এই পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কারণে আমরা আন্দোলিত হই। আমার ধারণা, কবিতার কাজ হচ্ছে তাই – আমাদেরকে কোনো না কোনোভাবে আন্দোলিত করা।
জুননু রাইন তার ‘এয়া’ বইটি আমাকে পড়তে দিয়েছেন, এটা আমার জন্য আনন্দের বিষয়। আমি তার অনেকগুলো কবিতা একসঙ্গে পড়তে পেরেছি। এই বইয়ের কবিতাগুলো তিনি দু’ভাগে ভাগ করেছেন – একাংশে আছে ‘এয়া’ শিরোনামের ছত্রিশটি কবিতা, আর অন্য অংশে আছে আলাদা আলাদাভাবে লেখা সতেরটি কবিতা। তার কবিতা পড়ে আমার মনে হয়েছে জুননু এক নিঃসঙ্গ মানুষের বেদনা ও আর্তি তুলে ধরেছেন। সৃষ্টিশীল লেখকেরা যে নিঃসঙ্গই থাকেন তা কে না জানেন; সৃষ্টির সময়ে তার একাকিত্ব কেবল লেখকের বিষয় নয়, সম্ভবত যে কোনো শিল্প মাধ্যমের জন্যেই সত্য। কিন্ত জুননু’র কবিতা কেবল সেই নিঃসঙ্গতার কথা বলছে না; বলছে আমাদের এই সময়ে প্রত্যেকটি মানুষের একাদিক্রমে অন্তর্গত নিঃসঙ্গতার কথা এবং এই সময়ের এক বৈশিষ্ট্যের কথা। জুননু রাইনের কবিতা এই সময়েরই ছবি। আমি তার কবিতার ভেতরে তাই দেখতে পাই। জুননু’র কয়েকটি লাইন পড়লে আমাদের বুঝতে সুবিধে হবে - ‘প্রথমেই বলেছিলাম আমি একা,/ সেই চিৎকারে বারবার বলেছি মানুষ একা/ এরপরে খেলতে গিয়ে আমি যতবার জিতেছি হেরেছি/ বা খেলতে পারিনি, ততবার জেনেছি আমি একা’ (আবুল হাসানের একাকিত্বকে); ‘অপেক্ষারা দাঁড়িয়ে; দাঁড়িয়ে আমার জন্য/ এক ঝুড়ি ক্লান্তির ঝরা ফুল নিয়ে/ আমার অলসতা দেখে নিরলসভাবে জড়ো হচ্ছে’ (অপেক্ষারা দাঁড়িয়ে); ‘আমি এমনই- / আমি আমার ছায়ার পেছনে হাঁটি’ (যখন আমি আমার নিঃসঙ্গতার)। জুননু রাইনের কবিতা কোন সময়ের সেটা বুঝতে আমাদের কষ্ট হয় না: ‘প্রতিটি স্বপ্নকে আতঙ্ক জাপটে ধরে ঘুম পাড়ায়/ প্রতিটি ঘুম বাতাসের পোড়া গন্ধ হয়ে উড়ে যায়/ প্রতিটি পাখি মানুষকে অনিশ্চিত মৃত্যুর স্বাভাবিকতা শেখায়’ (অনীহাকে অদৃশ্য হুমকি); ‘আমার ব্যর্থতাগুলো গভীরভাবে সফল। আতঙ্কের চাষাবাদে ভরপুর’ (ব্যর্থতাগুলোর গভীর সফলতা)।
নিঃসঙ্গতা এবং সময়ের অস্থিরতা স্বত্বেও জুননু রাইনের কবিতা এক ধরনের নম্রতার আবরণে ঢাকা। কিন্ত তিনি হতাশ নন। তিনি আশা করেন যে, এই সময়ের অন্ধকার এবং ব্যর্থতাগুলো চূড়ান্ত নয়। যে কারণে তিনি লিখতে পারেন – ‘একদিন বৃষ্টি হবে/ব্যথিতের রক্তক্ষরণের/ গুঁড়ো গুঁড়ো দারিদ্রের শব্দে/ সূর্যের লাল চোখরাঙানি ঝরিয়ে/ শতাব্দী থেকে শতাব্দী দীর্ঘ আর্তনাদে/ ... একদিন বৃষ্টি হবে’ (বৃষ্টি)। জুননু’র এই আশাবাদের সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে ‘এয়া’ শিরোনামের কবিতাগুলো। ‘এয়া’ মেসোপটেমিয়ার পুরাণের চরিত্র; তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে মহাকাব্য গিলগামেশের সূত্রে। ‘এয়া’র এক পরিচয় হচ্ছে সে জ্ঞান এবং বিশুদ্ধ পানির দেবতা। জুননু’র কবিতায় ‘এয়া’ নতুন করে নির্মিত হয়। 'এয়া' হচ্ছে প্রার্থিত মানুষের, সময়ের স্বপ্ন।
জুননু’র কবিতার আরকেটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলা দরকার। তার কবিতাকে আমি সচিত্র কবিতা বলে ভাবি, কেননা জুননু সহজে ছবি তৈরি করেন এবং পাঠকেরা তার সঙ্গে ওই ছবির ভেতরেই বসবাস করতে শুরু করেন। সেটা তার যে কোনো কবিতা পাঠ করলেই বোঝা যায়; যেমন – ‘মাকে খুব মনে পড়ছে/ অনেকগুলো ঝরে পড়া মুখরতা পরে/ সেদিন মা বসেছিলেন চৈত্রের বারান্দায়/ অভ্যেসের হাতপাখার বাতাসে/ বয়সগুলোর উড়ে যাওয়া ধানের চিটায়/ হাতির চোখে মিটি মিটি তাকাচ্ছিল মা'র সময়’ (মায়ের জন্যে কবিতা)।
জুননু রাইনের কবিতার এইসব বৈশিষ্ট্য কেবল আমাদের মনোযোগ দাবি করে তাই না, আমি মনে করি তার কবিতাকে এক ধরনের স্বাতন্ত্র্যও দেয়। সেই স্বাতন্ত্রের স্বাদ পেতে হলে তার কবিতা পড়তে হবে। তার এই কবিতা গ্রন্থ আমাদের জন্যে তার কবিতা পাঠের কাজটা সহজ করে দিয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১২৫৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০১৮
এসএনএস