গল্পের শুরুতেই পাঠককে আটকে ফেলার জন্য আধুনিক রহস্য গল্প লেখার বিখ্যাত পদ্ধতি ন্যারেটিভ হুকের সাহায্য নিয়েছেন লেখক,
সড়াৎ করে ছায়ামূর্তিটি সরে গেল মোটা গাছের আড়ালে।
আগ্রহ জাগানো কিংবা টেনশন সৃষ্টি করার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট।
আচমকা তার দিকে ডান হাতের তর্জনী তাক করে ম্যাজিক স্পেল ছোঁড়ার মতো করে হুজুর পড়লেন, “আউ’যুবি কালিমা-তিল্লাহিত তা-ম্মাতি মিং শাররি মা খলাক্ব!” অমনি এক আজব কারামত ঘটে গেল। নিজের গলাতেই রামদার কোপটা বসিয়ে দিল আততায়ী।
নিজেই নিজেকে জবাই করে ফেলল লোকটা!
দৃশ্য বর্ণনায় লেখকের শক্তিমত্তা ধরা পড়ে তার দৃশ্যায়নের ক্ষমতার ওপর, ইমেজারি ব্যবহারে পারঙ্গমতার ওপর। প্রতিটি লেখকের উচ্চতা পরিমাপিত হয় তাঁর ইমেজারি প্রয়োগের স্বতঃস্ফূর্ততা দিয়ে। প্রজেক্ট হাজার-আল-ফালাসিফাহ’র বহু স্থানে ইমেজারির এমন অপূর্ব নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে। যেমন:
আকাশের বুক ভেঙে রাশি রাশি জ্যোৎস্না নামাচ্ছে পদ্ম পাতার মতো সুবিশাল চাঁদ। অকাতরে গন্ধ বিলাচ্ছে হাসনাহেনা ফুল। নানা ধরনের গাছপালায় আকীর্ণ বনভূমির মতো বিশাল জমি। জায়গাটা এর আগে না দেখলেও অনুমানে বুঝতে পারলো কোথায় এসে পড়েছে সে।
রহস্য গল্পের প্লটে ঋজুতা অপেক্ষা বঙ্কিমতা অভ্যর্থিত যা এই গল্পের প্লটেও দেখা যায়। বাজি হিসেবে যা আছে তা বিশাল কিছু না হলেও গভীরভাবে ভাবলে তাকে ফেলে দেওয়া যায় না। গল্পের প্রথম পাতায় শুরু হওয়া টেনশনটা একটানে দৌড় শুরু করে শেষে গিয়ে থামে, বিরক্ত হওয়ার ফুরসৎ মেলে না পাঠকের।
গল্প লেখার জন্য প্রতিটি লেখককে যে বিষয়বস্তু বেছে নিতে হয় তা হয়তো এমন কিছু যা নিয়ে আগে কেউ কখনো লেখেননি, অথবা যা নিয়ে আগেও লেখা হয়েছে। লেখালেখির জগতে বর্তমানে বহুল প্রচলিত কথাটি হলো– পৃথিবীর সমস্ত গল্পই একবার করে লেখা হয়ে গেছে। অতএব, সত্যটা হচ্ছে– আগে কখনোই লেখা হয়নি এমন গল্প লিখে ফেলা প্রায় অসম্ভব। নেহাৎ কোনো লেখকের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে হয়তো সারা জীবনে বারকয়েক এমন গল্পের দেখা পেয়ে যান। তবে আগে লেখা হয়েছে এমন বিষয় নিয়ে লেখার মধ্যেও ‘আগে হয়নি’ জাতীয় অনুভূতি দেওয়া সম্ভব। সেজন্য প্রয়োজন সম্পূর্ণ বিষয়টিকে এমন এক দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে আনা যার উদ্যোগ পূর্বে গৃহীত হয়নি। ভিন্ন বীক্ষণকোণে পুরোনো বিষয়ও পাঠকের সামনে হাজির হতে পারে নতুনত্ব নিয়ে– এখানেই একজন লেখকের স্বার্থকতা। এই জায়গাতে এসে তাসরুজ্জামান বাবুকে আমরা দারুণ সফল হিসেবে পাই। প্রজেক্ট হাজার-আল-ফালাসিফাহ এমন একটি রচনা যার প্রতিটি দৃশ্য হয়তো পাঠক আগেও দেখেছে, এই বিষয়ে হয়তো আগেও গল্প লেখা হয়েছে, কিন্তু কখনো কেউ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেনি বা দেখার কথা ভাবেওনি।
বইটির সবচেয়ে শক্তিশালী দুটি চরিত্র ছিল প্রধান প্রটাগনিস্ট ফয়েজ এবং খুলনাভী হুজুর। চরিত্রায়নের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে চরিত্রগুলোকে এমনভাবে উপস্থাপন করা যেন তাদের কথা, চিন্তা, দর্শন অথবা পরিস্থিতভেদে তাদের প্রতিক্রিয়া অন্যের চেয়ে আলাদা হয়। একটি সামান্য বক্তব্য শুনেও যেন পাঠক চিনে ফেলতে পারে তার বক্তাকে। এই গল্পে কিছু চরিত্র ছিল একমাত্রিক, কিছু ছিল বহুমাত্রিক। কিছু চরিত্রের ছিল নিজস্ব রহস্য। কারো মনের ভেতর ছিল অন্তর্গত দ্বন্দ্ব। প্রধান চরিত্র ফয়েজ অনেক বড় একজন অলি হয়েও রোদসীর প্রেমের আকর্ষণ থেকে মুক্ত হতে পারেনি। খানিকক্ষণ সে রোদসীর চিন্তায় বিভোর হয়, পরক্ষণেই আবার অপরাধবোধে ভোগে। তার দায়িত্ব তাকে ভালোবাসার মানুষের কাছে যেতে বাধা দেয়, সৃষ্টি হয় নিজের সাথে নিজের দ্বন্দ্ব। একবার ভাবে, প্রেয়সীকে সব বলে দেবে; আবার ভাবে, না, এই পথে অন্তত তাকে মানায় না। ফলে সে আর একমাত্রিক থাকে না, ছড়িয়ে পড়ে একাধিক মাত্রায়। আরেক প্রধান চরিত্র খুলনাভী হুজুরের রহস্যময়তা পাঠককে যুগপৎ মুগ্ধ ও রোমাঞ্চিত করে। তার লোমকূপে শিহরণজাগানিয়া ক্ষমতাগুলোও চমৎকৃত করে পাঠককে। চরিত্রটির একাধিক দিক উন্মোচিত হয় গল্পের বিভিন্ন বাঁকে। নিজের সাথে নিজের অন্তর্গত দ্বন্দ্ব তার মাঝেও পরিলক্ষিত হয়, যে কলহে তার ভেতর আসে পরিবর্তন। যদিও তার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গল্প বর্ণিত হয়নি বলে তার ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব সম্পর্কে পাঠক খুব একটা জানতে পারে না, শুধু দুয়েকটা স্থানে আভাস পেতে পারে। যেমন, শুরুতে তাকে দেখা যায় মাদ্রাসার ছেলেদেরকে অল্পতেই নির্মমভাবে বেত্রাঘাত করছেন। শুধু তা-ই নয়, শিশুদের বেত্রাঘাতের স্বপক্ষে তাকে হাদিসও উপস্থাপন করতে দেখা যায়। কিন্তু সেই একই চরিত্র বেশ খানিকক্ষণ পর কোনো একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বলে ওঠে,
‘বুঝলি ফয়েজ, তাকওয়া আসতি হবে মন থিকা, ইসলাম চাপায়ে দেয়ার জিনিস না। ’
আর ঠিক এই স্থানেই চরিত্রটি একমাত্রিক অবস্থানের ঊর্ধ্বে উঠে একাধিক মাত্রা লাভ করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, খুলনাভী হুজুর শুধু দ্বিমাত্রিক নন, তিনি বহুমাত্রিক। সেটা কীভাবে তা পাঠক গল্পের বিভিন্ন মোড়ে নিজেই খুঁজে নেবে।
যেকোনো গল্পের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে তার এন্টাগনিস্ট বা ভিলেন। একজন শক্তিশালী ভিলেন একটি গল্পের আবেদনকে শতগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। সেই কারণেই আমরা বিখ্যাত লেখকদেরকে দেখি তাদের বইয়ের ভিলেনদেরকে শুধু এক সমতলে না রেখে বহু সমতলে ছড়িয়ে দিতে। সেই ভিলেন বা এন্টাগনিস্টদের থাকে নিজস্ব দর্শন, যুক্তি ও আবেগ। কারো কারো ভেতর আবার খুব স্বল্প পরিমাণে থাকে মানবতার ছোঁয়া। প্রজেক্ট হাজার-আল-ফালাসিফাহ’র প্রধান সীমাবদ্ধতা হলো এখানে ভিলেন সম্পর্কে পাঠক খুব একটা জানার সুযোগ পায় না। তার চরিত্রায়ন একমাত্রাকে ছাড়িয়ে ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। প্রধান এন্টাগনিস্টকে আরো সময় দেয়া যেত, তার চরিত্রায়নে আরো যত্নশীল হওয়া উচিত ছিল।
সন্দেহ নেই, রহস্য গল্পের প্রধান আকর্ষণ টুইস্টের আনাগোনা এই গল্পে বেশ অহরহই ঘটেছে যা পাঠককে ধাক্কা দেবে, বাধ্য করবে বিস্মিত হতে। তবে এখানে উপযুক্ত ফোরশেডো বা পূর্বাভাসের অভাব আছে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ব্যাপারে যদি আগেই ফোরশেডো করা হতো, তবে সেটি গল্পের মজাকে আরো বাড়িয়ে দিত।
প্রজেক্ট হাজার-আল-ফালাসিফাহ’র আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, এই থ্রিলার উপন্যাসে এমন কিছু ইসলামিক টার্ম আছে যেগুলো হয়তো অনেকেরই জানা নেই। বইটি পাঠান্তে পাঠক সেগুলো সাথে পরিচিত তো হয়ই, সেই সাথে টার্মগুলোর সাথে যে রোমাঞ্চ মিশে আছে তাও পাঠককে গ্রাস করে নেয়।
প্রজেক্ট হাজার-আল-ফালাসিফাহ কোনো এক সমতলীয় গল্প বলে না, এর পরতে পরতে জাল বুনেছে জটিলতা। কাহিনীর ভেতর লুকিয়ে আছে কাহিনী। এই জটিল গল্পগুলো পাঠককে আনন্দ দেয় তার ভেতর থাকা একাধিক স্তরের কারণে।
গল্প বলার প্রয়োজনে প্রায়ই লেখকদেরকে কোনো চরিত্রের পেছনের কাহিনী দেখাতে হয়। লেখক এখানে বেশকিছু অতীতের কাহিনী স্রেফ চরিত্রের মুখ দিয়ে বলেননি, দেখিয়েছেন। ফলে পাঠক একজন চরিত্রের মুখে শুধু একটি গল্প শোনার পরিবর্তে তার আগের কাহিনীগুলো দেখতে পায়, সেই সাথে বুঝতে পারে কাহিনীর সাথে এই ব্যাকস্টোরির কী সম্পর্ক। এই ব্যাপারটি পাঠকের পাঠ-অভিজ্ঞতাকে নিঃসন্দেহে আরো উন্নত করে।
গল্পটির সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক দিক হলো এর তথ্য ও বিজ্ঞান। এটি পাঠান্তে পাঠক শুধুই একটি ফিকশন পড়ার আস্বাদ পায় না, সেই সাথে জানতে পারে অনেক প্রাচীন ইতিহাস। জ্ঞান অর্জন করে বিজ্ঞানের অনেক দিক সম্পর্কে। ফিকশনের সাথে এত চমৎকারভাবে ইতিহাস, তথ্য, বিজ্ঞান আর ফ্যান্টাসির মিশ্রণ আসলে খুব বেশি দেখা যায় না। এই মিশ্রণকে আদর্শ দ্রবণ হিসেবে বিবেচনা করলে সেখানে দ্রাবক হিসেবে থাকে গল্পের প্লট। আর ইতিহাস, বিজ্ঞান, তথ্য ও ফ্যান্টাসি হচ্ছে চারটি ভিন্ন দ্রব। দ্রবণটির দিকে তাকালে এর কোনো উপাদানই আলাদাভাবে নজরে আসে না; বরং সবকিছু মিলিয়ে সমস্বত্ত্ব দ্রবণের মতো একটি একক অস্তিত্ব বা দৃশ্য চোখের সামনে ফুটে ওঠে। এই দ্রবণ তৈরির কাজটা আদপে এতটা ঝুঁকিপূর্ণ যে তা সঠিকভাবে প্রস্তুত করতে না পারলে পাঠকের কেবল বিরক্তিই উৎপাদন করে। বলা বাহুল্য, এই দূরুহ কাজটি সম্পাদন-সক্ষম লেখকের সংখ্যা অত্যল্প। তাসরুজ্জামান বাবু এই মিশ্রণটি এমন অনস্বীকার্য দক্ষতার সাথে প্রস্তুত করেছেন যে যাবতীয় তথ্যাদি, ইতিহাস, বিজ্ঞান বা ফ্যান্টাসি উপাদানগুলো কাহিনীর সাথে শতভাগ দ্রবীভূত হয়ে তৈরি করেছে একটি আদর্শ দ্রবণ।
যেকোনো গল্পের স্বার্থকতা নিরূপিত হয় এর উপযুক্ত পরিণতির মাধ্যমে। যত ভালো গল্পই হোক, অসার্থক পরিণতি গল্পের সমস্ত মজাকে এক গ্রাসে খেয়ে ফেলতে পারে। প্রজেক্ট হাজার-আল-ফালাসিফাহ এমন এক গল্প, যার অন্তিম পরিণতিতে এসে পাঠক পূর্ণাঙ্গতার আস্বাদ পায়, সেই সাথে উপহার হিসেবে পায় একটি পরিচিত বিষয় সম্পর্কে সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। এই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি তাকে রোমাঞ্চকর কিছু জানায়, নতুনভাবে ভাবতে শেখায়। দিনশেষে এটাই প্রজেক্ট হাজার-আল-ফালাসিফাহ’র সবচেয়ে বড় স্বার্থকতা।
বই সম্পর্কিত তথ্য:
বইয়ের নাম: প্রজেক্ট হাজার-আল-ফালাসিফাহ
ঘরানা: থিওলজিক্যাল থ্রিলার
লেখক: তাসরুজ্জামান বাবু
প্রকাশনা সংস্থা: সময় প্রকাশন
প্রচ্ছদ: তাসরুজ্জামান বাবু
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১৮৪
মুদ্রিত মূল্য: ৩২০ টাকা
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৯
এমজেএফ