একটু পড়লেই বোঝা যায়, বাংলা কাব্যে কবি শামসুর রাহমান সব সময়ই নাগরিকতার ধারক ও বাহক। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে' (১৯৫৯) রচনায় বিভিন্ন সময়ে উঠে এসেছে ঢাকার বস্তি, গ্রাম ও নগরের মিশ্র জনপদ।
১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর ঢাকার মাহুতটুলির নানাবাড়িতে মুখলেসুর রহমান চৌধুরী ও আমেনা বেগমের ঘরে জন্ম নেওয়া ১৩ ভাই-বোনের মধ্যে কবি ছিলেন চতুর্থ। কিন্তু তার শেকড়ের মূল ছিল ঢাকার অদূরে নরসিংদীর রায়পুরে। মাত্র ২০ বছর বয়সে সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকায় ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কবিতা।
একসময় তিনিই বলেছিলেন, কখনো কবিতার মধ্যে রাজনীতি আনবেন না। কিন্তু ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর তিনি আর তার আগের কথায় স্থির থাকতে পারেননি। চেতনাবাদী মন তাকে রাজনৈতিক কবিতার বাইরে রাখতে পারেনি। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা আর ক্ষোভ তিনি তুলে এনেছেন কবিতায়। তার কবিতা ছিল সত্যের শক্তিতে শাণিত। তিনি ছিলেন নাগরিক কবি। তাইতো শামসুর রাহমানের কবিতায় বিদ্যমান নগরকেন্দ্রিক চেতনার প্রবল প্রকাশ কারো চোখ এড়ায় না।
শহুরে মানুষের জীবনের ক্লান্তি, নৈরাশ্যবোধ ও অনিকেত মনোভাবের সুন্দর প্রকাশ পাঠককে নিঃসন্দেহে আকৃষ্ট করে। তিনি তা পেয়েছেন উত্তরাধিকারসূত্রে তিরিশের কবিদের কাছ থেকে। তার কবিতার-মননধর্মিতা, জ্ঞানের বিপুলভারে সৃষ্ট দুরূহতা, বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য থেকে গ্রহণপ্রবণতা সবই আধুনিক কবিতার মৌল চেতনা থেকেই পাওয়া। কিন্তু স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে, বর্ণিল তার কাব্যজগৎ অপূর্ব ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ। অনেক কবির মতো শামসুর রাহমান প্রকৃতি-নিসর্গ-নন্দনের বরপুত্র নয়, বরং শিশিরের জলে রূপালি স্নান সত্ত্বেও তিনি ভুলে যান না উত্তাল এবং ভয়াল নগরের বাস্তবতা।
পাশ্চাত্যের কবিদের নৈঃসঙ্গ্য, বিষণ্নতা এবং সংশয়কে আশ্রয় করে শুরু হয়েছিল কবির কবিতা লেখা। অন্য কবিদের মতো তার শুরুর দিকের কবিতায়ও এক বড় জায়গা জুড়ে ছিল মানব-মানবীর ভালোবাসার সম্পর্ক, নিসর্গপ্রীতি। তবে এ ঘোর কাটতে সময় লাগেনি। অল্পদিনের মধ্যে তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেন নাগরিক বাস্তবতার জমিনে। এরপর এক নাগরিক বিষাদময় রোমান্টিকতা দিয়ে শুরু হয় তার কবিতার যাত্রা। শুরুতে তা যত না ছিল সামষ্টিক, তার চেয়ে ঢের বেশি ছিল ব্যক্তিক বেদনার কথকতা। অন্তত নাগরিক এ কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'রৌদ্র করোটিতে'র মধ্যে তার দেখায় পাওয়া যায়।
শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ এবং দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'রৌদ্র করোটিতে' প্রকাশিত হওয়ার পর কবিকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তার কবিতায় সব সময় স্থান পেয়েছে জীবনবোধ, শৃঙ্খলমুক্ত জীবনাচার, স্বাধীনচেতা মন। সে কারণেই বারবার তার কবিতায় উঠে এসেছে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের কথা, আটান্নর আইয়ুববিরোধী কথা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, স্বাধীনতা-পরবর্তী সাড়ে তিন বছর, পঁচাত্তরের নির্মম ঘটনা, পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট, আশির দশকের সামরিক স্বৈরশাসন ইত্যাদি।
‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, ‘আসাদের শার্ট’, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’, ‘স্বাধীনতা তুমি’, ‘অভিশাপ দিচ্ছি’, ‘সফেদ পাঞ্জাবি’, ‘ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা’, ‘ইলেকট্রার গান’, ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’, ‘একটি মোনাজাতের খসড়া’, ‘ধন্য সেই পুরুষ’, ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’, ‘গর্জে ওঠো স্বাধীনতা’ ইত্যাদি কবিতাগুলো তাকে দিয়েছে অনন্য সম্মান। তবে এরমধ্যে ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’ ও ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতা দু’টি সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য হয়েছে স্বাধীনচেতা পাঠকসমাজে।
কবি শামসুর রহমানের চেতনায় প্রবাহিত ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও জনমানুষের প্রতি অপরিসীম দরদ। তার বিরুদ্ধে বারবার বিতর্ক তুলেছে কূপমণ্ডুক মৌলবাদীরা। তাকে হত্যার জন্য বাসায় হামলা করেছে। এতকিছুর পরও কবি তার বিশ্বাসের জায়াগায় ছিলেন অনড়। সে জায়গা থেকেই তিনি স্বতন্ত্র এক কাব্যমেজাজ এবং কাব্যভঙ্গি আয়ত্ত করেছিলেন, যা তাকে দিয়েছে অমরত্ব। পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক, আনন্দ পুরস্কার, আদমজি পুরস্কারসহ আরো অনেক সম্মান।
বাংলার সমস্ত নাগরিকদের কথা বলা এ কবি শামসুর রাহমান চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট বৃহস্পতিবার ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর তার ইচ্ছানুযায়ী ঢাকাস্থ বনানী কবরস্থানে তার মায়ের কবরে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। সেখানেই তিনি খুঁজে নেন তার ঘাসের শয্যা। তার ভাষায়-
‘ভাবিনি শুধুই পৃথিবীর বহু জলে রেখা এঁকে
চোখের অতল হ্রদের আভায় ধূপছায়া মেখে
গোধূলির রঙে একদিন শেষে খুঁজে নিতে হবে ঘাসের শয্যা। ’
বাংলাদেশ সময়: ০০৪৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১৭, ২০১৮
এইচএমএস/এসআরএস