তার বিখ্যাত থ্রিলার উপন্যাস। এসব উপন্যাসের নায়ক রবার্ট ল্যাংডন।
ব্রাউনের এসব উপন্যাসে প্রধান চরিত্র, ল্যাংডন। পাশাপাশি এসবে মটিফ হিসেবে এমনভাবে ঐতিহাসিক বিষয়বস্তু এবং খ্রিস্টানত্ব অন্তর্ভূক্ত হতে দেখা যায়, যা বিতর্ক উসকে দেয়। তার থ্রিলার নোভেল দ্য ভিঞ্চি কোড এর শুরুতেই প্যারিস ল্যুভর মিউজিয়ামে এক লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়। এই খুনের সঙ্গে জড়িয়ে যায় প্রধান চরিত্র ‘সিম্বলজিস্ট’ প্রফেসর রবার্ট ল্যাংডনের নাম। রহস্য ভেদ করতে আরও এগিয়ে আসেন ক্রিপ্টোলজিস্ট সফি নাজে। ঘটনার অব্যবহত পরই এ দু’জন, তাদের প্রতীক ও ক্রিপ্টোগ্রফির জ্ঞান ব্যবহার করে, পরস্পরবিরোধী গুপ্তসংঘ প্রায়োরি অব সিয়ন ও অউপাস ডেই-এর অজানা সব লোমহর্ষক কর্মকাণ্ড আবিষ্কার করতে শুরু করেন। এক পর্যাযে তারা জানতে পারেন, সহচর মেরি মাগদালিনের গর্ভে যিশু খ্রিস্টের সন্তান জন্ম এবং তার বংশধরদের টিকে থাকার মতো বিতর্কিত বিষয় নিয়ে গোপন এই বিবাদের সূত্রপাত...
দ্য ভিঞ্চি কোড
মূল: ড্যান ব্রাউন
ভাষান্তর: সোহরাব সুমন
অধ্যায় ২
একমাইল দূরে, সাইলাস নামের বেঢপ এলবিনো বাদামি পাথরের অভিজাত বাসভবন রুয়ে লা ব্রুয়ের-এর সদর দরজা দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ভেতরে ঢোকে। উরুতে পড়ে থাকা সিলাস বেল্টের সুঁচালো খুঁটা তার মাংসে ঢুকে পড়েছে, তারপরও প্রভুকে সেবা করতে পারায় তার আত্মা সন্তুষ্টিতে গেয়ে উঠছে।
ব্যথা ভালো।
বাসভবনটিতে ঢুকবার সময় তার লালচে চোখ জোড়া প্রবেশ পথের আশপাশ খতিয়ে দেখে। ফাঁকা। সে নীরবে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে, তার অন্যান্য অসংখ্য সঙ্গীকে সে জাগাতে চায় না। তার শোবার ঘরের দরজা খোলাই ছিল; তালা এখানে নিষিদ্ধ। সে ভেতরে ঢোকে, তার পেছনের দরজাটি বন্ধ করে দেয়।
ঘরটি খুব সাদামাটা- শক্ত কাঠের মেঝে, একটি পাইন আলমারি, কোণার দিকে একটি ক্যানভাসের মাদুর যেটা তার বিছানা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। চলতি সপ্তাহে সে এখানে একজন অতিথি, এবং বহু বছর যাবত সে নিউইয়র্ক শহরের এমনই একটি আশ্রমের আর্শীবাদপুষ্ট।
সদা প্রভু আমার আশ্রয়ের সংস্থান এবং জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে দিয়েছেন।
আজ রাতে, অবশেষে, সাইলাস অনুভব করে সে তার সেই ঋণ শোধ করতে শুরু করেছে। তাড়াহুড়া করে আলমারির কাছে গিয়ে, একেবারে নিচের ড্রয়ারে সে তার সেল ফোনটি খুঁজে পায় এবং তারপর কল করে।
“হ্যাঁ?” এক পুরুষ কণ্ঠ জবাব দেয়।
“টিচার, আমি ফিরে এসেছি। ”
“বলো,” স্বরটি আদেশ করে, তার কথা শুনে খুশি হয়েছে বোঝা যায়।
“চার জনের সবাই শেষ। সেই তিনজন সিনেশৌ... এবং গ্রান্ড মাস্টার নিজে। ”
ক্ষণিকের নীরবতা, যেন প্রার্থনার জন্য। “তাহলে আমি কি ধারণা করেছিলাম তুমি এ খবরই আনবে?”
“চারজনের সবাই একই কথা বলেছে। আলাদাভাবে। ”
“আর তুমি ওদের কথা বিশ্বাস করেছ?”
“এভাবে তাদের সবার কথা মিলে যাওয়া কিছুতেই আকস্মিক হতে পারে না। ”
একটি উত্তেজিত নিঃশ্বাস। “চমৎকার। আমার ভয় ছিল ব্রাদারহুডের গোপনীয়তা রক্ষার নজির অক্ষত থাকবে। ”
“মৃত্যুর সম্ভাবনা খুবই মজবুত তাড়না। ”
“তাহলে, আমার ছাত্র, এবার আমাকে বলো আমার কী জানা দরকার। ”
চোখের সামনে তার শিকারদের প্রচণ্ড আঘাত পেতে দেখবার আগে সাইলাস এই তথ্য জানতে পেরেছে। টিচার চারজনের সবাই সেই ক্লি দ্য ভ্যুতে-এর অস্তিত্বের কথা স্বীকার করেছে... প্রাচীন সেই গুপ্তপাথরের কথা। ”
সে ফোনের ওপাশ থেকে দ্রুত নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পায় এবং টিচারের উত্তেজনা টের পায়। “সেই কিস্টোন। হুবহু আমরা যেমনটি সন্দেহ করেছিলাম। ”
লোক-কথা অনুসারে, এই ব্রাদারহুড গুপ্তপাথরের একটি মানচিত্র প্রস্তুত করেছে- একটি ক্লি দ্য ভ্যুতে... বা গুপ্তপাথর- এক খোদাই লিপিফলক যা ব্রাদারহুডের সবচেয়ে বড় গোপনীয়তা লুকিয়ে রাখবার চূড়ান্ত অবস্থান প্রকাশ করবে... তথ্যটি এতই শক্তিশালী যে এর সুরক্ষার সাথে ব্রাদারহুডের প্রতিটি অস্তিত্ব সম্পর্কযুক্ত।
“যখন এই গুপ্তপাথরখানা আমাদের হাতে আসবে,” টিচার বলেন, “আমরা কেবল একধাপ পিছিয়ে থাকব। ”
“আপনি যা চিন্তা করেছেন আমরা তার চাইতেও কাছাকাছি রয়েছি। গুপ্তপাথরটি এখানেই, প্যারিসে আছে। ”
“প্যারিস? অবিশ্বাস্য। তাহলে তো খুবই সোজা। ”
সাইলাস সেদিন সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া আগেকার ঘটনাগুলো এক এক করে খুলে বলে... কীভাবে চারজনের সবাই, মৃত্যুর আগে, তাদের গোপনকথাটি বলে নিজেদের পাপীষ্ঠ জীবন কিনে নেওয়ার জন্য মরিয়াভাবে চেষ্টা করেছে। সবাই সাইলাসকে হুবহু একই কথা বলেছে-যে কিস্টোনটি খুব বিচক্ষণতার সঙ্গে প্যারিসের প্রাচীন গির্জাগুলোর একটি দ্য এগলিস দ্যু সা-সালপেস-এর ভেতরে নির্দিষ্ট একটি জায়গায় লুকোনো রয়েছে।
“সদা প্রভুর এক ঘরের ভেতরে,” টিচার বলে ওঠেন। “ওরা কীভাবে আমাদের উপহাস করছে!”
“যেমনটা তারা শত শত বছর ধরে করে এসেছে। ”
টিচার চুপ হয়ে যান, যেন এই মুহূর্তে সাফল্য তার ওপর নির্ভর করছে। অবশেষে, তিনি কথা বলেন।
“তুমি সদাপ্রভুর জন্য দারুণ এক কাজ করেছ। এর জন্য আমরা শত শত বছর ধরে অপেক্ষা করছি। তুমি অবশ্যই আমার জন্য পাথরটি খুঁজে নিয়ে আসবে। এখনই। আজ রাতে। বিপদটা তুমি আঁচ করতে পারছ। ”
সাইলাস অনিশ্চিত এই ঝুঁকির কথা বুঝতে পারলেও, এবং টিচার এর জন্য এখন আদেশ করবার পরও কাজটা তার কাছে পুরোপুরি অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে। “কিন্তু ওই গির্জা, ওটা তো পুরোপুরি একটা দূর্গ। বিশেষ করে রাতে। আমি কীভাবে ভেতরে ঢুকব?”
একজন প্রচণ্ড ক্ষমতাধর পুরুষের আত্মবিশ্বাসের স্বরে, কী করতে হবে টিচার তা বুঝিয়ে বলেন।
ফোন রাখার পর সাইলাসের ত্বক প্রত্যাশার উদ্দীপনায় শির শির করে ওঠে।
একঘণ্টা, সে নিজেকে বলে, ভালোই হলো সদাপ্রভুর এক ঘরে প্রবেশের আগে প্রয়োজনীয় প্রয়শ্চিত্ত করবার জন্য টিচার তাকে সময় দিয়েছে। আজকের পাপের জন্য আমাকে অবশ্যই আত্মা শোধন করতে হবে। আজ যে পাপ করেছি তার উদ্দেশ্য পবিত্র। সদাপ্রভুর শত্রুদের বিরুদ্ধে শত শত বছর ধরে যুদ্ধ চলছে। ক্ষমা নিশ্চিত।
এমনকি, সাইলাস এ-ও জানে, পাপ মোচনের জন্য দরকার বিসর্জন।
কাপড় খুলে, সে উলঙ্গ হয় এবং ঘরের মাঝখানে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে। নিচের দিকে তাকিয়ে, সে তার উরুতে শক্ত করে আঁটা কাঁটা ওয়ালা সিলাস বেল্টটি খতিয়ে দেখে। এই মার্গের সত্যিকার সব অনুসারীরা ডিভাইসটি পরে- ধাতব কাঁটা বসানো একটি চামড়ার ফিতা, যা খ্রিস্টের ভোগান্তির অনন্ত স্মারক হিসেবে মাংস ছেদ করে ভেতরে ঢুকে থাকে। ডিভাইসটির কারণে যে যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় তা মাংসের কামনাকে ব্যর্থ করে দিতেও সাহায়তা করে। সাইলাস আজকের নির্ধারিত দু’-ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে তার সিলাস পরে থাকলেও, সে জানে আজকের দিনটি সাধারণ কোনো দিন নয়। ফিতা আঁকড়ে ধরে এটিকে আরও এক খাঁজ খাটো করায়, কাঁটাগুলো তার মাংসের আরও গভীরে খুঁড়তে থাকায় সে ব্যথায় কুঁচকে যায়। ধীরে ধীরে শ্বাস ছেড়ে, সে ব্যথার শোধন কৃত্য উপভোগ করে।
যন্ত্রণা ভালো, সাইলাস ফিসফিস করে বলে, সব টিচারের টিচার, ফাদার হোসে মারিয়া এসক্রিবা-এর পবিত্র মন্ত্র পুনরাবৃত্তি করে। এসক্রিবা ১৯৭৫ সালে দেহত্যাগ করলেও, তার প্রজ্ঞা টিকে রয়েছে, তারা যেভাবে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে “শরীরী মর্মঘাত” নামে পরিচিত পবিত্র আচার অনুশীলন করে আসছে, একইভাবে আজও বিশ্বজুড়ে বিশ্বস্ত দাসেরা গোপনে তার মন্ত্রগুলো জপ করছে।
সাইলাস এবার তার পাশে মেঝের ওপর গুটিয়ে রাখা বড় গেরোওয়ালা একটি দড়ির দিকে মনোযোগ দেয়। আত্ম-সংযম। গেরোগুলো শুকনো রক্তের পিণ্ড হয়ে আছে। নিজের তীব্র যন্ত্রণার প্রভাবে পরিশুদ্ধ হতে অধীর, সাইলাস দ্রুত একটি মন্ত্র জপ করে। তারপর, দড়ির এক প্রান্ত মুঠো করে ধরে, সে তার চোখ বন্ধ করে এবং এটিকে তার কাঁধের উপর দিয়ে সজোরে ঝাপটা মেরে, পিঠে গোরোগুলোর চপোটাঘাত উপভোগ করে। সে তার কাঁধের পেছনে চাবুক কশে মাংস ফালা ফালা করে চিরে ফেলে। একের পর এক সে চাবুক মারতে থাকে।
কাস্টিগো করপুস ম্যেউম।
অবশেষে, সে রক্ত বেরিয়ে আসা টের পায়।
চলবে…
দ্য ভিঞ্চি কোড | ড্যান ব্রাউন (১ম পর্ব)
সোহরাব সুমন সমকালীন একজন কবি। জন্ম বেড়ে ওঠা এবং পড়ালেখা ঢাকায়। তার মননশীলতা তার সৃষ্টিকর্মেই ভাস্বর। কবির নিরবচ্ছিন্ন সাহিত্য প্রচেষ্টা এবং সৃজনশীলতা তার আশপাশের পরিচিত বিশ্ব তার কাব্যিক রূপ-রস-গন্ধ সমেত পাঠকের চেতনায় জীবন্ত হয়ে উঠতে বাধ্য। একনিষ্ঠ এই কবি দীর্ঘদিন যাবৎ কবিতা, ছোটগল্প, সৃষ্টিশীল ফিচার লেখার পাশাপাশি অনুবাদ করে চলেছেন। ‘শুধু তুমি কবিতা’, ‘কবিতার বিস্বাদ প্রহর’ এবং ‘ভালোবাসি তোমার ছোঁয়া’ তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ, ‘আরববিশ্বের গল্প,’ ‘মিশরের শ্রেষ্ঠ গল্প,’ ‘ইরাকের শ্রেষ্ঠ গল্প,’ ‘ইতালির শ্রেষ্ঠ গল্প’ এবং ‘যুদ্ধের মেয়ে’ তার এযাবৎ প্রকাশিত অনুবাদ গল্পসংকলন। ‘স্পেনের শ্রেষ্ঠ গল্প’ তার সম্পাদিত গল্পসংঙ্কলন। ‘দ্য ট্রাভেলস অব মার্কো পলো’ তার অনূদিত অভিযাত্রিক ভ্রমণকাহিনী। বিখ্যাত মার্কিন লেখক এবং ইতিহাসবিদ হ্যরল্ড ল্যাম্ব রচিত সুলেমান দ্য মেগনেফিসেন্ট সুলতান অব দ্য ইস্ট তার অনূদিত ইতিহাস গ্রন্থ। এছাড়াও তালিকায় রয়েছে বিখ্যাত লেখক এনিড ব্লাইটন এর ‘শ্যাডো দ্য শিপ ডগ’। তাছাড়া তার অনূদিত একই লেখকের ‘রহস্য দ্বীপ’ কিশোর উপন্যাসটিসহ বিশ্বসাহিত্যের বেশকিছু বিখ্যাত বই প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। সঙ্গত কারণেই তার কবিতা, অন্যান্য লেখা এবং অনুবাদকর্ম পাঠকমহলে বহুল সমাদৃত।
বাংলাদেশ সময়: ১১৫২ ঘণ্টা, মার্চ ০৭, ২০১৮
এসএনএস