ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

নব অন্নের ঋতু | তানিয়া চক্রবর্তী  

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৪১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০১৭
নব অন্নের ঋতু | তানিয়া চক্রবর্তী   নব অন্নের ঋতু | তানিয়া চক্রবর্তী  

বিনয় (কবি বিনয় মজুমদার) লিখেছিলেন “অঘ্রাণের অনুভূতিমালা”। যেখানে থাকতেন সেই ঠাকুরনগরে, কবির স্থানে প্রকৃতির কোলে হেমন্তকাল বোধ করি আরও আদুরে হয়ে আসত। বার বার তার এই লেখায় প্রকৃতি, হেমন্তকাল আর নৈসর্গিক ছোঁয়া এসে জীবনের সংকেত বোঝাতে চেয়েছে।

কার্তিক-অগ্রহায়ণ এই দুই মাস নিয়ে আমাদের হেমন্তকাল, জোড়া মাসের আদরে আতিথ্যে সে ক্ষীণ থেকে প্রবল হয় তাই অন্য ঋতু তথা গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীতের মতো প্রবল না হলেও  কবি লেখকদের কাছে আর প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের কাছে কিন্তু সে দরাজভাবে ধরা দেয়। এশিয়া থেকে ইউরোপ সব মহাদেশেই কিন্তু সে রোমাঞ্চকর ঋতু, ভালোবাসার ঋতু।

মিহিন মনোরম বাতাবরণ তার সান্নিধ্যেই পাওয়া যায়।

জনপ্রিয় কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের দু’টি বিশেষ কাব্যগ্রন্থ হেমন্ত ঋতুর নামে যথা- হেমন্ত যেখানে থাকে ও হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান। তার এই লাইন বোধকরি ভোলার নয়, “আমরা অরণ্যের চেয়েও আরও পুরোনো অরণ্যের দিকে চলেছি ভেসে/ অমর পাতার ছাপ যেখানে পাথরের চিবুকে লীন” (হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান)।
 
হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিক আসলে হিন্দুধর্মের বিশ্বাসেও এক তীব্র গুরুত্বের মাস। শীতের মুহূর্তকে জানান দিতে আর নিজের কিছু রহস্যময় মিহিন রূপ নিয়েই যেনো সে আসে। বলা হয় কৃত্তিকা নক্ষত্রে সূর্যের অবস্থান থেকে এই কার্তিক নামটি এসেছে। হিন্দু ধর্মে এবং স্থানবিশেষে কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশেও ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে এসময় বিষ্ণু ও শিবের পুজো করা হয়ে থাকে। বলা হয়, এই সময় ভারতের পবিত্রতম নদী গঙ্গা সমস্ত খাল, বিল, মোহনায় ঢুকে পড়ে যেনো তাতে পবিত্র জলধারা বহমান থাকে। কার্তিককে দুই ঋতুর মিলনস্থলও ভাবা হয়। এই সময় জীবনকে প্রসন্ন রাখতে ধর্মীয় বিশ্বাসেও দান-ধ্যান-পুজোর কথা বলা হয়ে থাকে। বর্ষার পরে আগত এই ঋতুতে দেবালয়ে দীপদান করা হয়।

ফাইল ছবি
হেমন্ত আসলেই সুখের, প্রসারের আর ব্যপ্তির ঋতু, খেয়াল করলে দেখা যায়- প্রকৃতিও যেনো মানুষকে ভালোবাসার বুলি শেখাতে চায়— গ্রীষ্মের দাবদাহ নেই, বর্ষার জল-কাদা নেই, শীতের প্রাবল্যও নেই। পাতার সঙ্গে নির্মল শিশিরের প্রেম! ভোরে সদ্যজাত শিশুর মতো নধর পাতায় কুয়াশার মিশে মিশে থাকা সব মিলে যেনো একটা আহ্লাদ তৈরি হয়।

তাই কবি বোধহয় বলেছিলেন, “হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে/ কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব কাঁঠাল ছায়ায়” তাই এই ঋতু বোধহয় জীবনানন্দের নবান্নের কার্তিকই বটে। কৃষিপ্রধান, নদীমাতৃক বাংলাদেশে ও ভারতের গ্রামবাংলা বা এই গোটা বাংলায় কার্তিক সুখের জয়গান। নতুন ধানের চালের আগমন, নবান্নের উৎসব। তাই বোধহয় মুঘল সম্রাট আকবর হেমন্তের এক মাস অগ্রহায়ণকে বেছে নিয়েছিলেন রাজস্ব দেওয়ার সময় হিসেবে।

কার্তিকে সোনালি ধানের আলো যেনো প্রকৃত সোনারই বিকল্প, তারপর পাকা ধানের গন্ধ ভরে গেলে তা কাটা হয় আর শুরু হয় উৎসব— এই তো প্রকৃতির সঙ্গে বেঁচে থাকা, গ্রামবাংলার সুখ।  আসলে কার্তিক যে খুব সুখের মাস ছিলো তা না কারণ, তার পরের মাসেই ধান কাটার পালা সেই মাস যদি উপযুক্ত আবহাওয়ার না হয় তবে অগ্রহায়ণে ধান কাটা যাবে না! প্রকৃতিও রূপ বদলায়, অগ্রহায়ণ আসলে পাকা ধান কেটে গরু দিয়ে আঁটি থেকে ধান মাড়িয়ে সিদ্ধ করে তার রূপ পাওয়ার সময়।

তারপর অন্ন, সবজি, পায়েস, ফিরনি সেসব তো গেলো; চালগুঁড়ো থেকে পিঠে-পুলি খাওয়ার সুখ তো আবালবৃদ্ধবণিতা সবারই। তারপর এই মুহূর্তকে উপভোগ করতে সেসব রাতে ঢাকঢোল বাজিয়ে নাচ-গান সে এক জীবনের উন্মাদনা। আসলে জীবন নশ্বর-ক্ষণিকের এটা বুঝে গেলে জীবনকে টেনে নিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তখন সেই জীবন এই ইন্দ্রিয়বাহিত সুখই একমাত্র বাহানা যা দিয়ে ঘোরে বেঁচে থাকা যায়। কৃষকের ঢেঁকিতে ভানা নতুন চালের আনন্দে বাড়িতে জামাই-মেয়েকে নেমন্তন্ন করা, জোগাড় করা সেও এক সুখের প্রয়াস।

তাই যখন বিনয় বলেন, “মানসনেত্রের দেখা দৃশ্যই এ-বাস্তবের দৃশ্যাবলী হয়/ সেই হেতু এ-অঘ্রাণ আমাদের জননের প্রকৃষ্ট সময়” এই কথার মর্মার্থ কোথায় গিয়ে ঠেকে বোধকরি বোঝা যায়। ধানের উৎপাদনকে কেন্দ্র করে এই অগ্রহায়ণ মাসই ছিলো বছরের প্রথম মাস।

প্রাচুর্যের জন্য একে “মা লক্ষ্মীর” মাসও বলা হয়। যদিও প্রভাবে হেমন্ত কম হলেও তার দেওয়া এক নির্মল তেজহীন দুপুর, প্রেমিক প্রেমিক বিকেল আর ভোরের আদুরে শীত; কামিনী, শিউলি, হিমঝুরি (রবিঠাকুরের দেওয়া নাম) এইসব ফুলের সমাবেশ আর সাহিত্য, সংস্কৃতি মানুষের সুখী মুখ এসব কিন্তু হেমন্তের আহ্লাদেই আসে।

শুধু কী বাংলা মাস ধরে এই বাংলাতেই, না, তা কখনও নয়— কবিদের জন্যই বোধহয় সারা ইউরোপজুড়ে হেমন্তের উৎসব লেগে যায় আকাশে, গাছের ডালে, পাতায়-পাতায়। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর এই মাসগুলোর মধ্যে হেমন্তকালীন রূপ এমন ভাষা আনে যে কবির কথা মেনে নিয়েই সত্যি মনে হয়, সেই হিমেল হেমন্ত ছেয়ে যাওয়া অরণ্যে পোস্টম্যান হয়েই ঘুরে বেড়াই আক্ষরিক অর্থে।
 
জন কীটসের লেখা “টু অটাম”, শেক্সপিয়ারের সনেট,  ডব্লিউ এইচ অডেনের লেখা “অটাম সঙ”, ডি এইচ লরেন্সের লেখা “অটাম রেন” এইসব কবিতা যে হেমন্তজাত সন্তানের মতো। হেমন্তের প্যারিস, হেমন্তের জার্মানি, স্কটল্যান্ড, ডৌরো ভ্যালি (পর্তুগাল), পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ডের ল্যাপল্যান্ড, ট্রানস্যালভেনিয়া (রোমানিয়া) আরও কত নাম, এইসমস্ত জায়গার হেমন্তকালীন প্রকৃতির রূপ দেখলে কারও বিশ্বাস না করে উপায় নেই, প্রাণ নিয়ে পৃথিবীতে এসে ঋতুকে বুঝতে পেরে আমরাই সবচেয়ে ভাগ্যবান।

গাছ তার পাতা ঝরার মুহূর্তেও যেনো আরও সুন্দর ও জাগ্রত হয়ে ওঠে এখানে, নদী সেই বিষাদের সুর বহন করে, আভাময় নীল কোথাও কোথাও প্রকৃতি তামাটে লাল— এই হলো হেমন্ত, যার রূপকে তুলে আনতেও রহস্য ও রোমাঞ্চ বোধ হয়!
 
আলবেয়ার কামু বলছেন, হেমন্ত হলো সেই দ্বিতীয় বসন্ত যেখানে প্রত্যেকটি পাতাও ফুল ( AUTUMN IS A SECOND SPRING WHEN EVERY LEAF IS A FLOWER)।
 
ডিলান থমাস বলেছেন, “AND I ROSE IN RAINY AUTUMN AND WALKED ABROAD IN A SHOWER OF ALL MY DAYS”।
 
রবার্ট ব্রাউনিং বলেছেন, “DAYS DECREASE,/ AND AUTUMN GROWS, AUTUMN IN EVERYTHING”।
 
হেমন্তকাল নিয়ে তাই কথা বলতে থাকলে সে শেষ হবে না। প্রকৃতির গ্লাস থেকে উথলে ওঠে সে কবি, লেখক, শিল্পীর ক্যানভাস ও মনে ছেঁয়ে গেছে। ঋতুরাজের আখ্যা যদিও বসন্ত পেয়েছে তবুও কখনও কখনও মনে হয়, একটু স্থায়ী হলে হেমন্তই বোধহয় এই তকমা ছিনিয়ে নিতে পারতো!
 
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০১৭
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।