এছাড়াও রুবাই-এর বিষয়বস্তুতে অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে সুফিবাদের ভাবনাসমূহ লক্ষ্য করা যায়। যুক্তি, জ্ঞানের সাহায্য ছাড়া শুধুমাত্র ভক্তি বা প্রেমের সাধনার মধ্য দিয়ে সুফিবাদীরা অদৃশ্যের সঙ্গে মিলিত হবার চেষ্টা করেন।
সুফিবাদী ধারার অনুসারী ছিলেন হাফিজ, ওমর খৈয়াম, ফেরদৌসী, শেখ সাদী, আবু সায়েদ প্রমুখ ফারসি কবিগণ।
রুবাই মূলত ইংরেজি 'Epigram' জাতীয় কবিতা। সারাসেন আক্রমণের পূর্বে ফার্সি সাহিত্যে ‘রিবাই’ নামে এক জাতীয় ছন্দ ছিলো। প্রাচীন আরবি সাহিত্যের ‘দুবাই’র প্রভাবে ‘রিবাই’ ছন্দ পরিবর্তিত হয়ে রোবাঈ বা রুবাই-এর রূপ গ্রহণ করে। ইতালি কাব্যসাহিত্যে সনেট যেমন, ফারসি সাহিত্যেও রুবাই তেমনি গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাভাষায় রুবাই অনুবাদ করেছেন যথাক্রমে কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার, অজয়কুমার ভট্টাচার্য, কান্তিচন্দ্র ঘোষ ও কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলায় অনূদিত হয়েছে বিশেষ করে হাফিজ, শেখ সাদী এবং ওমর খৈয়াম-এর রুবাই ।
কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের ‘সদ্ভাবশতক’ অর্থাৎ সদ্ভাবপূর্ণ কবিতাকলা প্রকাশিত হয়েছে ১৮৬১ সালে। এই অনূদিত গ্রন্থের বেশিরভাগ রুবাই হাফিজ ও সাদীর ফার্সি রুবাই-এর ভাবানুবাদ। ‘সদ্ভাবশতক’-এর কবিতার উপাদান মুখ্যত হাফিজের ‘দিওয়ান’ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। এখানে একটি কবিতার অংশবিশেষ উদ্ধৃত করা যাক :
‘বিরহ-বারিধি নীরে জীবনের তরি
ডুবিল ডুবিল আহা! প্রাণে মরি মরি।
কেঁদ না হাফেজ বল কী ফল রোদনে?
কমল কোথায় আছে কণ্টক বিহনে?’
১৯৩০ সালে ‘রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ’ অজয়কুমার ভট্টাচার্য প্রকাশ করেন। তিনি সৈয়দ আবদুল মজিদ ও এল ক্রানমার-বিঙ-এর ইংরেজি অনুবাদ অবলম্বনে ৬৫টি রুবাইয়ের ভাবানুবাদ করেন। অজয়কুমার ভট্টাচার্য তৃতীয় পংক্তিতে ভেঙে দুটি ছোট পংক্তি করে অন্ত্যমিল দিয়েছেন।
যেমন-
‘ঐ যে গোলাপ জাগল সুখে
ফুটল হাসি গুল্বাগের।
ফুল-পিয়ালাপূর্ণ হল,
শুনছি বাঁশী নওরোজের।
তরুণ সাকীর সরাব সুধা
মিটায় যাহার মনের ক্ষুধা
সুখের নেশায় বিভোর সে যে,
রইল কোথায় দুঃখ তার?
রক্ত নাচে রুদ্রতালে,
বন্দী সে-কি থাকবে আর?’
রুবাইটির মৌলিক রূপের খানিকটা বিকৃতি ঘটেছে। যে কোনো অনুবাদে মনে রাখা প্রয়োজন যে, কাঠামোগত দিক থেকে মূলের সঙ্গে সংগতি রাখা অত্যন্ত জরুরি।
কান্তিচন্দ্র ঘোষের ‘রোবাইয়াৎ-ই-হাফিজ’ ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয়। ইংরেজি অনুবাদ থেকে ৭৫টি রুবাই অনুবাদ করেন। অনুবাদে স্বরবৃত্ত ছন্দ ব্যবহার করেন।
যেমন-
‘সাকীর সাথে স্বপ্ন রচন নদীর ধারে বসে
খেয়ালটা সেই মিটিয়ে নে গো-স্মৃতিটি থাক খসে।
ফুলের মতই প্রাণের আভাস দিন কয়েকের নেশা
সেই কটা দিন পেয়ালা ভরে হাসির সঙ্গে মেশা!’
নজরুল কর্তৃক অনূদিত ‘রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ’ প্রকাশিত হয় ১৯৩০ সালে আর ‘রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৯ সালে। নজরুল দুটি গ্রন্থ মূল ফার্সি থেকে অনুবাদ করেছেন।
নজরুলের অনুবাদ-
১. ‘পরাণ ভরে পিয়ো শরাব
জীবন যাহা চিরকালের
মৃত্যু-জরা-ভরা জগৎ
ফিরে কেউ আসবে না ফের।
ফুলের বাহার গোলাব-কপোল,
গেলাস-সাথী মস্ত ইয়ার,
এক লহমার খুশীর তুফান,
এই তো জীবন! ভাবনা কিসের’।
২. ‘পরাণ-পিয়া! কাটাই যদি
তোমার সাথে একটি সে রাত,
বসনসম জড়িয়ে রব
নিমেষ পলক করব না পাত
ভয় কি আমার, যদিই সখি,
তার পরদিন মৃত্যু আসে,
পান করেছি অমর করা
তোমার ঠোঁটের আব-ই-হায়াত!’
তবে এই রুবাইয়ের মূল রূপটিও সর্বক্ষেত্রে অক্ষুণ্ন থাকেনি। তিনি রুবাইয়ের রূপানুসারে তৃতীয় পংক্তি একটানা না রেখে তা ভেঙে দুটি ক্ষুদ্রভাবে নির্মাণ করেছেন।
আমারা যতদূর জানি, তৎকালে রুবাই আবৃত্তি অথবা পাঠ হতো অভিজাত শ্রেণির দরবারে। এতে সাধারণের প্রবেশের কোনো অধিকার ছিলো না। রাজা বা সম্রাটরা এসব অনুষ্ঠানের মূল পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। রাজমহলের বিশেষ স্থানে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো।
এতে থাকতো সুরা, সাকি আর নর্তকী। সুরা পানের সঙ্গে সঙ্গে পায়েলের ঝঙ্কার তুলতো নর্তকী আর সাকি ঘুরে-ঘুরে আমির-ওমরাওদের মদ পরিবেশন করতো। রুবাই পাঠকালে যে-অংশ বা পংক্তি অভিজাত শ্রোতার ভালো লাগতো তখন মারহাবা-মারহাবা বলে ধ্বনি উঠতো।
এসব উচ্চারিত পংক্তিমালায় প্রকাশিত হতো এমন একধরনের বেদনা যা-সম্পূর্ণরূপে রাজকীয়, প্রজার বেদনা নয়। প্রজারা তৎকালে কোনো শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিলো না। তাই এসব রুবাই-এ প্রজাদের জীবন-যাপনের চালচিত্রটি সর্বদাই উপেক্ষিত। যারা এসব রুবাই রচনা করতো তাদের সঙ্গে সাধারণের তেমন যোগাযোগ ছিলো না। তারা রাজার অধীনে লালিত-পালিত হতো এবং তাদের গুণকীর্তন এসব রচনার পরতে পরতে ভেসে উঠতো।
সময় পরিবর্তনের সঙ্গে-সঙ্গে মানুষের জীবন-যাপন, রুচি-সূচির ক্রমশ পরিবর্তন ঘটে। পরিবর্তনটি ঘটায় সচেতন, সংবেদনশীল ও ভাবুক মানুষ। এসব মানুষ পরিবর্তন, পরিবর্ধন, প্রকাশ ও বিকাশের নিয়ামক শক্তি। ক্রমে-ক্রমে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটেছে। অতএব রাজা নেই, রাজমহল নেই, রাজপুত্র ও রাজকন্যাও আর নেই।
বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে সাকিরাও নিজেদের সময়োপযোগী করে অন্যরূপে উপস্থাপিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমরাও আশা করেছিলাম রুবাই কাল বা সময় উপযোগী হয়ে উপস্থাপিত হবে।
কিন্তু তা হয়নি দীর্ঘদিন যাবৎ। বাংলাভাষায় অনেকে রুবাই রচনা করেছেন এবং আমাদের স্বাধীনতার পর এই বাংলাদেশে অনেক রুবাই রচয়িতার আবির্ভাব ঘটেছে। কিন্তু মেজাজ-মর্জিতে আজও রয়ে গেছে রাজকীয় অথবা মোঘলীয় ঘরানার চিন্তা-চেতনা। যা আজকের জীবন-যাপন ও মননের সঙ্গে যায় না।
কিন্তু শিল্পকলার প্রতিটি শাখায় কমবেশি পরিবর্তন ঘটেছে। সময়োপযোগীকরণের চেষ্টাও করা হয়েছে ও হচ্ছে।
এ ক্ষেত্রে আমরা গজলের কথা উল্লেখ করতে পারি। সময়ের স্রোতধারায় গজলের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। একটু খেয়াল করলে শ্রোতারাও বিষয়টি বুঝতে পারবেন। এর জন্য প্রয়োজন গভীর মনোযোগ ও সময়ের উত্থান-পতনের পর্যবেক্ষণ।
সেকালে গজল গাওয়া হতো রাজদরবারে রাজা ও তার পারিষদবর্গের সামনে। আজ গজল পরিবেশিত হয় মঞ্চে আমজনতার সামনে। সময়ের কল্যাণে স্থানের পরিবর্তন ঘটেছে। এই পরিবর্তন ছিলো অনিবার্য। শুধুমাত্র স্থানের পরিবর্তন ঘটেনি; কথা, সুর ও বিষয়-ভাবনার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। এ পরিবর্তনে গজলের সারথিরা ছিলেন মেহেদী হাসান, গোলাম আলী, জগজিৎ সিং, চিত্রা সিং, ভূপেন্দর সিং, মিতালী সিং, আলতাফ রাজাসহ আরো অনেকে।
বর্তমানে মেহেদী হাসানের গজলে দেখি; ‘দুনিয়া কেসেসে প্যায়ার/ জান্নাতসে কম্ নেহি/ এক দিলরুবা জো দিলোমে হুরোসে কম নেহি/’।
বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘স্বর্গের চেয়ে পৃথিবীর ভালোবাসা কম নয় আর আমার প্রেয়সীও হুরপরীর চেয়ে কম কিসের’।
এই গজলে প্রথাগত বিশ্বাস বা ধর্মচিন্তা ভেঙে সময়ের নতুন একটি ভাবনা যুক্ত হয়েছে। যা গজল সম্পর্কে নতুন করে ভাববার দরজা খুলে দিয়েছে।
এ সময়ের তরুণ ভারতীয় গজল শিল্পী আলতাফ রাজা গেয়ে ওঠেন; ‘দিলকা হাল জানে দিলওয়ালা। ’ ‘দিলওয়ালা ছাড়া তো মনের বা দিলের খবর জানা সম্ভব নয়’।
এখানেও মানুষকে প্রধান করে দেখা হয়েছে এবং রেনেসাঁর ভাব-জগতের সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে। আগেকার গজলে ছিলো অদৃশ্য শক্তির গুণকীর্তন। ওখানে থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে আসা হয়েছে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যুক্তিরও পরিবর্তন ঘটে। অন্ধবিশ্বাসের চেয়ে যুক্তির ভেতর দিয়ে আস্থা স্থাপনের বিষয়টি ক্রমশ সুদৃঢ় হচ্ছে। এই কারণে গজলে বিষয়গত দিক থেকে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরি। লেবাননের কবি কাহলিল জিবরানের সঙ্গে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মিস্টিসিজম ধারণার অনেক সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে মূলত স্থান ও সময়ের কারণে।
যে শিল্পী স্থান ও সময় সম্পর্কে সচেতন নন, তার শিল্প সাধনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবেই। এ ক্ষেত্রে ‘রুবাই’ রচয়িতা শামসুল আরেফীন স্থান ও সময় চিহ্নিত করে অগ্রসর হয়েছেন। এই সচেতনতার জন্য তার রচিত রুবাইগুলো আলোচনার দাবি রাখে।
কবি শামসুল আরেফীন দীর্ঘদিন ধরে বিরতিহীনভাবে রুবাই রচনা করে চলেছেন। শতাধিক রুবাই দৈনিকের সাহিত্যপাতায় এবং ছোট কাগজে প্রকাশিত হয়েছে এবং পাঠকমহলে সুনামও কুড়িয়েছে। এখানে আলোচনার জন্য তার কিছু সংখ্যক রুবাই উপস্থাপন করা যাক;
হাজার চাঁপা চুমু খেল চান্নিভরা এই অধরে
তবু আমি হইনি মাতাল, বলছি দারুণ সত্যি করে।
পদ্মাবতী চুমুর আশে যেই চেয়েছে অধরপানে,
উথাল-পাতাল ঘটে গেছে বক্ষ-ডলুর বালুচরে।
পাতার বরণ থাকলে সবুজ, গভীরতম সুবাস থাকে;
হঠাৎ পাতা শুষ্ক হলে মূল্য কেবা দেয় তাহাকে?
ফুলমতি গো পাতার বরণ থাকতে সবুজ কাছে আসো,
সুবাস বিলাও মানিকরাজে বাদনখালি-ছড়ার বাঁকে।
(যদি) মলকাবানুর মতো তোমার বুক-বাগানের পদ্ম হতো,
আমি কি আর থেকে যেতাম এমনতরো ভাগ্যাহত?
মনুমিয়া হতাম আমি; খুব মধুময় পদ্মজোড়া
সিগ্ধ আলো ছড়িয়ে দিতো আমার পানে অবিরতো।
বাঁশবনিয়ার বাঁশিপাড়ায় দেখেছিলাম ওষ্ঠকুসুম,
সেদিন ছিল আংগারাণের কী মহাধুম, কী মহাধুম!
বারেবারে চেষ্টা করে তারপরে আর দেখিনি তো...
চোখ-বসুধায় পাই না যে তাই ঘুমবেহুলার সোহাগি চুম।
হিমের দিনে এক বেয়ানে কী যে হোয়া, কী যে হোয়া।
আমি গেলাম মাজারটিলার একটু দূরে হরিণতোয়া।
সেই পাহাড়ে হঠাৎ দেখি লখাই রাজার বেহুলাফুল;
ইচ্ছে হল ছুঁয়ে দেখি; শরমে হায় হয়নি ছোঁয়া।
রহিম এবং রূপবানেরই কালকে ছিল মধুর বাসর;
বাজালিয়ার ডেলিপাড়ায় কাল ছিল তাই গানের আসর।
টোনাঠাকুর গেয়েছিল লুই-শবরের চর্যাগীতি;
ডেলিপাড়া মুগ্ধ ছিল ভুলে দোজখ, ভেস্ত, হাশর...
(আমার) শবের ‘পরে ইচ্ছে হলে দিও গাঁয়ের নকশিকাঁথা
কিংবা দিও আলাওল আর আলী রজার কাব্য, গাথা।
দু'চোখ আমার থাকবে খোলা দেখতে প্রিয় গুবাকতরু,
ওই দু'চোখে দিও না গো বরই পাতা, বরই পাতা।
আকাশ-বাগের ফুলবাতিরা আজ এসেছে হাশিমপাড়ায়
সলিম-দুলির মিলন হবে কোনরকম বাধা ছাড়াই।
হার মেনেছে হার্মাদেরা ওদের গভীর অনুরাগে;
শঙ্খ-পথে পালিয়ে গেছে হিমছড়িয়ার বালুচারায়।
বর্ষাবাসে দেখেছিলাম বরকলেরই বরখোলাতে
মারমা-জবা করছে খেলা আঙিনাতে, ধানগোলাতে।
দরদ দিয়ে সেই ছবি হায় এঁকেছিলাম ভেতর ঘরে;
অনেক বছর কাজ দিয়েছে আমার সকল দুখ ভোলাতে।
সোনাই বিবির সোনার দেশে নিত্য আমার আনাগোনা,
মনুর ধারা বহাই তাতে বাস করে এই মানিকঘোনা।
ওই রুপালি ধারার ছোঁয়ায় সোনাই বিবির বুকে চলে
তুলসি চারা জন্ম দেবার স্বপ্ন বোনা, স্বপ্ন বোনা।
রুবাইগুলোর যেসব শব্দে অধোরেখা টানা হয়েছে তাতে দেখা যায় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক শব্দের সুনিপুণ প্রয়োগ, এ অঞ্চলের পরিচিত স্থান, লোককাহিনী ও মিথ চরিত্রের ব্যবহার।
এর ভেতর দিয়ে কবি রুবাই-এর বিষয়বস্তুর পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। এখানে তিনি একা ও একক তরুণ তুর্কি এবং সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন। এভাবে যে রুবাই লেখা যায় আগে তা কখনো কারো কল্পনায়ও আসেনি।
যে-সব স্থানের নাম, লোক ও মিথের চরিত্র এবং আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার বিবিধ ভাবনাকে নতুন করে চালিত করছে তা হলো; পদ্মাবতী, মানিকরাজ, বাদনখালি, মলকাবানু, মনুমিয়া, বাঁশবনিয়া, আংগারাণ, লখাই, বেহুলা, হোয়া, বেয়ান ইত্যাদি।
কবিতার ইতিহাস তার পরিবর্তনের ইতিহাস। পৃথিবীতে বিভিন্ন ভাষায় রচিত কাব্য পাঠ থেকে এ বিষয়টি পরিষ্কার। সময় একটি বিশাল ব্যাপার, এরপর স্থান বা অঞ্চল। বিভিন্ন অঞ্চলের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিন্যাসে পার্থক্য রয়েছে। সৃজনশীল মানুষের কর্মকাণ্ডের প্রতিফলন ঘটে।
বাংলা সাহিত্যে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকালে অর্থাৎ ১৯২২ সালে কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিকতা বিরোধী আন্দোলনকে কবিতার কেন্দ্রে রেখে এ-অঞ্চলের ইতিহাস, ঐতিহ্য, মিথ, লোককথা ইত্যাদি ব্যবহার করে মানুষকে উজ্জীবিত করেছেন কবি। যা আজো প্রাসঙ্গিক;
‘বল বীর
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!
বল বীর
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাতৃর!
অনুরূপভাবে ১৯২৩ সালে আরবের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে কাহলিল জিবরান প্রকাশ করেন ‘দ্য প্রফেট’ নামে এক দীর্ঘ কবিতায়।
এখানে শুরুতে-
Almustafa, the chosen and the belowd,
Who was a dawn unto his own day, had waited,
twelve years in the city of Orphalese for his
ship that was to return and bear him
back to isle of his birth.
প্রায় একই সময়ে প্রকাশিত দুটি দীর্ঘ কবিতার অংশ বিশেষ পাঠ থেকে বুঝা যায়, প্রথম মহাযুদ্ধের পর বিশ্বব্যাপী যে মানবিক ও মানসিক সংকটের সূত্রপাত হয় তা কবিতা তিনটির প্রতিপাদ্য বিষয়। তবে স্থান ও প্রেক্ষাপট ভিন্নতার কারণে বলার ঢঙ ও রঙ আলাদা।
পৃথিবীর প্রত্যেক সৃষ্টিশীল মহৎ সন্তান তাদের নিজ দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতি কর্মকাণ্ডকে অস্বীকার করতে পারেন না। তাই বিভিন্ন দেশের সৃষ্টিশীল মানুষ তার মাটিতে দাঁড়িয়ে নিজের মত করে চিন্তা-ভাবনাসমূহ প্রকাশ করে থাকেন। ফলে আলাদা আলাদারূপ লাভ করে। উল্লেখিত কবিতাগুলোও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়।
আমাদের এখানে রচয়িতারা দীর্ঘকাল থেকে একই ভাবনায় জারিত হয়ে অন্ধের মতন অনুকরণ করে রুবাই লিখে গেছেন। তারা কল্পনার হাওয়ায় ভেসে-ভেসে মোঘলীয় বা রাজকীয় মেজাজটি পুনঃপুন বয়ান করে চলেছেন।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগেও বারবার অদৃশ্য শক্তির কাছে সমর্পিত হয়েছেন মরমীয়াবাদের ভেতর দিয়ে; যা আজকের পাঠকের মন-মানসিকতায় কোনোভাবে নব ঢেউ জাগাতে পারেনি। পরিবেশ, পরিস্থিতি ও সময়জ্ঞান সম্পর্কে তাদের সচেতনতার অভাব প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হয়। আজকের রচয়িতাদের রুবাই পড়ে মনে হয়, যেন কয়েক শতাব্দী আগে কারো রচিত রাজকীয় ঘরানার রুবাই পড়ছি।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে রচিত রুবাইয়ে কোনো নতুনত্ব নেই। প্রচলিত ধারায় সুরা, সাকি, অদৃশ্য শক্তি আর রাজকীয় মেজাজের মাধ্যমে বিরহের বহিঃপ্রকাশ।
এখানে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। তাই সেকাল থেকে আজকের দিনে রচিত রুবাইগুলো একটি নির্দিষ্ট গণ্ডিতে ঘুরপাক খাচ্ছে। বৃহত্তর জনমানসে তেমনি কোনো আবেদনও সৃষ্টি করেনি। এতে রুবাই অভিজাত শ্রেণির ড্রয়িং রুমে সীমাবদ্ধই থেকেছে। হালের রুবাই রচয়িতা শামসুল আরেফীন এ থেকে সম্পূর্ণরূপে বেরিয়ে এসেছেন। তিনি রুবাইকে বৃত্তাবদ্ধ এলাকা থেকে বের করে এনে বৃহত্তর জনসমাজের ঘটনাবলী নিয়ে হাজির করেছেন।
তার রুবাইয়ে এই জনপদের মানস ও রূপরেখার প্রকাশ ঘটেছে;
ওরা কভু বেদ পড়ে না আর পড়ে না পুরাণ, গীতা;
ওসব যারা শ্রদ্ধা করে তাদের বলে অসুর-মিতা,
ঠেগারকুলের ও-কবিরাজ, কাউয়াগুলোর অসুখ নাকি?
ওদের তুমি দাও না তবে নিমতলারই নিমের তিতা।
ইতিহাসের সেই সময়ে হাঁড়িকুড়া সারে সারে
ফুত ফুত ফুত শব্দ করে থাকতো সদা ফুলপাহাড়ে।
এক শিকারি হঠাৎ এসে মারলে তাদের নিঠুরভাবে,
ফুলপাহাড়ের খের-গালিচা, মেতেছিল হাহাকারে।
রুবাইগুলোতে আমাদের স্বাধীকার অর্জনের সময় থেকে শুরু করে সমকালীন দেশীয় ও বিশ্বের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও মানবিক মূল্যবোধের সংকটের কথা উঠে এসেছে। যা লোকজ উপাদান ও উপকরণের সাথে দেশীয় ও বৈশ্বিক মেজাজ সুচারুভাবে যুক্ত করেছে।
এক্ষেত্রে শামসুল আরেফীনের রুবাইগুলো প্রচলিত রুবাইয়ের ভাষা থেকে বেরিয়ে এসে নবনির্মিতি লাভ করেছে। এখানে শামসুল আরেফীনের সঙ্গে সেন্ট লুইস দ্বীপের কবি ডেরেক ওয়ালকটের যথেষ্ট মিল রয়েছে।
১৯৯০ সালে ডেরেক ওয়ালকটের মহাকাব্য 'OMEROS' প্রকাশিত হয়। দু’বছর পর ১৯৯২ সালে কাব্যগ্রন্থটির জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। গ্রন্থটিতে তিনি প্রধান চরিত্রগুলো গ্রহণ করেন মহাকবি হোমারের মহাকাব্য থেকে। কিন্তু তিনি উপাদান, উপকরণ, ইতিহাস, মিথ, ঐতিহ্য, পুরাণ, লোককাহিনী ইত্যাদি নিয়েছেন তার জন্মদ্বীপ থেকে, সমকালীন ঔপনিবেশিকতার বিরোধিতা করে।
বিশ্বের পাঠকরা নতুন একটি মহাকাব্য পড়ে আশ্চর্য ও বিস্মিত হয়। ওয়ালকট তার দেশীয় উপকরণ দিয়ে রচিত কাব্যগ্রন্থটির মাধ্যমে ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার বিপরীতে দাঁড়িয়ে যান!
অনুরূপভাবে শামসুল আরেফীনও ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছেন নিজেদের বিষয়-আশয়কে সমকালীন প্রেক্ষাপটে আত্মস্থ করে রুবাইয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করে।
'OMEROS' পাঠ করে পাঠক West Indian জনজীবনের কালচার ও বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা লাভ করতে পারে। আরেফীনের রুবাইয়ে আমাদের লোক-সংস্কৃতির নানা দিক উন্মোচিত হলো ও প্রাণের সঞ্চার করলো নবশক্তিতে।
যেমন,
লোকগাথা-পুরাণকথা-নাটক-পালা আর ইতিহাস
বুকে নিয়ে অন্ধকারের সঙ্গে তুমি গড়লে নিবাস।
কৃষ্ণচূড়া, কৃষ্ণচূড়া কী কারণে করলে এরূপ?
লুই-আলাওল-রবি-দুখু-বিষ্ণু কাঁদে তাই বারো মাস।
ভেবেছিলাম; তুমি হলে লোকগাথার ‘চন্দ্রাবতী’,
এরেণ্ডা গাছ সঙ্গী হলে হবে তোমার ভীষণ ক্ষতি।
আজ বুঝেছি; নও তুমি তা, তুমি মানে শূন্য ঘড়া,
এরেণ্ডা গাছ সঙ্গী হলে হবে তুমি ভাগ্যবতী।
গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার তথা শিল্পী, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিককর্মীরা নিজেদের দিকে তাকালো। অর্থাৎ ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী উপাদান ও উপকরণ নিয়ে সাহিত্য রচনা থেকে সচেতনভাবে যূথবদ্ধ হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো।
নিজেদের জীবন-যাপন, বিষয়-আশয়কে কেন্দ্র করে চিনুয়া অ্যাচিব থেকে ডেরেক ওয়ালকটরা রচনা করলো নতুন সাহিত্য আর বিশ্বে সমঝদার পাঠক ও সাহিত্য সচেতনমহল অভিভূত হলো। আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্যকর্মীরা নিজেদের চিন্তা-ভাবনাকে সাহিত্যে রূপ দিতে পারে তা বিশ্ববাসী দেখল এবং তাদের সাহিত্যের গুণগতমানের জন্য নোবেল পুরস্কার দিতে বাধ্য হলো নোবেল কমিটি।
আমাদের এখানে এ বিষয় অনুধাবন করতে অনেক সময় লেগেছে। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে কেউ-কেউ বিচ্ছিন্নভাবে কাজটি করার চেষ্টা করেছেন। দু-একজন সফলও হয়েছেন। তবে সচেতনভাবে জোটবদ্ধ হয়ে ধারাটি শুরু হয় নব্বই দশকে উত্তর আধুনিকতার মাধ্যমে এই চট্টগ্রাম থেকে।
শামসুল আরেফীন সচেতনভাবে ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী সাহিত্য থেকে মুখ ফিরে নিয়েছেন তার লেখালেখির শুরু থেকে। সজ্ঞানে ওইসব সাহিত্যের উপাদান-উপকরণের বিরোধিতা করেছেন রুবাই রচনার মাধ্যমে। এমনকি এতদিন রুবাইয়ে প্রচলিত ও প্রাচীন যে বিষয়বস্তু ও বিশ্বাস রুবাই রচয়িতারা ব্যবহার করে আসছেন তা সমূলে উৎপাটিত করে বিষয়বস্তুগত দিক থেকে নতুন ধরনের রুবাই রচনা করেছেন।
খরন্দ্বীপের চম্পা-কুসুম ‘কী জ্বালা দি গেলা মোরে’
অষ্টপ্রহর দেখতে তোমায় পরাণ পোড়ে, পরাণ পোড়ে।
ফিরে আসো হাবার বেগে, রাখবো নারে মাটিত-পাটিত,
রাখবো করে নয়ন-কাজল কিংবা বাহুর উষ্ণ ডোরে।
অষ্টপ্রহর জ্বলছি আমি কৃষ্ণ-কালার বিচ্ছেদেতে;
‘আমার গলার হার খুলে নে’ বটের তলায় আসন পেতে।
‘হার পরে আর কী হবে’ সই? দেখবে কেবা হারের শোভা?
আমায় বরং দে পরিয়ে ‘কৃষ্ণ নামের মালা গেঁথে’।
আমরা অনেকে নিজেদের বিদগ্ধ নাগরিক মনে করে বৃহত্তর জনসমাজ থেকে আলাদা করে রাখি। এটি হয়েছে খণ্ডিত পাঠ আর মনোজগতে ঔপনিবেশিকতার ‘আছর’-এর কল্যাণে। আমরা কখনো নিজেদের দিকে দৃষ্টিপাত করিনি।
মিথ্যের ওপর ভর করে শেষ দিন পর্যন্ত পাহাড়ের মতো অটল হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। এতে ক্ষতিটি হয়েছে নিজেদের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের। ইচ্ছা করেই অবহেলা করেছি বলে সবুজ খাতার শুরুর দিকের অনেক তথ্য-উপাত্ত কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
যা খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। এতে আমাদের রচিত ইতিহাস হয়েছে খণ্ডিত। তাই কবি বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে উচ্চারণ করেছেন;
‘গভীরতম মনোযোগে পাঠ করেছি সবুজ খাতা,
তার ভেতরে লেখা ছিল ছোট-বড় অনেক গাথা।
জানতে আমি পারিনি এই গাথাসবের কী পরিচয়;
ঝরা ছিল সবুজ খাতার প্রথম দিকের কয়টি পাতা। ’
কোনো কবির পক্ষে সম্ভব নয় অতীত এবং বর্তমানকে পাশ কাটিয়ে কবিতা রচনা করা। ইতিহাস ও সমকাল চেতনা একজন কবির জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অতীতকে সমকালের সঙ্গী করে আগামীর দিকে যাত্রা-ই একজন কবির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। এটিকে ধারণ করে যাপিতদিনের অভিজ্ঞতাসমূহ কিভাবে বয়ান করেছেন একালের কবি শামসুল আরেফীন, তা দেখা যাক;
জন্ম আমার হয়নি বলে ছিলাম না সেই রক্তকালে;
জন্ম যদি হতো তখন, তবে আমার এই কপালে
পাণ্ডরাজার আশিষ নিয়ে চরধুরঙের সকলখানে
খড়ম দিয়ে থাপর দিতাম, শুঙ ফুটাতাম শুয়োর-গালে।
বেশক’টি কবিতায় আমাদের রক্তঝরা ইতিহাসকে কবি তুলে ধরেছেন পরিচিত পাখিকে প্রতীকায়িত করে। কবি এখানে বলেন;
রাতাকুড়া কোথায় গেলো? তারা কি গো আন্দামানে?
এখন শুধু কুড়ির বাকে, তাদের গাওয়া ফালতু গানে
এই হিমালয় জাগে-ঘুমায়; চললে সময় এমনভাবে
সাগরিকায় বিলীন হতে ছুটবে হঠাৎ সাগর-পানে।
আদমগাঁয়ের এক পাহাড়ে বললো মালালা-বুলবুলি :
‘পর্দা থেকে আয় বেরিয়ে, শিক্ষিত হ ভারুইগুলি। ’
সেই বুলিতে পড়লো সাড়া; টুপি-পরা ভুতগুলো তাই
বুলবুলিটির খুলির ভিতর ঢুকিয়ে দিলো তামার গুলি।
এসব রুবাই পাঠের পর কতগুলো বিষয় মনের জানালায় উঁকি দেয়। যেমন,
১. রুবাইগুলো পিনদ্ধ বুননে আবদ্ধ।
২. কোথাও এলিয়ে পড়া ভাব নেই।
৩. লোকজ উপাদানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সমকালের বিবিধ বিষয়াবলী।
৪. দেশীয় ও বৈশ্বিক ভাবনায় জারিত।
৫. রুবাইয়ে দীর্ঘকাল ধরে চলা আসা প্রথাগত ভাষাকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার।
৬. রাজকীয় মেজাজ বা মোঘলীয় মেজাজ পরিহার করে বৃহত্তর লোকসমাজের জীবন প্রণালীর অন্তর্ভুক্তকরণ যা রুবাইয়ের ক্ষেত্রে নতুন।
৭. অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে এই রুবাইগুলোতে বৃহত্তর জনমানসের সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টি।
৮. রুবাইয়ে প্রচলিত বিষয়বস্তু অর্থাৎ সুরা-সাকির কথা বাদ দিয়ে নতুন ভাবনার প্রকাশ।
৯. অভিজাততন্ত্র বাদ দিয়ে সমাজমনস্কতার প্রকাশ।
১০. নিজেদের হাজার বছরে ইতিহাস ঐতিহ্য, পুরাণ, মিথ ইত্যাদি এ-রুবাইগুলোতে উপস্থাপন করে ঔপনিবেশিক তথা সাম্রাজ্যবাদী অপ-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ এবং জাতিকে দেশপ্রেমে আগ্রহী করে তোলার চেষ্টা।
১১. এই গ্রন্থের কবি বৃহত্তর লোকসমাজ থেকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার পাঠটি নিয়েছেন। নগরকেন্দ্রিক আধুনিক চেতনার চোখ দিয়ে খণ্ডিত অসাম্প্রদায়িক চেতনাটি তিনি কখনো গ্রহণ করেননি। এক্ষেত্রে অন্তত ভাটি বাংলার নানা উপাদান ও উপকরণ সহজে গ্রহণ করতে পেরেছেন, যা এ কাব্যের অন্যতম প্রাণশক্তি হিসেবে বিবেচিত।
১২. অতীতের নানা ঘটনাবলী ও বর্তমানের ভাবনার সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা তার কবিতার গতি-প্রকৃতি।
১৩. গতিশীল কবিতার ভাষা ভাবনার সাথে মিলেমিশে অন্য এক রূপ দান করেছে, যা পাঠকের চেতনাকে শাণিত করে এবং স্মৃতিকে তাড়িতও করে।
১৪. সময় বা কাল-চেতনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রেমচেতনা। এটি ব্যক্তি-প্রেমকে অতিক্রম করে সামগ্রিকতা প্রকাশ করেছে।
১৫. ছড়ার ছন্দে লিখিত কবিতায় প্রার্থিত আড়াল বা অবগুণ্ঠন সাধারণত কবিরা রাখতে পারেন না। এখানে সম্পূর্ণরূপে আঁটসাঁট বুননে করণকৌশলের মাধ্যমে যথাযথভাবে উল্লেখিত বিষয়গুলো বিরাজমান।
১৬. শামসুল আরেফীন রচিত রুবাইগুলোতে ব্যবহৃত হয়েছে এ অঞ্চল তথা দু’বাংলার মাটি থেকে উদ্ভূত ইতিহাস, ঐতিহ্য, পুরাণ, মিথ, লোককাহিনী ইত্যাদি। এসব উপাদান ও উপকরণ ব্যবহার করে কাব্য সাহিত্যের মাধ্যমে নব্য ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদিতার বিরোধিতা করা হয়েছে নমিত ও পরিশীলিত কণ্ঠে।
১৭. কবি পর্যটকের অভিজ্ঞ চোখ দিয়ে পাঠ-পরিক্রমার পরিধি প্রতিনিয়ত বিস্তার করে চলেছেন। এখানে তিনি সেমেটিক সংস্কৃতির বিবিধ বিষয়-আশয় বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে কবিতার শরীরের পরতে পরতে বিন্যাস করেছেন।
অতঃপর বলা যায়, শামসুল আরেফীন রুবাই নিয়ে দীর্ঘদিন চিন্তা করেছেন, তিনি বার বার প্রচলিত ভাবনার তীব্র বিরোধিতা করে রুবাইকে শৃঙ্খলিত বেড়াজাল থেকে মুক্তি দিয়েছেন এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি উন্মোচন করেছেন।
বিশেষ করে এই বাংলার লোক-উপাদান ব্যবহার করে যে রুবাই লেখা যায় শামসুল আরেফীন প্রথম দেখালেন। এই সাহিত্যিক বিদ্রোহের কারণে তথাকথিতদের কাছ থেকে বিরূপ মন্তব্যও শুনতে পারেন কবি।
আমাদের বাংলাভাষায় দীর্ঘদিন থেকে রচিত হয়ে আসা রুবাইগুলোতে যে গতানুগতিক ধারা লক্ষ্যণীয় তা রুবাই রচিয়তা শামসুল আরেফীন সজ্ঞানে পরিত্যাগ করলেন এবং বিষয়ের কারণে কাঠামোতে এসেছে নতুন গতি ও নতুন সূচনা।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৭ ঘণ্টা, জুলাই ১০, ২০১৮
এমএ/