ঢাকা, শুক্রবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

আতাতুর্কের বিপ্লব স্বাধীন ভূমির স্বপ্ন দেখায় বাঙালিকে

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০৬ ঘণ্টা, জুলাই ২৮, ২০১৮
আতাতুর্কের বিপ্লব স্বাধীন ভূমির স্বপ্ন দেখায় বাঙালিকে সেমিনারে বক্তব্য রাখছেন সাহিত্যিক ও গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক সরোজ মেহেদী। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা-যোগাযোগ ও সংস্কৃতি বিভাগের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হলো ‘বাঙালি মানসে তুর্কি বিপ্লবের প্রভাব’ শীর্ষক সেমিনার। 

শনিবার (২৮ জুলাই) বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবনের হল রুমে আয়োজিত এ সেমিনারের প্রবক্তা ছিলেন সাহিত্যিক এবং তুর্কি স্কলারশিপ ফেলো ও গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক সরোজ মেহেদী।

ভাষা-যোগাযোগ ও সংস্কৃতি বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মনসুর মুসার সভাপতিত্বে সেমিনারে প্রধান আলোচক ছিলেন কবি, কলাম লেখক ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান।

 

বিভাগের শিক্ষক কায়েস আহমেদের সঞ্চালনায় প্রবন্ধের ওপর আলোচনায় অংশ নেন গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ইকবাল জোবেরী, অধ্যাপক আমজাদ হোসেন, অধ্যাপক করম নেওয়াজ, ড. কৃষ্ণা ভদ্র, ড. ফুয়াদ হোসেন, সুজন মিয়া, কবি ও কালের ধ্বনির সম্পাদক ইমরান মাহফুজ, গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাসানুর রহমান, নূর-ই-তাহরিমা, লাবনী আক্তার প্রমুখ।

ঘণ্টাব্যাপী বক্তৃতায় সরোজ মেহেদী বলেন, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির রক্তচক্ষু আর অস্ত্রের ঝনঝনানিকে পরাজিত করেও যে স্বাধীনভাবে বাঁচা যায় তা বিংশ শতাব্দীতে তুর্কিরা পুরো পৃথিবীকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায়। ফলে তুর্কি বিপ্লব ও তার প্রধান রূপকার মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক পাশার সুনাম ও প্রভাব তখন ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে তিনি চলে আসেন আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের শীর্ষে।  

তিনি বলেন, ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ বিশেষ করে মুসলিমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন দেখছিল সে সময়। যা হবে আধুনিক ও মানবিক একটি দেশ। কিন্তু তাদের সামনে কোনো মডেল ছিল না, ছিল না প্রেরণা নেওয়ার মতো কোনো নাম। কামাল পাশা একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে দেখান যে সদিচ্ছা আর সাহস থাকলে স্বাধীনভাবে বাঁচা যায়। ফলে কামাল পাশাকে নিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ে বাঙালি বুদ্ধিজীবী মহল। কবি সাহিত্যিকদের দেখা যায় পাশার স্তুতি করে একের পর এক সাহিত্য নির্মাণ করতে। যার অগ্রভাগে ছিলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
 
সেমিনারে বক্তব্য রাখছেন সাহিত্যিক ও গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক সরোজ মেহেদী।  ছবি: সংগৃহীত
মূল প্রবক্তা বলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই পরিবর্তনের দাবি উঠছিল তৎকালীন উসমানীয় খেলাফতের শাসনাধীন ভূমিগুলোতে। তারা উসমানীয় খেলাফতের পরিবর্তে আধুনিক ধারার শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘ইয়াং টার্ক’ নামে আন্দোলন গড়ে তোলে। যা চূড়ান্ত পরিণতি পায় তুর্কি বিপ্লবের প্রধান নেতা কামাল পাশার হাত ধরে। তিনি তুরস্ককে বহিশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষায় দেশটিকে একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। যার মূলনীতি ধরা হয় ধর্মনিরপেক্ষতাকে। সেসময় আতাতুর্ক বেশ কিছু সংস্কার কাজে হাত দেন। যেমন হিজাব নিষিদ্ধ করা, জুমার নামাজে আরবিতে খুতবা পড়া নিষিদ্ধ করা, আরবি বর্ণমালার পরিবর্তে রোমান হরফে তার্কিশ ভাষা লেখা ইত্যাদি। এসব ধর্মীয় সংস্কারের ফলে তাকে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মতো বাংলায়ও কট্টর মুসলমানদের তোপের মুখে পড়তে হয়। মুসলমানদের একটি অংশ পাশাকে নাস্তিক ঘোষণা দিয়ে তাকে প্রতিরোধ ও বর্জনের ডাক দেয়। তবে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশ তার সমর্থনে এগিয়ে এলে অবস্থার পরিবর্তন হয়।  

ভাষা-যোগাযোগ ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক বলেন, তুর্কিদের সঙ্গে বাঙালির যে সম্পর্ক তা ঐতিহাসিক। ১২০৪ সালে তুর্কি বংশোদ্ভূত বখতিয়ার খিলজীর হাত ধরে বাংলা অঞ্চলে মুসলমানদের শাসন পর্ব শুরু হয়। প্রায় একই সময়ে তুরস্কে গোড়াপত্তন হয় উসমানীয় খেলাফত শাসনের। বাঙালি মুসলমান ও তুর্কি মুসলমানের মধ্যে উষ্ণ সম্পর্কের শুরু সে সময় থেকেই। যা নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এখনো অটুট রয়েছে। বাঙালি মুসলমানরা যখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করছে, তখন স্বাধীন ও সার্বভৌম অটোমান সাম্রাজ্য ছিল তাদের অনুপ্রেরণা। এ অঞ্চলের মুসলমানরা অটোমান শাসকদের ইসলাম ধর্মের গার্ডিয়ান বা শেষ রক্ষাকবচ হিসেবে বিবেচনা করতেন। ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নানা কারণে অটোমান সম্রাটরা সাম্রাজ্য হারানোর পর্যায়ে পৌঁছালে আমরা ভারতীয় উপমহাদেশে তাদের রক্ষায় আন্দোলন শুরু হতে দেখি, যা খেলাফত আন্দোলন নামে পরিচিত। তবে ১৯২৪ সালে তুর্কি বীর মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক (১৯ মে ১৮৮১-১০ নভেম্বর ১৯৩৮) নিজ দেশে খেলাফত ব্যবস্থা বিলুপ্ত ঘোষণা করলে ভারতীয় উপমহাদেশে গড়ে ওঠা খেলাফত আন্দোলন আপনাআপনিই অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। তুরস্কে খেলাফত বিলুপ্ত হয়ে গেলেও দুই জাতির মধ্যে যে উষ্ণ সম্পর্ক তা কখনো বিনষ্ট হয়নি।  

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উদ্ধৃত করে সরোজ মেহেদী বলেন, কামাল পাশার সবচেয়ে বড় কৃতিত্বগুলোর একটি হলো এই যে, পাশা ইউরোপকে রুখে দিয়ে ইউরোপের নাকের ডগায় একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তোলেন। যা এশিয়া ও আফ্রিকার জন্য সবচেয়ে বড় প্রেরণা হয়ে দাঁড়ায়।  

তার মতে, ফরাসি বিপ্লব, বলশেভিক বিপ্লব নানাভাবে প্রভাবিত করেছে বাঙালিকে। কিন্তু বাঙালির মানসে সবচেয়ে গভীর প্রভাব রেখেছে তুর্কি বিপ্লবই। বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে তুর্কি বিপ্লবের প্রভাব ছিল অপরিসীম। ওই সময়কার পত্রপত্রিকা ও সাহিত্য বিশ্লেষণ করলে তা আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠে। তাই তুর্কি বিপ্লবের রূপকার কামাল পাশার মৃত্যুর পর আমরা দেখি বাঙালিকে শোকে মুহ্যমান হতে। একশ বছর ধরে তুর্কি বিপ্লব বাঙালির কাছে এক অদম্য প্রেরণার নাম।

সেমিনারে আরও উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আয়েশা সিদ্দিকী, আতি-উন-নাহার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আহমাদ ওদুদ, গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তমাল ব্যানার্জী, সনী আক্তার, রাধা কৃষ্ণ প্রমুখ।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৮ ঘণ্টা, জুলাই ২৮, ২০১৮
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।