ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

লালন: মানবতাবাদী এক মহাত্মা | মাহফুজ কিশোর

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮০৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১৭
লালন: মানবতাবাদী এক মহাত্মা | মাহফুজ কিশোর লালন: মানবতাবাদী এক মহাত্মা | মাহফুজ কিশোর

‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে।
লালন ভাবে জাতের কী রূপ
দেখলাম না তা-নজরে।’
 

জাত-পাত, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র প্রভৃতির ঊর্ধ্বে গিয়ে যিনি মানুষ ও মানবধর্মকে বড় করে দেখেছেন এবং জীবনভর যিনি মানবতাবাদের কথা বলেছেন তিনি ফকির লালন সাঁই (১৭৭৪-১৮৯০)। শিষ্যরা তাকে ডাকেন ‘সাঁইজি’ নামে।

এছাড়াও লালন শাহ, মহাত্মা লালন, বাউল সম্রাট, মরমী সাধকসহ একাধিক নাম ও পরিচয় রয়েছে তার। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীরও ২৫ বছর আগে, ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম তিনি ‘মহাত্মা’ উপাধি পেয়েছিলেন। একইসাথে বাংলাদেশে বাউল গানের স্রষ্টা ও শ্রেষ্ঠ রচয়িতার মুকুটও শোভা পায় লালনের নামের পাশে। বাংলা ভাষা, বাংলার সংস্কৃতি যেমনিভাবে আমাদের নিজস্ব বিষয়; বাউল সম্প্রদায়, বাউল গান ঠিক একইভাবে প্রতিটি বাঙালির নিজস্ব সম্পদ, নিজস্ব ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিষয়। আর সেই ইতিহাসের গোড়াপত্তন করেছেন ফকির লালন সাঁই। আজ, এই মরমী সাধকের ১২৭তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার প্রতি জানাচ্ছি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
 
আজকাল ইন্টারনেট ঘাঁটলেই লালন সাঁইকে নিয়ে প্রচলিত একটি কথা চোখে পড়ে যে, লালনের ব্যক্তিজীবন নিয়ে বেশি কিছু জানা যায়নি। এটা খুবই দুঃখের কথা। বাংলা লোকসংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ বাউল গান। আর সেই বাউল গানের সম্রাটের জীবনালেখ্য আমাদের অজানা থাকবে তা কী করে হয়!
 
লালন সাঁই ১৭৭৪ সালে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার নদীয়া জেলাধীন কুষ্টিয়া মহকুমার কুমারখালী ইউনিয়নের ভাঁড়ারা গ্রামের এক হিন্দু পরিবারে জন্ম নেন। বাবা শ্রী মাধব কর, মাতা শ্রীমতি পদ্মাবতীর একমাত্র সন্তান ছিলেন তিনি। শৈশবেই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি বাবাকে হারানোয় পরিবারের দায়িত্ব এসে পরে তার ওপর। মায়ের সেবার প্রতি লক্ষ্য রাখতে অল্প বয়সে বিয়ে করেন তিনি। ছোটকাল থেকেই গানের প্রতি লালনের ভক্তি ছিলো। নিজ গ্রামের বিভিন্ন কবিগান, যাত্রা, পালাগানে তিনি গায়ক হিসেবে অংশ নিতেন। মানুষ মুগ্ধ হয়ে শুনতো তার গান।
 
যৌবনের সুচনালগ্নে পূণ্যলাভের জন্য নিজ গ্রামের সঙ্গী-সাথীসহ গঙ্গা স্নানে যাত্রা করেন লালন। স্নান-কর্ম সেরে ফেরার পথে লালন সহসাই বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। একসময় জ্ঞান হারালে সঙ্গীরা তাকে মৃত ভেবে মুখাগ্নি করে নদীতে ফেলে যায়। লালনের মা ও স্ত্রী তার মৃত্যুসংবাদ শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন। পরে তারা এটাকে ভাগ্যের লিখন মনে করে ধর্মমতে সমাজকে নিয়েই গায়েবি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করেন।

এদিকে, নদীতে ভেসে লালনের দেহ পাড়ে পৌঁছালে মুসলিম কারিগর পরিবারের এক নারী তাকে দেখতে পেয়ে নদী থেকে তুলে নিয়ে তার সেবা করেন। রোগমুক্তি ঘটলেও লালন তার এক চোখ হারান। সুস্থ হয়ে লালন বাড়ি ফেরেন। পরিবারের মা-স্ত্রী তাকে ফিরে পেয়ে যখন আবেগে ভাসছেন তখনই শুরু হয় ঘটনার ঘনঘটা। ধর্মীয় কুসংস্কারের রূঢ় প্রথা ফুটে ওঠে। লালন বাড়ি ফিরেছে শুনে এলাকার লোকজনের সঙ্গে স্থানীয় সমাজপতিরাও দেখতে আসে তাকে। তারা দৃঢ়ভাবে জানায়, ধর্মমতে লালনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে এছাড়া সে মুসলিম বাড়ির জল-খাবার খেয়েছে তাই তাকে আর এ সমাজে আশ্রয় দেওয়া যাবে না। ফলে ঘর-সংসার, মা, স্ত্রী ছেড়ে লালন গৃহত্যাগী হতে বাধ্য হন। ধর্মীয় গোঁড়ামীর ফাঁদে পড়ে সমাজচ্যুত হন তিনি। তার মা, স্ত্রী সহযোগী হতে চাইলেও সমাজপ্রথা তাদেরকে আবদ্ধ করে রাখে। পতিব্রতা লালনের স্ত্রী এই শোক সইতে না পেরে কিছুকাল পরেই পরপারে পাড়ি জমান।

আজকাল অনেকেই লালন সাঁইকে সমাজবিচ্যুত সাধু বলে কালিমা লেপনের চেষ্টা করেন। কিন্তু তাদের জানা উচিত লালন সংসারত্যাগী ছিলেন না। বরং কথিত কুসংস্কারাবদ্ধ সমাজই তাকে গৃহত্যাগে বাধ্য করে। সংসারমনা লালনকে পথের পথিক বানিয়ে দেয়।

যে ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তি দেখানোর অভিপ্রায়ে লালন গঙ্গা স্নানে গিয়ে নিজের জীবন হারাতে বসেছিলেন, পরবর্তীতে সেই ধর্মই যখন তাকে গৃহত্যাগে বাধ্য করলো তখনই লালনের মানব আত্মা ধর্মের নামে সৃষ্টিকর্তার মহান সৃষ্টি মানুষকে কৃতদাস করে রাখার ঘৃণ্য প্রথার বিরুদ্ধাচারণ করে উঠলো। বলা যায়, এই ঘটনাই লালনকে ‘মানবতাবাদী মহাত্মা’ করে তুলতে ভূমিকা রেখেছে।
 
সময়ের বিবর্তনে সমাজচ্যুত লালনের পরিচয় হয় মরমী সাধক সিরাজ সাঁইয়ের সঙ্গে। এ থেকেই শুরু হয় লালনের বাউল গানের যাত্রা। সিরাজ সাঁইকে ‘গুরু, তুমি তন্ত্রের মন্ত্রী’ মেনে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলাধীন ছেঁউড়িয়া গ্রামে আখড়া করে আধ্যাত্ম চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়েন তিনি। সমাজে প্রচলিত ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জাত-পাতের বিরুদ্ধে তিনি তার মানবধর্মের মতবাদ প্রচার করতে থাকেন গানের মাধ্যমে। ধীরে ধীরে তার সেই অহিংসবাদী মতবাদ ছড়িয়ে পড়ে দেশে-বিদেশে। বিশেষ করে সমাজের সাধারণ মানুষ হোক সে হিন্দু অথবা, খ্রিস্টান কিংবা বৌদ্ধ, শিষ্যত্ব নেয় লালনের। লালন গানের মাধ্যমে শুরু হয় নতুন এক মানবধর্মের চর্চা। জাত-পাতহীন, ধর্ম-বর্ণহীন সমাজের কথাগুলো লালনের গানের মূলকথা হওয়ায় মানুষ তার গানের মাধ্যমে মানবমুক্তির আশ্রয় খুঁজে পায়। লালন তার গানে বলেন-
‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে।
যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান
জাতি গোত্র নাহি রবে। ’
 
অন্য গানে বলেন-
‘গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়,
তাতে ধর্মের কি ক্ষতি হয়।
লালন বলে জাত কারে কয়
এ ভ্রম তো গেল না। ’
 
লালনের শিষ্যদের দাবি, তিনি প্রায় ১০ হাজার গানের রচয়িতা। প্রামাণ্যসূত্রে সংখ্যাটা হয়তো হাজার দু’য়েকের বেশি নয়। সবগুলো গানেই মানুষ ও সমাজ প্রাধান্য পেয়েছে। আত্মতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয় নিয়ে অসংখ্য গান রয়েছে লালনের।
 
খাঁচার ভেতর অচিন পাখি, মিলন হবে কত দিনে, জাত গেল জাত গেল বলে, ধন্য ধন্য বলি তারে, তিন পাগলের হৈল মেলা নদে এসে, বাড়ির পাশে আরশিনগর, আমি অপার হয়ে বসে আছি- ইত্যাদি গানগুলো ভক্তহৃদয়ে নাড়া দেয় প্রত্যহ।
 
প্রকৃতপক্ষে লালন সাঁই তার গানের মাধ্যমে কোনো ধর্মকে কটাক্ষ করেননি। আবার সুনির্দিষ্টভাবে তিনি কোনো ধর্মের অনুসারীও ছিলেন না। তবে ধর্মের নামে মানুষকে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডিবদ্ধ করে রাখা, মানবতাবর্জিত কাজকেও ধর্মীয় অনুষঙ্গ মনে করা- এসব বিষয়ের প্রতিবাদী কণ্ঠ উচ্চারিত হয়েছে তার গানগুলোতে। লালনের গান শুনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কী যেন একটা বলতে চেয়েছেন- আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত’। এটি মূলত তিনি তৎকালীন ধর্মভিত্তিক সমাজব্যবস্থার অচলাবস্থা ও তা থেকে উত্তরণের পথ হিসেবে সবার আগে মানবধর্মকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত- এই বোধ থেকেই বলেছিলেন।
 
লালন সাঁই তার গানে মানুষ এবং মানুষকেই বড় করে দেখিয়েছেন। লালন মনে করতেন মানুষের মাঝেই এক ‘মনের মানুষ’র বসবাস যার প্রকৃত রূপ সৃষ্টিকর্তা। তাইতো তিনি জীবনভর সেই মনের মানুষকে খুঁজে বেরিয়েছেন যেটি তার গানে ওঠে এসেছে, ‘মিলন হবে কত দিনে? আমার মনের মানুষেরি সনে’। এক্ষেত্রে গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের সঙ্গে লালনের কিছুটা সাদৃশ্য পাই যিনি বলেছিলেন, ‘নো দাইসেল্ফ', অর্থাৎ সবার আগে নিজেকে জানো। আত্মানং বিদ্ধি তথা নিজেকে জানার প্রবল আগ্রহ থেকেই লালন সাঁই তার বিভিন্ন গানে মনের মানুষের বিভিন্ন রূপ তুলে ধরেছেন। ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’ গানে তিনি মানুষের মনের সত্তাকে তুলনা করেছেন অচিন পাখির সঙ্গে যা সহজেই মানুষরূপী খাঁচায় আসা-যাওয়া করলেও তাকে বন্দি করে রাখা যায় না।
 
আগেই বলেছি, লালন তার গানে মানবতাবাদের জয়গান গেয়েছেন। এটা কোনো বিচ্ছিন্ন প্রকরণ নয় বরং যুগের চাহিদাই ছিলো। প্রথমত, লালনের গানগুলোতে তার ব্যক্তিজীবনের বাস্তব প্রভাব ছিলো। দ্বিতীয়ত, যে সময় লালন তার গানগুলো রচনা করেন ওই সময়টিতে ভারতীয় উপমহাদেশ একের পর এক আগ্রাসনে জর্জড়িত ছিলো। বৃটিশদের ক্ষমতা দখল, চিরস্তায়ী বন্দোবস্ত, সিপাহী বিদ্রোহ, ১ম বিশ্বযুদ্ধ, সামন্তবাদের উত্থান সবকিছু মিলিয়ে উপমহাদেশে একটি ভাঙনের অধ্যায় চলছিল। আর সেই ভাঙনে ‘আগুনে ঘি ঢালা’র মতো তাঁতানোর অন্যতম উপাদান ছিলো ধর্মান্ধতা। জাতিভেদ, বর্ণপ্রথা ইত্যাদি বিষয় প্রকট আকার ধারণ করেছিল সমাজব্যবস্থায়। ঠিক তখনই কিছু শিক্ষিত, বোধসম্পন্ন ও মানবদরদী মহৎ মানুষ মানবতার জয়গান গেয়ে মানুষকে এই সমূহ বিপদ থেকে রক্ষা করতে এগিয়ে এলেন। তাদের মাঝে ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ, রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলামসহ কতিপয় কলমসৈনিক। উল্লেখিত ব্যক্তিদের মাঝে কেউ কেউ ভাববাদী ছিলেন, অন্যরা ছিলেন বিদ্রোহী। ফকির লালন সাঁই ছিলেন সেই বিদ্রোহীদের পক্ষে। তিনি সবসময় চেয়েছেন যেনো মানুষ নিজের সত্তাকে চিনে ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় বাড়াবাড়িকে উপেক্ষা করে মানবধর্মের পথে হাঁটতে পারে।
 
লালন সাঁই তার সুদীর্ঘ ১১৬ বছরের জীবনে অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মুখোমুখি হয়েছেন। বাউল গান ও বাউল তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে বহু বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। তথাপিও মানবধর্মের প্রতি অকৃত্রিম মমত্ববোধ তাকে বারবার প্রেরণা যুগিয়েছে। লালনের সেই বাউল গানগুলো এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০০৫ সালে ইউনেস্কো বিশ্বের মৌখিক এবং দৃশ্যমান ঐতিহ্যসমূহের মাঝে বাউল গানকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে। এছাড়াও বিবিসি বাংলার দর্শকশ্রোতা জরিপে বিশ্বের সর্বোচ্চ শ্রবণকরা ২০টি গানের মধ্যে ১৪ নম্বরে রয়েছে লালনের ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’ গানটি।
 
‘সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই’- মধ্যযুগের কবি বড়ু চণ্ডীদাসের এই মর্মবাণীর প্রেষণায় লালন সাঁই আজীবন অক্লান্ত পরিশ্রম ও সাধনা করেছেন ‘মানুষই সত্য’-এ কথা প্রতিষ্ঠা করার। তাইতো আজ শতবর্ষ পরেও লালন সাঁইয়ের প্রতিষ্ঠিত আখড়ায় তার মৃত্যুবার্ষিকীতে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ধারার মানুষ প্রতিবছর টানা তিনদিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা ও গ্রামীণ মেলার মাধ্যমে তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে থাকেন।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৪০৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১৭
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।