ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

লেখকের গল্প | লুৎফর রহমান সোহাগ

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২৯ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০১৮
লেখকের গল্প | লুৎফর রহমান সোহাগ ​​লেখকের গল্প | লুৎফর রহমান সোহাগ

১.
বইমলার পর্দা নামবে আজ। পাঠকের ভিড় ছেড়ে অনিমেষ বসে আছে শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরি চত্বরে। লেখালেখি করে সে। ছোটবেলার বন্ধু সৌরভের সাথে চায়ের ফাঁকে গল্প চলছে। সৌরভ পেশায় চিকিৎসক, লেখক বন্ধুকে পেয়ে তার স্মৃতি যেন ডানা মেলেছে।

- তুই কত বদলে গেলি! ঠিক নামের মতো।
- মানে?
- ওই যে....মনে নেই? ছোটবেলায় তোর কী লম্বা এক নাম ছিলো! তা নিয়ে আমরা সবাই হাসতাম।


- বাদ দে না।
- আরে বুঝছি তো, লিখতে হলে একটু-আধটু নাম পরিবর্তন আনতে হয়। সত্যি বলতে, তুই কী দারুণ লিখিস!
- তেমন কিছুই না, মাত্র তো চেষ্টা শুরু করলাম।
- এটা তোর বিনয়। সেদিন যখন তোর বই কিনলাম, কত বছর পর দেখা! কী সুন্দর নিজেই ছবি তুললি আমার সাথে, সেটা আবার ফেসবুকেও দিলি। অথচ আগে লেখকরা কী ভাব ধরে থাকতো! তুই একেবারে ব্যতিক্রম।
- রাখ তো প্যাচাল। জরুরি যেটা বলতে ডেকেছিস সেটা বলে ফেল।
- শোন, তুই অনেক দারুণ লিখিস। তো লেখাটা একটু ফেসবুকে দিতেই লাইক-কমেন্টে ভরে গেছে।
- জরুরি কথাটা বল, একটু তাড়া আছে।
- পরশু গ্রামে গিয়েছিলাম, বছর দুয়েক পর। সবাই তোর কথা বললো। এলাকার ছেলে, কত বড় লেখক! চারটে চ্যানেল আর ছয়টা পত্রিকায় সবাই তোকে দেখেছে। তারা চাইছে একটা সাহিত্যের সভা করবে, তুই থাকবি আমাদের মধ্যমণি।

২.
দুই বন্ধুর কথায় কথায় বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। কথা চলতেই প্রকাশকের কল বেজে ওঠে। অনিমেষ ব্যস্ত হয়ে ওঠে। এরপর সোজা বইমেলায়। বইমেলায় যেতেই রুদ্রমূর্তি প্রকাশকের।
- বখশিশ দিয়ে দুইটা ক্যামেরা আনলেই কি বড় লেখক হওয়া যায়? একশো কপি বইও তো বিক্রি হলো না! এসব লেখকের বই কেন ছাপবো? এমন চললে ব্যবসা লাটে উঠবে।
- বইয়ের জন্য তো আপনাকে টাকাও দিয়েছি।
- এমন আগাছা লিখলে তো দিতেই হবে।
- বিক্রি হলেই লেখক, না হলে লেখক না?
- ছাইপাশ লিখে তো হুমায়ূন হতে পারবেন না। লোকে না পড়লে কি বই বের করে পূজা দেবেন?

এরপর গজগজ করে চলে গেলেন প্রকাশক। নিমেষেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো, হতাশ অনিমেষ ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। আশেপাশে আরও কয়েকজন লেখক, তাদের অবস্থাও একই। পেছনে সারি সারি বই গোছাচ্ছেন স্টলকর্মীরা, অবিক্রিত বই যেন সবচেয়ে মূল্যহীন। অনিমেষের কাছে যা সন্তানের মতোই আপন।
 
৩.
রাতে একটু দ্রুতই বাসায় ফেরে অনিমেষ। এক মাসের ক্লান্তি আর শেষ হিসেবে যেন তার শরীরটা চলছে না। সিঁড়ি বেয়ে উঠে কয়েকবার বেল চাপে, দরজা খুলতেই অনিমেষকে দেখে ব্যস্ত হয়ে ওঠে সুরভী।
- তুমি কি রাগ করেছো?
- না, ব্যস্ত ছিলে নাকি?
- না তো!
- দরজা খুলতে এত দেরি হলো?
- আরে অফিসের কলিগের একটা স্ট্যাটাস পড়ছিলাম, খুব সুন্দর লেখাটা।
- ও... কাপড় বদলাতে শুরু করে অনিমেষ।
- যাক, মেলা শেষ। এখন থেকে তোমাকে পাওয়া যাবে। আচ্ছা- বইমেলা যে শেষ হলো, আমার জন্য কী আনলে?
- কেন, এতগুলো বই নিয়ে আসলাম দেখোনি!
- আরে বাপ, তোমার বইয়ের প্রথম ক্রেতা তো আমি। সেটা তো আগেই পড়ে শেষ করেছি। শুধু তোমার কারণে পড়া।

সুরভী অনেক বই পড়ে, তব সেসব সাহিত্যের না। সাহিত্য নিয়ে তার কোনো আগ্রহ নেই। ইদানীং অবশ্য ফেসবুকে ছোট ছোট গল্প পড়তে তার ভালোই লাগে। সাহিত্যের প্রতি অনাগ্রহ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই অনিমেষের সঙ্গে তার খোচাখুচি। তাই, বইমেলায় অনিমেষের ব্যস্ততাও তাকে ছুঁয়ে যায়নি।  

৪.
একমাস পর স্বামীর সঙ্গে রাতে খেতে বসেছে সুরভী। কিন্তু অনিমেষের মেজাজ দেখ কোনো কথা বাড়ায়নি। ক্লান্ত অনিমেষ দ্রুত বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দেয়। একটু পর পাশে এসে হাত রাখে সুরভী।
- মনটা খারাপ বুঝছি। কিন্তু চিন্তার কী আছ, আস্তে আস্তে তোমার পরিচিতি বাড়বে। প্রথম দিনই তো হুমায়ূন হয়ে যাওয়ার দরকার নেই।
- হুমায়ূন আর তৈরি হবে না।
- বলেছে তোমাকে! কেউ না কেউ তো আসবে।
- আসবে হয়ত কেউ... কিন্তু মানুষ আর বই কিনবে না। বই বিক্রির এটা শেষ শতাব্দী।
- মাথা ঠিক আছে? আমার চাকরির বই কয় হাজার বিক্রি হয়েছে জানো?
- আমি সাহিত্যের কথা বলছি।
- সুনীলের বই তো এখনও মানুষ কেনে। ভালো লেখো, ঠিক পাঠক পেয়ে যাবে।
- তুমি তো অনেকগুলো রবীন্দ্রনাথ কিনলে, পড়েছো? প্রতিদিন ইংরেজি পত্রিকা রাখো, পড়ো?
- আরে বাবা... না পড়ি, কিন্তু একটা স্ট্যাটাস আছে না? মাস্টারি করি, ঘরে কিছু বই সাজাতে হবে না?
- সবাই এমনই সাজায়। শরৎচন্দ্র আসলেও এখন ফ্লপ মারতো। প্রকাশকদের ধরে বই বের করা, মিডিয়াবাজি, পরিচিতদের অনুরোধ করা, পাঠক ধরে ফেসবুকে ছবি দেওয়া- এসব এ যুগে বঙ্কিমকেও করতে হতো। এরপরও পরিচিতদের বাইরে বই যেত কিনা সন্দেহ।
- তো, এখন কী ভাবছো?
- আর বই বের করবো না।
- তাহলে তুমি আর লিখবে না! যাক, তোমার সাথে তাহলে বেশি সময় কাটানো যাবে।
- লিখবো না তা তো বলিনি। তবে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করতে হবে।
- বুঝেছি, মাথা পুরো গেছে। হয়েছে, এবার ঘুমাও।

৫.
আজ দ্রুতই বিছানা ছাড়ে অনিমেষ। ভোরে বারান্দায় অনিমেষকে পায়চারি করতে দেখে অবাক হয় সুরভী। এতদিন একটি বই প্রকাশের স্বপ্নে প্রতিটি ভোর আসতো অনিমেষের। সেই স্বপ্ন কত দ্রুত চুকে গেলো! এখন নতুন পথের সন্ধান পেতে হবে তাকে, পাঠককে ভিন্নভাবে পড়ানোর পথ।

একদিন অনিমেষ সেই পথের সন্ধান পেয়েছিল।

বাংলাদেশ সময়: ১৬২৬ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০১৮
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।