মহান মুক্তিযুদ্ধের ওপর ইংরেজি ভাষায় লেখা বই ‘দি সাইলেন্ট ইয়ার্স’-এ স্মরণ করা হয়েছে সেই মানবতাবাদী গুটিকয় পাকিস্তানিকে। সেজন্য বইটির মুখবন্ধের শুরুতেই মোটা অক্ষরে লেখা, ‘Thank you, Pakistan!’ বাস্তব অভিজ্ঞতা ও মুক্তিযুদ্ধের সত্য ইতিহাসের আলোকে লেখা বই ‘দি সাইলেন্ট ইয়ার্স’র মোড়ক উন্মোচন করা হয় মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর) রাতে রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে।
সেই অনুষ্ঠানে বইয়ের লেখক সিলভীয়া পান্ডিত বলছিলেন, শুরুতে বইটার নাম দিয়েছিলাম ‘থ্যাংকস টু পাকিস্তান’। কিন্তু ওই নামে বই প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি বিধায় নাম দিয়েছি ‘দি সাইলেন্ট ইয়ার্স’। স্বাধীনতা লাভের পরও আমরা সবাই ১৯৭১ স্মরণ করে কাঁদি। আর কান্নার সময়টা নীরবতার। বাস্তব জীবনে আমি ৪৬ বছর সাইলেন্ট ইয়ার্স (নীরব বছর) কাটিয়েছি।
মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। আরও অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অধ্যাপক ড. ম তামিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ, অধ্যাপক ড. শামীমা নাসরিন শাহেদ এবং লেখকের স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা। এই অনুষ্ঠানে ভ্রমণের ওপর ভিত্তি করে লেখা ‘আলিশার চোখে জল’ নামের আরেকটি প্রেমের উপন্যাসেরও মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
‘দি সাইলেন্ট ইয়ার্স’ নিয়ে লেখক বলেন, শহীদ রুমী, শহীদ আজাদসহ আরও অনেক শহীদদের কথা লিখেছি এ বইয়ে। আমি চেয়েছি দেশে-বিদেশে অর্থাৎ সারাবিশ্বের সবাই বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডটার সৃষ্টির সঠিক ইতিহাসটা জানুক। বিশেষ করে বাংলাদেশের তরুণ সমাজ। তাই সহজ ইংরেজিতে আমি বইটা লিখেছি। ১৯৭১-এ আমাদের সঙ্গে আরও অনেক দেশের সহযোগী যোদ্ধারা ছিলেন। স্বাধীনতার পেছনে তাদের অবদানও অনস্বীকার্য।
এসময় তিনি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের জন্য ২০ টন ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী আনতে ফ্রান্সের নাগরিক জ্যঁ ক্যা এর প্লেন ছিনতাইয়ের চেষ্টা এবং গ্রেফতার হয়ে পাঁচ বছর কারাভোগ করার কথা তুলে ধরেন।
উপমহাদেশের সেসময়কার বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ সুনীল গাঙ্গুলী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভারতীয় অনেক চিত্রশিল্পী নিজেদের ছবি বিক্রি করে বাংলাদেশকে আর্থিকভাবে সহায়তা করেছিলেন।
বইটি লেখার ইতিহাস সম্পর্কে সিলভীয়া বাংলানিউজকে বলেন, বইটি লিখতে গিয়ে আমার অনেক বই পড়তে হয়েছে। বীরাঙ্গনাদের জীবনকাহিনি পড়তে গিয়ে আমার চোখই ভেজেনি কেবল, অনেক সময় বই পড়াও বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। কষ্ট হজম করে আবার পড়েছি। সঙ্গে শৈশবের সেই স্মৃতিগুলো তো ছিলই। লেখার বা বইটি সম্পাদনা সময়ের মেয়াদকাল অল্প হলেও আমি আসলে ৪৬ বছর ধরে এই বইটি লিখেছি বলা যায়। কারণ আমি তো আমি মায়ের কোলে চড়ে মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি। ওই সময়টা পেরিয়ে বেশ পরে আমি বুঝতে শিখেছি। তখন থেকেই এই ভাবনাগুলোকে সাজানো শুরু হয়েছে।
সিলভীয়ার বাবা-মা উভয়েই রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। সে সুবাদে তৎকালীন রাজনীতিকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে তার। প্রত্যক্ষ করেছেন মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ কালরাতে নিজেদের ঘর পুড়িয়ে দেওয়া দেখেছেন। রাজাকারদের হাতে ফুপা এমনকি বাবার শহীদ হওয়ার মতো ঘটনাও সহ্য করতে হয়েছে তাকে।
সিলভীয়া বলেন, ৩১ বছর বয়সে আমার মা তার জীবনের রঙ হারিয়ে ফেলেছিলেন। আমি মায়ের দীর্ঘ সংগ্রামী জীবন দেখেছি। আমরা অনেক কষ্ট করে বড় হয়েছি। আমরা ৬ ভাই-বোন। বাবা মারা যাওয়ার আগেও মা বাস্তববাদী ছিলেন না। মুক্তিযুদ্ধ তাকে বদলে দিয়েছে। ৭১-এর কাছে আমরা বাংলাদেশিরা কৃতজ্ঞ।
বইটি সম্পর্কে অধ্যাপক ড. ম তামিম বলেন, আমি লেখকের পরিবারকে ব্যক্তিগতভাবে জানি ও চিনি। লেখক অনেক ছোট অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের করুণ ঘটনাগুলো দেখেছেন। সেসব ঘটনা তার মনে একটি জোরালো দাগ কেটেছে, তা বোঝা গেছে বইটি পড়ে। একটা সুখি সচ্ছল পরিবার এক রাতে কিভাবে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে তার বর্ণনা রয়েছে বইতে। সিলভীয়া পান্ডিতের বাবা ব্যাংকে টাকা রাখতেন না। ২৫ মার্চ কালরাতে তার টেক্সটাইল মিল, আবাসস্থল সব পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। তার সকল সম্পত্তি ধ্বংস হয়ে হওয়ার পর ১৯৭২ সালে পরিবারটি তাদের উপার্জনক্ষম মানুষটিকেও হারিয়ে ফেলে।
ম তামিম আরও বলেন, বইটিতে প্রত্যেকটি ঘটনার অল্প করে বিবরণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পুরো বইটি পড়লে ঘটনাগুলোর একটি যোগসূত্র পাওয়া যায়। বইটির শেষে একটি দারুণ ও প্রয়োজনীয় আবেদন রয়েছে। লেখক ভাষা দিবসের মতো আন্তর্জাতিকভাবে ‘বীরাঙ্গনা দিবস’র স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছেন। এই দাবিটা আমাদের বাস্তবায়ন করা উচিৎ।
অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেন, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অনেক পরিবারকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। সেখান থেকে আজ আমরা উঠে দাঁড়িয়েছি। এই বইয়ে সে সত্য ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। এটা আমাদের সবার বিশেষ করে দেশের তরুণ সমাজের জানা উচিৎ।
লেখক তার ‘আলিশার চোখে জল’ উপন্যাস সম্পর্কে বলেন, সারাবিশ্বের নারীরা সমাজে বিভিন্নভাবে অত্যাচারিত হয়। একবার সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্টে আলিশা (ছদ্মনাম) নামের একটি মেয়ের সঙ্গে দেখা হয় আমার। একা বসে কাঁদছিল। সিঙ্গাপুরেরই একটি ছেলের সঙ্গে প্রেম ছিল তার। আমার ভ্রমণের এইটুকু বাস্তবতার পর আমি বাকিটা কল্পনা থেকে লিখেছি। যেখানে উল্লেখ আছে- আলিক (ছদ্মনাম) নামের ছেলেটি তার সঙ্গে শুধু একবার দেখা করে। তারা একে অপরকে অনেক বেশি ভালোবাসলেও সারাজীবন একসঙ্গে কাটানো সম্ভব হয়নি। আলিক ও আলিশার মিলন না হওয়ার পেছনে রয়েছে কেবল সামাজিক কারণ। যেজন্য মেয়েটিকে এয়ারপোর্টে বসে বাধ্য হয়ে কাঁদতে হচ্ছিল।
বাংলাদেশ সময়: ০৪১৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৮
এমএএম/এইচএ/