পশ্চিমবঙ্গের পূর্বমেদিনীপুর জেলার হলদিয়ায় ২৭, ২৮ ও ২৯ জানুয়ারি বসে এ অঞ্চলের সৃজনশীল মানুষের সবচেয়ে বড় ও আলোচিত উৎসব। সমাপনী সন্ধ্যার জ্যোৎস্নালোকিত পরিবেশে বিষাদাক্রান্ত কণ্ঠে অনুষ্ঠান সঞ্চালক কবি আশীস মিশ্র যখন উৎসব শেষের বিউগল বাজালেন, তখন চারদিকে ভাঙনের বিষাদসুর।
নলেজ সিটির মেরিন কলেজ প্রাঙ্গণে তৈরি ঢাউস প্যান্ডেল ও উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে বসে সৃজনশীলদের এই মিলনমেলা। বসে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠের একাধিক আসর। গল্পকাররা অনুগল্প পাঠ করেন। লিটলম্যাগ সম্পাদকরা প্রদর্শন করেছেন তাদের সাহিত্য পত্রিকা। শিল্পী এঁকেছেন ছবি। স্বনামখ্যাত কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিকরা রেখেছেন নানা ভূমিকা। সাহিত্য, শিল্পকলা, সংস্কৃতি, অনলাইন মিডিয়া, সমসামিয়ক বিশ্ব চালচিত্র ইত্যকার বিষয়ে অংশগ্রহণকারীরা আড্ডা-আলোচনা-বিতর্কে সারাক্ষণ উৎসব আঙিনা মুখর করে রাখেন।
পুষ্পার্ঘ্য, শোভাযাত্রা, প্রজ্জ্বলন
পুষ্পার্ঘ্য প্রদান, শোভাযাত্রা ও প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মধ্য দিয়ে উৎসবের পর্দা উন্মোচন হয়। ২৭ জানুয়ারি সকাল ন’টায় হলদিয়া আর্যভট্ট গ্রন্থাগার প্রাঙ্গণে আয়োজনের পথিকৃৎ প্রয়াত তমালিকা পন্ডাশেঠ এর পূর্ণাকার ভাস্কর্যে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হয়। পরে কবি-সাহিত্যিকরা শোভাযাত্রাসহ এইচআইটি প্রাঙ্গণ মূল উৎসব মঞ্চ প্রাঙ্গণে আসেন। সেখানে জাতীয় সঙ্গীত ও গার্ড অব অনারের মাধ্যমে উৎসবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ড. লক্ষণ পন্ডাশেঠ জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। পরে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল কবি কেশরীনাথ ত্রিপাঠী আসেন এবং প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করে উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।
উদ্বোধনীতে অতিথি অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কথাসাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ, প্রবীণ কবি প্রণব কুমার মুখোপাধ্যায়, জাতিসত্তার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, টাঙ্গাইল জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান ফারুক। স্বাগত বক্তৃতা দেন উৎসব সভাপতি কথাসাহিত্যিক নলিনী বেরা। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন উৎসব সাধারণ সম্পাদক কবি-সাংবাদিক শ্যামলকান্তি দাশ। এতে রাজ্যপালের অনুরোধে কবিতাপাঠ করেন বাংলাদেশের কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা এবং রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী।
স্বনামখ্যাতদের উজ্জ্বল উপস্থিতি
বিভিন্ন অধিবেশন ও আড্ডা আলোচনায় উপস্থিত হন ভারত, বাংলাদেশ, প্রবাসের বহু স্বনামখ্যাত লেখক-সাংবাদিক–সংগঠক। সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ, কথাশিল্পী শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, প্রবীণ কবি প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়, কথাসাহিত্যিক দেবেশ রায়, মৃদুল দাশগুপ্ত, মুহম্মদ নূরুল হুদা, রণজিৎ দাশ, তপন বন্দোপাধ্যায়, কৃষ্ণা বসু, কালীকৃষ্ণ গুহ, সাংবাদিক সুমন চট্টোপাধ্যায়, চিত্রা লাহিড়ী, শিল্পী শ্যামল জানা, সুজিত সরকার, ‘লাল পাহাড়ে দেশে যা’ সঙ্গীতের গীতিকার অরুণ কুমার চক্রবর্তী, তনুশ্রী ভট্টাচার্য, বৃক্ষপ্রেমিক ও কবি কমল চক্রবর্তী প্রমুখ।
উৎসবে ‘তিন বাংলা’র কবি-সাহিত্যক
উৎসবে পশ্চিমবঙ্গের কবি-সাহিত্যিকদের পাশাপাশি অংশ নেন ‘তিন বাংলা’ তথা প্রবাসী ও বাংলাদেশের কবি-লেখক-সাংবাদিক-বাচিকশিল্পী ও সংগঠকরা। এতে বাংলাদেশ থেকে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, ফজলুর রহমান ফারুক, ঝর্ণা রহমান, কথাশিল্পী রফিকুর রশীদ, কবি ফারুক মাহমুদ, কবি মাহমুদ কামাল, বুলবুল মহলানবীশ, আসলাম সানী, সালেম সুলেরী, সৈয়দ আহমদ আলী আজিজ, মজিদ মাহমুদ, মাহমুদ হাফিজ, শান্তা মারিয়া, সন্তোষ ঢালী, শাহীন রিজভী, চৌধুরী বাবুল বড়ুয়া, শাহাদাৎ হোসেন নিপু, কৌমুদী নার্গিস, হামিদ রায়হান, সীমা ইসলাম, শ্রুতি খান প্রমুখ। ‘তিন বাংলা’ সংগঠনের গ্লোবাল সভাপতি সালেম সুলেরীর নেতৃত্বে প্রবাস ও বাংলাদেশের কয়েকজন কবি-বাচিক শিল্পী এতে অংশ নেন।
নিউইয়র্ক, দিল্লি, মুম্বাই, উত্তরপ্রদেশ, ত্রিপুরা, মহারাষ্ট্র, আসাম, ঝাড়খণ্ড, মেঘালয়, আন্দামান, অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে অংশ নেন তনুশ্রী ভট্টাচার্য, গৌতম দাশগুপ্ত, ড. ইলা মুখোপাধ্যায়, সুকুমার চৌধুরী, জগৎ দেবনাথ, চন্দ্রিমা দত্ত, কমলচক্রবর্তী, শামল শীল, গৌতম গোস্বামী, ফাল্গুনী চক্রবর্তী, অনাদিরঞ্জন বিশ্বাস, স্মৃতি দাস।
কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ
উৎসবের সিংহভাগ সময়জুড়ে চলেছে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ। দূর-দূরান্ত থেকে আসা ব্যতিক্রমী বেশভূষা পরিহিত কবিরা স্ব স্ব ভঙ্গিমায় কবিতাপাঠ করে সবাইকে আনন্দিত করেন। তিনদিনে ভিন্ন ভিন্ন সেশনে কবিতাপাঠে অংশগ্রহণ করেন পাঁচ শতাধিক কবি। কবিতাপাঠের পরে হয়েছে নিরন্তর চা চক্র ও আড্ডা। সকাল নয়টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত চলা অনুষ্ঠানের সিংহভাগই ছিল কবিদের দখলে। তাদের উচ্চকণ্ঠে আবেগময় আবৃত্তির অনুরণন দূরাকাশে ছড়িয়ে পড়ে।
আলোচনাসভায় প্রাণবন্ত বিতর্ক
কবিদের কবিতাপাঠের বাইরে উল্লেখযোগ্য কবি-কথা-সাহিত্যিক ও সাংবাদিকদের অংশগ্রহণে প্রাণবন্ত বিতর্ক হয়। অভ্যাগতদের আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিল ‘সোস্যাল মিডিয়া কি সাহিত্যকে গ্রাস করছে’ শীর্ষক আলোচনা। এতে সভামুখ্য ছিলেন ড. লক্ষণ শেঠ, অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বৃক্ষসখা কবি কমল চক্রবর্তী। অংশগ্রহণ করে বর্ষীয়ান কবি সুজিত সরকার, কবি-সমালোচক নিতাই জানা, কবি উর্মিলা চক্রবর্তী, বাংলানিউজের কন্ট্রিবিউটিং এডিটর কবি-ভ্রমণলেখক মাহমুদ হাফিজ, পশ্চিমবঙ্গের কবি-কথাসাহিত্যিক আয়েশা খাতুন, বাংলাদেশের কবি শাহীন রিজভী, মহারাষ্ট্রের কবি ও লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক সুকুমার চৌধুরী প্রমুখ। আলোচনাসভায় অনলাইন সাহিত্যচর্চার সুফল-কুফল নিয়ে প্রাণবন্ত বিতর্ক হয়।
প্রয়াত কবি তমালিকা পন্ডাশেঠ স্মারক বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘বাংলা সাহিত্য ও সাংবাদিকতা’। এতে অংশগ্রহণ করেন কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সাংবাদিক সুমন চট্টোপাধ্যায়, রুপা মজুমদার, কস্তুরী চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। সাংবাদিক সুমন চট্টোপাধ্যায় লিটারারি জার্নালিজমের প্রসঙ্গ তুলে নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা করেন।
‘সমাজ জীবনে ভারতীয় দর্শনের প্রভাব’ শীর্ষক আরেক আলোচনা ড. লক্ষণ শেঠ এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত হয়। এতে সঞ্চালকের বক্তব্য সবাইকে চমকিত করে।
কবিতা, আলোচনার মাঝে মধ্যে ছিল শিল্পীদের সঙ্গীত পরিবেশনা, নৃত্য, ঝুমুর গান, বাচিক শিল্পীদের আবৃত্তি। উৎসবের দ্বিতীয় দিন শেষে ঝুমুর সম্রাজ্ঞী ইন্দ্রানী মাহাতো ও তার দলের পারফরম্যান্স ও ঢোল-ধামসার তাল উপস্থিত কবিদের নৃত্যপাগল করে তোলে।
উত্তরীয় উপহার
রুটিন আনুষ্ঠানিকতার বাইরে ছিল অনানুষ্ঠানিক উত্তরীয়-উপহার তুলে দেওয়া উদ্যোক্তা-অতিথি উভয় দিক থেকেই। ‘তিন বাংলা’ সংগঠনের গ্লোবাল সভাপতি কবি সালেম সুলেরী উৎসব আয়োজকদের ১১ জনকে উত্তরীয় উপহার দেন। মাহমুদ হাফিজের সঞ্চালনায় উত্তরীয়-উপহার অনুষ্ঠানটিতে বাংলাদেশের কবি সাহিত্যিকদের অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে আয়োজকদের উপহার দেন বুলবুল মহলানবীশ, আসলাম সানী, মাহমুদ হাফিজ, শাহাদাৎ হোসেন নিপু, শান্তা মারিয়া, মৌ চক্রবর্তী প্রমুখ।
উৎসবের পক্ষ থেকে কবি সাহিত্যিকদের উত্তরীয়, বই, ব্যাগ, কলম উপহার হিসেবে দেওয়া হয়।
বর্ণাঢ্য-বর্ণিল
বিশ্ব বাংলা কবিতা উৎসব কেন্দ্র করে হুগলী নদী দুহিতা হলদিয়া টাউনশিপ কবিতা ও শিল্পের শহরে পরিণত হয়। মূল প্রাঙ্গণসহ অন্য স্থাপনার সুসজ্জা স্থানীয় বাসিন্দা ও অভ্যাগত অতিথিদের নজর কাড়ে। উৎসব উপলক্ষে বহুবর্ণিল আলোকমালায় সজ্জিত করা হয় নলেজ সিটির একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও প্রাঙ্গণ। এ উপলক্ষে স্থানীয় শিক্ষার্থীরা রাত জেগে শিল্পময় আল্পনা এঁকে কাব্যমুখর উৎসবকে দান করে শিল্পময় নান্দনিকতা। শহরের মোড়ে মোড়ে টাঙানে হয় উৎসবের ব্যানার। স্থানীয় আবাসিক হোটেল, রেস্তোরাঁ, শপিং মল ও রাস্তায় উৎসবের ব্যাগ কাঁধে কবিদের পদচারণা পুরো শহরকে একটি নান্দনিক চেহারা দেয়।
উৎসবের দৈনন্দিন
উৎসবের বাইরে দৈনন্দিন জীবনযাপন ছিল সুশৃঙ্খল ও উল্লেখযোগ্য। সুব্যবস্থাপনা ও প্রাণের ছোঁয়ায় হলদিয়ায় আগত কবি-সাহিত্যিকদের তেমন বিড়্ম্বনায় পড়তে হয়নি। দূরাগত কবিদের উৎসব প্রাক্কালে কলকাতা ইনস্টিটিউট অব ফাইন আর্টস থেকে বাস ও গাড়িতে হলদিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। কবিদের থাকার জন্য শহরের আবাসিক হোটেলগুলোতে কক্ষ বরাদ্দ, যাতায়াতের জন্য গাড়ি ও বাস, উৎসব প্রাঙ্গণে চারবেলা খাওয়া ও সারাক্ষণ চায়ের ব্যবস্থা করা হয়। আবাসিক হোটেল কবি-সাহিত্যিকদের গ্রুপে গ্রুপে মুখর আড্ডা-আলোচনায় মুখর হয়ে ওঠে।
আয়োজনের প্রাণভোমরা
২০০২ সালে শুরু হওয়া ব্যয়বহুল আয়োজনের প্রাণভোমরা ছিলেন প্রয়াত কবি তমালিকা পন্ডাশেঠ। তার প্রতিষ্ঠিত ‘সাপ্তাহিক আপনজন’ পত্রিকার ব্যানারে এই আয়োজন। ২০১৬ সালে তার মৃত্যুর পর এর হাল ধরেছেন তার স্বামী রাজনীতিক ও সংস্কৃতিসেবী সাবেক এমপি লক্ষণ শেঠ। সঙ্গে আছেন দুই পুত্র ‘আপনজন’ এর প্রকাশক সায়ন্তন শেঠ ও সম্পাদক সুদীপ্তন শেঠ। পুত্রবধূ স্থপতি সুস্মিতা পন্ডাশেঠও এ আয়োজনের নেপথ্য কারুকার। বিশাল আয়োজনে পরামর্শ সহায়তা দেন সমাজেসবী প্রণব দাস, সুদর্শন মান্না, আশিস লাহিড়ী ও কমল বিষয়ী। উৎসব সংগঠকের দায়িত্বে আছেন কমিটির সভাপতি নলিনী বেরা, সাধারণ সম্পাদক শ্যামলকান্তি দাশ। কবি-সাংবাদিক আশীস মিশ্র রয়েছেন উৎসব আয়োজন, পরিচালনা ও উপস্থাপনাসহ নানা দায়িত্বে।
লক্ষণশেঠ পেশায় রাজনীতিক হলেও শিক্ষানুরাগী ও সংস্কৃতিসেবী মানুষ। হলদিয়ায় ১৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে তিনি বর্ধিষ্ণু বন্দর শহরটির চেহারা আমূল বদলে দিয়েছেন। বিশ্ববাংলা কবিতা উৎসব আয়োজন তার মেধাচর্চা ও পৃষ্ঠপোষকতার আরেক দিগন্তে পরিণত হয়েছে।
উৎসবে অন্যতম লক্ষ্যণীয় বিষয় ছিল লক্ষণ শেঠের উজ্জ্বল উপস্থিতি। প্রায় প্রতিটি সেশনেই উপস্থিত থেকে তিনি সঞ্চালক, বক্তা কিংবা পর্যবেক্ষক হিসেবে নিজেকে যুক্ত রাখেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০১, ২০১৮
এএ