“উপাসনা নাই গো তার,
দেহের সাধন সর্বসার,
তীর্থব্রত যার জন্য,
এই দেহে তার সব মেলে। “
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার জীবনদেবতার অনুভূতি বোধকরি বাউল গানের মনের মানুষ তত্ত্ব থেকেই এসেছিল! মনের মানুষ আসলে পরমাত্মা।
“আমার মনেরে বোঝাই কিসে। / ভব যাতনা আমার জ্ঞানচক্ষু আঁধার/ ফিরলো রে যেমন রাহুতে এসে/ যেমন বনে আগুন লাগে সবায় তাহা দেখে/ মন আগুন কে দেখে”।
“শুদ্ধ প্রেম রসিকের ধর্ম/ মানে না বেদ বিধির কর্ম/ রসিক বৈ আর কে জেনেছে”।
“সুতোর টানে পুতুল যেমন/ নেচে ফেরে সারা জনম/ নাচায় বাঁচায় সেহি একজন/ গুরু নামে জগৎ জুড়েছে”।
“খালি ভাঁড় থাকবেরে পড়ে/ দিনে দিনে কর্পূর তোর/ যাবেরে উড়ে। / মন যদি গোল মরিচ হতো/ তবে কি আর কর্পূর যেতো/ তিলক আদি না থাকিত সুসঙ্গ ছেড়ে“।
এরকম অনবদ্য সব চারণ তিনি রচনা করে গেছেন, তিনি লালন সাঁই, তার বোধের জোরে তার বার্তা শুধু দেশে নয় পৃথিবীর আনাচে-কানাচে বিস্তৃত!অতিন্দ্রিয় বাদ বা ব্রহ্ম উপাসনা যাই বলি, এ আসলে স্নিগ্ধ মরমি (MYSTIC) জীবনের জয়গান। যা এই পৃথিবী ও তার মধ্যস্থিত নশ্বর জীবন নিয়ে অস্থির না হয়ে স্থিরতার বার্তা কায়েম করে।
এই তীব্র ধ্বংসমূলক, দল সৃষ্টি করা, হিংসে করা, খুন করা, ধর্ষণ করা এতে কী আদৌ সুখ রচিত হয়! সুখের রচনাতে এক নিশ্চিত মন্ত্র হলো এই লালনগীতি! রূপক থেকে উঠে এসে জীবনের তারল্যে মিশে তার মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে সাঁতার কাটলে যে তীরে এসে বসতে হয় তা শান্তির! তাতে অনুভূতি ভরপুর থাকে!
“মরে ডুবতে পারলে হয়/ মরে যদি ভেসে ওঠে/ মরায় কী ফল তায়/ মরা তো অনেক মরে/ ডুবা কঠিন হয় গভীরে/ মৃত্তিকাহীন সরোবরে/ থাকলে স্বরূপ আশ্রয়”।
লালন শাহের একটিমাত্র খড়ের ঘর ছিলো, সেই ঘরেই তার রচনা, তার ভাব আসা আর সেখানেই গানবাজনা চলত। কথিত রয়েছে, রবিঠাকুর নিজেই লালন শাহের আঁখড়ায় গিয়ে গান শুনতেন!
এবার আসি দেওয়ান হাছন রাজার কথায়! মূলত খুব অল্প বয়সেই তিনি জমিদারির ভার হাতে নেন। বাংলাদেশের পূর্বপ্রান্তের সিলেটই ছিলো তার জন্মস্থান! তিনি তীব্র ভাবে স্ব-শিক্ষায় শিক্ষিত এক এক মরমি সূফি সাধক ছিলেন!
“পিরিতের মানুষ যারা আউলা ঝাউলা হয়রে তারা/ হাসনরাজায় পিরিত কইরা হইয়াছে বুদ্ধি হারা”।
এরকম অজস্র লেখায় তার জুড়ি মেলা ভার! তবে তার বেশীরভাগ লেখায় তিনি নিজের নাম উল্লেখ করেছেন! এটা একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
“ও মন দামের বৈঠা বাইও/ ভবসিন্ধু অইতায় পার নাওনি ডুবে চাইও/ দমে দমে প্রাণবন্ধের নিজ নাম জপিও”— এই চারণটি হলো বাউল শিতালং শাহের। তার জন্ম হয় সিলেটে। তিনি ভুবন পাহাড়ে বারো বছর তপস্যা করেন! তারপর থেকে থেকে তার রচনাকাল শুরু হয়!
তার গানগুলি তার প্রধান শিষ্য হাজী আসগর আলী লিপিবদ্ধ করে রাখতেন!
“সইলে সম্পত্তি নইলে বিপত্তি/ খাটবে না আপত্তি বিচারের সময়/ হইলে শুদ্ধ মতি তবে হবে ভক্তি/ এই উক্তি যুক্তিশস্ত্রে শোনা যায়”।
“ভবে কে কয় মানুষ মরে/ হিন্দুর ইষ্ট দেবতা হয় মরা শব্দ উলটো করে”।
লালন সঙ্গীতের মৌলিক ধারাটি তিনি ধরে রেখেছিলেন, তিনি খোদা বক্শ শাহ। শোনা যায়, বাল্য বয়সে তার অপূর্ব সুরেলা কণ্ঠের জন্য তাকে যাত্রাদলে অভিনয়ে নেওয়া হতো, প্রায় পাঁচশো লালন গীতি তার মুখস্থ ছিলো। তিনি বাংলাদেশ সরকার দ্বারা বিশেষভাবে সম্মানিত।
স্বভাব বিষয়ে তার গীতি, “থাকিতে স্বভাব হবে না সে ভাব/ যে ভাবেতে লাভ হয় নিরঞ্জন/ হইলে সুভাব যাইবে অভাব, নিত্য নতুন ভাব দেখবি নয়নে”।
লালনের গান আসলে জীবনের গীতি, আর তার মূল বোধ থাকে ব্যক্তির হৃদয়ে যা থেকে জারিত হয়ে এক পরিপূর্ণ সাধকের জন্ম হয়! লালন আসলে মিলনের গান! আমাদের ভাঙন, এই অবারিত খেলার পঞ্চত্বপ্রাপ্তির সত্য সব মিলে এক বিশাল প্রশমনের মাটি হলো এই গীতি! এই ধরাধামে মানুষ হয়ে এসে সেই মর্ম বুঝে চলে যাওয়া তবেই তো মনুষ্যত্বের মুক্তি! আমরা মূলত বোধের খেলা খেলতে এসেছি। সে খেলা না জমাতে পারলে এ দেহ কাঠ বৈকি কিছু নয়।
উন্নত পৃথিবীর বোধই লালনের বোধ! তাই অন্তরে লালন করো লালন...
বাংলাদেশ সময়: ১৫১০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০১৮
এসএনএস