ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

নীল উড়াল: দ্বাত্রিংশ পর্ব

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬০৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩, ২০১৭
নীল উড়াল: দ্বাত্রিংশ পর্ব নীল উড়াল

নায়ক ম্যাকগিল ভার্সিটির অধ্যাপক-লেখক-অভিবাসী বাংলাদেশি। ফরাসি সুন্দরী মার্গারেট সিমোনের প্রণোদনায় দেশে মাদকচক্র নিয়ে গবেষণাকালে ঘটনা মোড় নেয় রোমাঞ্চকর বাঁকে। আসে ধুরন্ধর বন্ধু-অসৎ ব্যবসায়ী এনামুল, সুন্দরী স্টাফ রোকসানা, মধুচক্রের জেনিফার-মলি-পরী, ক্লিনিকের অন্তরালের মিসেস খোন্দকার, রমনার শফি মামা ও ফুলি, ‘উড়াল যাত্রা’র সাইফুল, বিড়ালের কুতকুতে চোখের তরুণ সাংবাদিক ফরমানউল্লাহ এবং ছোটখালার রহস্যময় মেয়ে অন্তরা। প্রেম ও বেঁচে থাকার যুগল উড়ালে কাহিনী আবর্তিত হতে থাকে।

৩২.
সকাল সকাল ফোনে এমন জোরে কেউ চিৎকার করে, ভাবাই যায় না। সাংবাদিক শামীমুল হকের গলা প্রচণ্ড চিৎকারের আওয়াজে চেনা যাচ্ছে না।

তিনি ভয়ঙ্কর উত্তেজিত। তার গলায় প্রবল উৎকণ্ঠা। তিনি রুদ্ধশ্বাসে জানতে চাইলেন:
-ভাই আপনি কোথায়?
-কেন, কি হয়েছে শামীম?
উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে শামীম বললেন:
-ভয়ানক খারাপ খবর আছে?
আমি বেশ বিচলিত হয়ে গেলাম। ‘ভয়ানক খারাপ খবর?’ কি হতে পারে? আমার মধ্যেও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়লো। দ্রুত জানতে চাইলাম:
-কি হয়েছে শামীম?

নীল উড়াল: একত্রিংশ পর্ব

বোমা ফাটানোর মতো ভীতি ছড়িয়ে শামীম বললেন:
-রোকসানা মারা গেছে!
আমি স্তম্ভিত। কি বলছে শামীম! আমি অস্বাভাবিক গলায় জানতে চাই:
-কখন, কিভাবে?
শামীম কিছুটা সময় নিয়ে আত্মস্থ হয়ে বললেন:
-শেষ রাতের দিকে মারা যেতে পারে। পোস্টমর্টেম ছাড়া বলা যাবে না।
আমার উৎসুক জড়ানো গলায় বলি:
-পোস্টমর্টেম কেন? ওর কি স্বাভাবিক মৃত্যু হয় নি?  
শামীম বলেন:
-না। খুবই রহস্যজনক মৃত্যু।

আমি ঊৎকণ্ঠা চেপে রাখতে না পেরে বলি:
-প্লিজ শামীম, পুরো ঘটনাটি আমাকে খুলে বলুন।
শামীম জানান, রোকসানার ডেডবডি হাসপাতালের মর্গে পড়ে আছে। তাদের ফটোগ্রাফার ইমরান মৃতদেহের ছবি তুলে এনেছে। লাশ দেখে ইমরানের ধারণা, রোকসানাকে হত্যা করা হয়েছে।
সব শুনে আমি বলি:
-ভেরি স্যাড!
শামীম তাৎক্ষণিক উত্তর দিল:
-ঘটনার এখানেই শেষ হলে আপনাকে এতো জরুরি ভিত্তিকে ফোন করার দরকার হতো না।
আমি আবার উদ্বিগ্ন হয়ে বলি:
-কেন, আর কি হয়েছে?
আমার প্রশ্ন শুনে শামীম বললো:
-এই মাত্র আমাদের তরুণ রিপোর্টার ফরমানউল্লাহ খবর এনেছে, রোকসানা আত্মহত্যা করেছে। ফরমান রোকসানার বাড়ি থেকে একটি সুইসাইড নোট আবিষ্কার করেছে। সে সেটা মিডিয়ার সবাইকে বিলি করছে। পুলিশের কাছেও সে এক কপি জমা দিয়ে আত্মহত্যার মামলা করিয়েছে।
আমি বিস্ময়ে আঁতকে উঠি:
-বলেন কি শামীম? রোকসানা কেন আত্মহত্যা করবে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

শামীম আমার প্রশ্নের উত্তর দিল না। সে পাল্টা প্রশ্ন করলো:
-সুইসাইড নোটে কি লিখা আছে জানেন?
হতভম্বের মতো আমি বলি:
-কি?
কালবিলম্ব না করে শামীম উত্তর দিল:
-আপনার নাম!
শামীমের কথায় ঘরে যেন ভূমিকম্প হলো। আমি টলতে টলতে কোনোরকমে তাল সামলাই। এলোমেলো গলায় বলি:
-এসব কি বলছেন শামীম!
-হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। সুইসাইড নোটে লেখা-আপনার জন্য সে আত্মহত্যা করেছে। আপনি তাকে বিয়ের প্রলোভন দিয়ে যৌন সম্ভোগ করেছেন। বহু বার বলার পরেও তাকে বিয়ে করতে রাজি হন নি। বাধ্য হয়ে সে আত্মহত্যা করেছে। সাংবাদিক ফরমানউল্লাহ আমাকে জানিয়েছে, ঘটনার প্রমাণ হিসাবে সে একটি সিডি রেখে গেছে। সেটি এখন পুলিশের কব্জায়।


এবার আমি চিৎকার করে উঠি:  
-অসম্ভব শামীম! এটা হতে পারে না।
শামীম দরদী কণ্ঠে বললো:
-আমি জানি। আপনাকে কায়দা করে ফাঁসানো হয়েছে। আপনি তাড়াতাড়ি পালান।
শামীমের কথায় আমার আত্মসম্মানে আঘাত টের পেলাম। ওকে বললাম:
-পালাবো কেন? আমি তো অপরাধ করি নি। আমি ফাইট করবো।
ফোনে শামীমের হাসি শোনা গেলো। বড় করুণ হাসি।

শামীমকে খবরগুলো জানানোর জন্য ধন্যবাদ দিয়ে ফোন রেখে দিলাম। আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। এনামুল! এক ঢিলে তুমি দুই পাখি মেরেছো। তোকে আমি ক্ষমা করবো না। কোনও ফাঁকে মার্গারেট পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, খেয়াল করি নি। সে উদ্বেগ ভরা কণ্ঠে জানতে চাইল:
-কি হয়েছে? এনিথিং রং?
আমি কাতর কণ্ঠে রোকসানার মৃত্যু কথা তাকে জানালাম। আমাকে এই মৃত্যুর সঙ্গে জড়িয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা চলছে, সে বিষয়টিও জানাই। মার্গারেট সব শুনে আঁতকে উঠলো:
-ওহ! মাই গড! এতো গভীর ষড়যন্ত্র। তুমি সার্বক্ষণিক আমার সঙ্গে ছিলে। আমি তো জানি, তুমি মার্ডারের সঙ্গে কিছুতেই জড়িত নও। জাস্ট ওয়েট।

মার্গারেট দৌড়ে গিয়ে তার ল্যাপটপ নিয়ে এলো। রোকসানা সংক্রান্ত খবর জানার জন্য সে নিউজ সাইট ভিজিট করছে। বেশ রসালো করে খবরটি প্রকাশ করেছে অনেকেই। এদেশে পজিটিভ নিউজের চেয়ে নেগেভিট নিউজের খবর বেশি চলে। পাঠক নাকি এসব খবরই বেশি ‘খায়’। খুন, ধর্ষণ, সেক্স, স্ক্যান্ডাল না হলে পত্রিকার পাতা ভরে না। ধর্ষণের এমন বিবরণ ও ছবি ছাপানো হয় যে পাঠক বেদনাহত হওয়ার বদলে রোমাঞ্চিত হন। মাদক সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট পড়েছিলাম পত্রিকায়। এমনভাবে লিখা হয়েছে, কোথায় কোথায় মাদক পাওয়া যায়, সে ঠিকানাও ছিল। যে কেউ ইচ্ছে করলেই গিয়ে কিনে নিয়ে আসতে পারবে। রিপোর্টটি কি মাদকের বিপক্ষে না পক্ষে লিখা সেটা বোঝাই দুস্কর। রোকসানার মৃত্যুর খবর যথেষ্ট ফুঁলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে। আমার কোনও বক্তব্য না নিয়েই আমাকেই আসামি বানিয়ে ফেলা হয়েছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে পেছনে কলকাঠি নাড়ানো হচ্ছে। খবরের সঙ্গে রোকসানার ছবি ছাপানো হয়েছে। দেখলাম তার অবাক করা মুখ। মারা যাওয়ার আগে কি কোনও কারণে অবাক হয়েছিল? কাকে দেখেছিল সে যে মরতে মরতে এতো অবাক হতে হলো তাকে?

ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকলো তানিয়া। আমি আর মার্গারেট সবিস্ময়ে ওর দিকে তাকালাম। মার্গারেট স্পষ্টতই বিরক্ত। নক না করে অনুমতি ছাড়া ঘরে প্রবেশ করা অশিষ্ট কাজ। সে বিরস মুখে তানিয়ার দিকে তাকালো। ছুটে আসায় তানিয়া মৃদু হাঁপাচ্ছে। দম নিয়ে সে আমার দিকে চেয়ে বললো:
-আপনি এখনও এখানে?
আমাকে উত্তর দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে মার্গারেট কড়া গলায় পাল্টা প্রশ্ন করলো:
-কেন? কি হয়েছে?
তানিয়া মার্গারেটের বিরক্তি টের পেয়েছে। সে এখন অপেক্ষাকৃত শান্ত ও স্বাভাবিক গলায় বললো:
-সরি ম্যাডাম। সকালে খবরটা পড়ে এমনিতেই উত্তেজিত ছিলাম। কিন্তু এই মাত্র যে খবর পেলাম, তাতে আমার মাথা ঠিক রাখতে পারি নি।
আমরা দু’জনেই সমস্বরে বলি:
-আবার কি হলো?
তনিয়া ভয়াল কণ্ঠে বললো:
-এখানে পুলিশ আসছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে তারা পৌঁছে যাবে।
সঙ্গে সঙ্গে মার্গারেট জানতে চায়:
-তুমি খবর পেলে কেমন করে?
তানিয়া খবরের সূত্র সম্পর্কে বলে:
-ম্যাডাম, আমার এক কাজিন পুলিশে চাকরি করে। সে এই অপারেশনের খবর পেয়ে আমাকে ফোন করে অফিস থেকে কিছুক্ষণের জন্য সরে যেতে বলেছে। সে আরও জানিয়েছে, কানাডা প্রবাসী এক বাংলাদেশিকে ধরার জন্য এই অভিযান। লোকটি নাকি খুনি। লোকটির ব্যাপারে দেশের সব পোর্টকে জানিয়ে ওয়ারলেস করা হয়েছে। বলা হয়েছে, কোনও ভাবেই যেন দেশ ত্যাগ করতে না পারে। দেখা মাত্র অ্যারেস্টের কিংবা প্রয়োজনে গুলি করার অর্ডার ইস্যু হয়ে গেছে।

ভেঙে পড়লো মার্গারেট। করুণ গলায় বললো:
-সর্বনাশ। এরই মধ্যে ওরা সব ব্যবস্থা করে ফেলেছে।
তানিয়া তাড়া দিল:
-আগে পালানোর ব্যবস্থা করা যাক। তারপর অন্য কথা। একবার অ্যারেস্ট হলে ফাঁসি পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে।

ভয়ে মার্গারেটের চেহারা পাণ্ডুর হয়ে গেছে। সে কথা বলতে পারছে না। আমার পাশে এসে সে আমার শরীরের সঙ্গে নিজেকে লেপ্টে রেখেছে। যেন বলতে চাইছে, আমি কাউকে কিছু করতে দেবো না। তোমাকে আগলে রাখবো।

আমার ইন্দ্রিয় এতক্ষণের ধকল সহ্য করে আচ্ছন্নতা কাটিয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। শরীরের ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমও কাজ করতে আরম্ভ করেছে। আমি আশ্বাসের ভঙ্গিতে মার্গারেটের চুলে হাত বুলিয়ে দৃঢ়ভাবে বলি:
-সমস্যায় ভেঙে পড়লে বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করতে হবে। আমি হার মানা শিখি নি। অ্যাম দ্য লাস্ট মেন টু ফাইট লাইক ওয়ান ম্যান আর্মি। সাহস রাখো। সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করলে অনেক চক্রান্তই কাবু করা সম্ভব হবে।
আমার কথায় কাজ হলো। মার্গারেট মাথা ঝাঁকিয়ে বললো:
-দ্যাটস রাইট। সবাই মিলে দ্রুত চিন্তা করে বের করো, এখন কি করা উচিত। তানিয়া প্লিজ হেল্প আস।
কাল বিলম্ব না করে তানিয়া বলে:
-সবচেয়ে আগে একটি সেফ প্লেসে চলে যাওয়া উচিত। এই জায়গা চিনে গেছে সবাই। এটা  আর নিরাপদ নয়। সেফ জায়গায় বসে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে স্ট্যাট্রেজি ঠিক করা যাবে।
একটু থেমে তানিয়া বললো:
-মালপত্রগুলো তাড়াতাড়ি প্যাক আপ করে ফেলতে হবে।

তানিয়ার কথা শেষ হতে না হলেই কাছে পুলিশের গাড়ির সাইরেন শোনা গেলো। সাইরেনের শব্দ ক্রমেই এদিকে এগিয়ে আসছে। আমি লাফ দিয়ে উঠলাম। আর বিন্দুমাত্র দেরি করা চলবে না। পেছনের দরজা দিয়ে বের হতে হতে মার্গারেটকে বলি:
-আমার ল্যাপটপ, রিপোর্ট, নোটগুলো সরিয়ে রাখো। কোনওভাবে যেন ওদের হাতে না পড়ে। আর আমার রিপোর্টের একটি খসড়া কপি সাংবাদিক শামীমুল হকের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করবে।

বাড়ির পেছনের সীমানা প্রাচীর টপকে গলি রাস্তায় নামতে নামতে দেখতে পেলাম মার্গারেট সজল চোখে আমার পথের দিকে চেয়ে আছে।

বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।