাইতেছে। তাহার অমিয় কিরণে মেদিনী-গগণ হেমাভ বর্ণে রঞ্জিত হইয়াছে। উত্তরবঙ্গের নিম্ন-সমতল গ্রামগুলি সোনার জলে ভাসিতেছে; কর্মজগতে জাগরণের সাড়া পড়িয়াছে; ছোট বড় মহাজনী নৌকাগুলি ধবল-পাখা বিস্তার করিয়া গন্তব্য পথে ঊষাযাত্রা করিয়াছে, পাখিকুল সুমধুর স্বরলহরী তুলিয়া জগৎপতির মঙ্গলগানে তান ধরিয়াছে; ধর্মশীল মুসলমানগণ প্রাভাতিক নামাজঅন্তে মসজিদ হইতে গৃহে ফিরিয়াছে, হিন্দু পল্লীর শঙ্খ-ঘণ্টার রোল থামিয়া গিয়াছে। ”

মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্যরত্ন রচিত একদা বিপুল জনপ্রিয় ‘আনোয়ারা’ উপন্যাসের এমন চিত্ররূপ বর্ণনা ও প্রাত্যহিক উৎসবময়তার রূপকল্প আজকের হাল আমলে অচিন্তণীয়। প্রসঙ্গত, ‘আনোয়ারা’ হলো এমন একটি উপন্যাস, যার সম্পর্কে ড. মুহম্মদ আবদুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (আধুনিক যুগ) গ্রন্থে বলেছেন, “জনপ্রিয়তা দিয়ে যদি কোনো বইয়ের বিচার করতে হয়, তা হলে মোহাম্মদ নজিবর রহমান রচিত ‘আনোয়ারা’র দাবিই সর্বাগ্রে বিবেচ্য। ১৯১৪ সালের ১৫ জুলাই এ বইটি প্রথম কলকাতায় প্রকাশিত হয়। ১৯৪৯ সনে এ বইটির ত্রয়োবিংশতি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে এবং এ যাবৎ ‘আনোয়ারা’র দেড়লক্ষ কপি নিঃশেষিত হয়েছে। ”

১৯৫৬ সালে মুহম্মদ আবদুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসানের মন্তব্যের পর দীর্ঘ বছর কেটেছে এবং বিগত ২০১৪ সালে ‘আনোয়ারা’ উপন্যাস প্রকাশের শতবর্ষও উদযাপিত হয়ে গেছে। বইটির বিক্রয়ও নিশ্চয় আগের সংখ্যাকে বহুগুণে অতিক্রম করেছে। মীর মশাররফ হোসেন রচিত ‘বিষাদ সিন্ধু’র পর ‘আনোয়ারা’ই হলো সর্বাধিক পঠিত ও জনপ্রিয় উপন্যাস। স্মৃতির অমূল্য গ্রন্থ হয়ে আজো ‘আনোয়ারা’ অতীত দিনের সমাজ আর মানুষের নিটোল ছবি তুলে ধরছে। সমাজ বাস্তবতার সাহিত্যিক রূপায়নে চূড়ান্ত সফল গ্রন্থ আনোয়ারা’।

আনোয়ারা সিনেমার পোস্টার কিন্তু ‘আনোয়ারা’ উপন্যাসের সেই জীবন, জগৎ, চরিত্র, প্রতিবেশ, আনন্দ, বেদনা, উৎসব ও আবেগের চিত্রমালা একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বায়ন প্রভাবিত সময় ও সমাজ থেকে হারিয়ে গেছে। তারপরেও পুরোপুরি হারিয়ে যায় নি; রয়ে গেছে সমাজ ও মানুষের অমোচনীয় স্মৃতিতে। আনোয়ারা, নূর ইসলাম, ডাক্তার সাহেব, দাদীমা চরিত্রগুলো বার বার ফিরে ফিরে আসে আপনজনের অবয়ব নিয়ে। শুধু বইয়ের পাতায় নয়, চলচ্চিত্র ও টিভিতে আবির্ভূত হয় শতবর্ষের অমলিন স্মৃতি হয়ে। পুরনো মানুষের একান্ত নস্টালজিয়ায় হানা দেয় সেইসব কাহিনী ও চরিত্র।  

‘আনোয়ারা’ উপন্যাসের সূত্র ধরে উল্লেখ করা যায় আরেক কালজয়ী রচনা ‘দেবদাস’-এর। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক উপন্যাসটি ১৯০১ সালে রচিত হলেও প্রকাশ পায় ১৯১৭ সালের ৩০ জুন; আজ থেকে ঠিক একশ’ বছর আগে। ভারতের বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হওয়া ছাড়াও বহুবার বহুভাবে চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে উপন্যাসটি। ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু জমিদার পরিবারের দায়িত্ব জ্ঞানহীন, বেহিসাবী ও বেপরোয়া সন্তানের মূর্ত প্রতিচ্ছবি ‘দেবদাস’। আর নায়িকা পার্বতী সংস্কারপূর্ণ হিন্দু রমণীর প্রতীক। চন্দ্রমুখী আরেক প্রেম-বঞ্চিত সমাজ-পতিত সুপরিচিত নারীর নাম।

উপন্যাসের এইসব বেদনা-দগ্ধ চরিত্র ঔপনিবেশিক বাংলার অতীত সমাজ কাঠামোর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল। আর ছিল তাদের কাছ থেকে পাওয়া ব্যর্থতা ও অনুশোচনার শিক্ষা। প্রথমে পেয়েও পায়ে ঠেলে দিয়ে ‘দেবদাস’ যখন অবশেষে পার্বতীকে প্রত্যাশা করতে করতে জীবন পুড়িয়ে ফেলে, তখন অবরুদ্ধ সমাজের সংস্কার দেবদাস বা পার্বতী, কাউকেই সাহায্য করে নি। হাহাকার ছাড়া তাদেরকে আর কিছুই দেওয়া হয় নি। ব্যক্তির সত্বা পরাজিত হয়েছিল সেদিনের আধা-সামন্ত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অনগ্রসর, ইংরেজ শাসিত বাংলার বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থার কাছে।  

আজকের আধুনিক ও উপযোগীবাদী সমাজে কোনো প্রেমিক ‘দেবদাস’ হওয়ার কথা কল্পনাও করবে না; কোনো নারী ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদী এই যুগে ‘আনোয়ারা’-এর মতো সঙ্কট পাড়ি দেবে না। ফলে প্রাচীন স্মৃতি হয়ে নিজেদের ভুল ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে তারা থাকবেন বইয়ের পাতায় বা চলচ্চিত্রে অতীতের অমলিন অতীত হয়ে, যাতে তাদেরকে পড়ে ও দেখে প্রজন্ম ও পরম্পরা সঠিক পথটি বেছে নিতে পারে। আসলেই স্মৃতি এবং স্মৃতির মানুষদের মুছে ফেলা যাবে না। মুছে ফেলা যাবে ভুলের স্মৃতিগুলো। নেওয়া যাবে বর্তমানের জন্য লাগসই শিক্ষা ও প্রেষণা। অতীতের অসামান্য মূল্যও নিহিত রয়েছে এইখানে, এই শিক্ষাটুকু গ্রহণ ও বর্জনের ধারায়।
     
ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি-গল্পকার-গবেষক। অধ্য‍াপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।