ঢাকা, রবিবার, ১৪ পৌষ ১৪৩১, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

‘এই পৃথিবীটা একদিন বাউলদের হয়ে যাবে’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৯
‘এই পৃথিবীটা একদিন বাউলদের হয়ে যাবে’

ঢাকা: ‘এই পৃথিবীটা একদিন বাউলদের হয়ে যাবে’- যিনি মনেপ্রাণে একথা বিশ্বাস করতেন ও তার ভক্তদের বলতেন, তিনি হলেন বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম।

১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি হাওড় অঞ্চলখ্যত সুনামগঞ্জের দিরাই থানার কালনী নদীর তীরে উজানধল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন শাহ আবদুল করিম। আর ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর সকাল ৭টা ৫৮ মিনিটে থেমে যায় তার জীবন নামক গাড়িটা।

মৃত্যুর কিছুদিন আগেই তিনি লিখেছিলেন, ‘চলিতে চরণ চলেনা, দিনে দিনে অবশ হই, আগের বাহাদুরি এখন গেলো কই’। প্রতিটি মানব জীবনের চরম বাস্তবতার কথা এতটা সহজে বলতে পারা যেনো শাহ আবদুল করিমের পক্ষেই সম্ভব।

অতি দরিদ্র একটি পরিবারে জন্ম নেওয়ায় আবদুল করিমের লেখাপড়ার সুযোগ হয়নি। গ্রামের নাইট স্কুলে কয়েকদিন পড়েছিলেন। তবে পরিবারের একমাত্র ছেলে হওয়ার তাকে যোগ দিতে হয়েছিল কাজে। চরম দারিদ্র আর জীবন সংগ্রামের মাঝে বেড়ে ওঠার পরেও আবদুল করিমের সঙ্গীত সাধনা ছোটবেলা থেকেই শুরু হয়। আবদুল করিমের জীবন সংগ্রাম এবং গানের সাধনা দেখে মনে হয়, এ যেন বিদ্রোহী কবি নজরুলেরই গল্প। নিজের দারিদ্রের কথা গানের মধ্য দিয়ে বলতে গিয়েই শাহ আবদুল করিম লিখেছিলেন, ‘মাঠে থাকি গরু রাখি, ঈদের দিনেও ছুটি নাই, মনের দুঃখ কার কাছে জানাই’।

আবদুল করিমের স্ত্রীর নাম মমজান বিবি। তার ডাক নাম ছিল বৈশাখী। অনেকে ভুলবশত তার স্ত্রীর নাম আফতাবুন্নেসা বলেন। তবে শাহ আবদুল করিম তার স্ত্রীকে আদর করে সরলা বলে ডাকতেন।  

তিনি নিজেই বলেছিলেন ‘যদি সরলা আমার জীবনসঙ্গী না হতেন, তাহলে আমিও শাহ আবদুল করিম হতে পারতাম না। নিজের বেশ কিছু গানও তিনি সরলার নামে লিখেছেন।

শাহ আবদুল করিম দেহতত্ত্ব, বিচ্ছেদ সঙ্গীত, প্রণয়গীতি, জারি, সারি, মাঝি-মাল্লার গান, জীবনতত্ত্ব, জাগরণের গান, আঞ্চলিক গান এবং দেশের গানসহ প্রায় হাজারেরও বেশি গানের সৃষ্টি এবং সুর করেছেন। ভাটি অঞ্চলের মানুষের সুখ-দুঃখ, প্রেম-ভালোবাসা সেইসঙ্গে দেশপ্রেম এবং অসাম্প্রদায়িকতার কথা উঠে এসেছে করিমের গানে। তিনি অতীতের সঙ্গে বর্তমান সময়কে খুব সহজ-সরলভাবে তুলে এনেছেন গানের মাধ্যমে।

শাহ আবদুল করিম অসংখ্য গান লিখে এবং সুর করে বাংলা বাউল সঙ্গীতের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য গানগুলো হচ্ছে- ‘কেনো পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু’ ‘আমি কুল হারা কলঙ্কিনী’, ‘তোমরা কুঞ্জ সাজাওগো’ ‘ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায়’, ‘গাড়ি চলে না, চলে না, চলে নারে’  ‘আসি বলে গেল বন্ধু’ ‘বসন্ত বাতাসে সইগো’ ‘বন্ধে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে’ ‘কেমনে চিনিব তোমারে মুর্শিদ ধনহে’ ‘আমি ফুল বন্ধু ফুলের ভ্রমরা’ ‘রঙ্গের দুনিয়া তোরে চাই না’। তার গানের বাণী এবং সুরের মধ্য দিয়ে দেশ-বিদেশে অসংখ্য বাঙালির হৃদয় জয় করেছেন। তাইতো ভাটি বাংলার করিম ভাইয়ের খ্যাতি আজ বিশ্বময়।

শাহ আবদুল করিম তার সৃষ্টির জন্যে একুশে পদক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী সম্মাননা, মেরিল-প্রথম আলো ‘আজীবন সম্মাননা’ পুরস্কার এবং সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস আজীবন সম্মাননাসহ বেশ কিছু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তবে শাহ আবদুল করিম তার একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আমার পুরুস্কার তো আমি অনেক আগেই পেয়েছি। কাগমারী সম্মেলনে আমার গান শুনে মাওলানা ভাসানী যখন আমার পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন, তুই একদিন গণমানুষের শিল্পী হবি। এর থেকে বড় পুরস্কার আর কী হতে পারে আমার জীবনে?  

গানের সাধনা করার জন্য জীবনে আবদুল করিমকে অনেক লাঞ্ছনা-বঞ্চনা এবং তিরস্কার সহ্য করতে হয়েছে। কেউ তাকে নাস্তিক, আবার কেউ কমিউনিস্ট বলে আখ্যাও দিয়েছেন। গান গাওয়ার কারণে তাকে ঈদের জামাত থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। তবে তিনি ছিলেন ঈশ্বরে বিশ্বাসী চরম অসাম্প্রদায়িক একজন মানুষ। তার গানগুলো ভালো করে শুনলেই ইশ্বরের প্রতি তার বিশ্বাসের প্রমাণ মেলে।     

জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বাউল শাহ আবদুল করিম একটি সংগীতালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তার স্বপ্ন ছিল দেশ-বিদেশ থেকে গান পিপাসুরা এখানে এসে সঠিক-শুদ্ধ সুরে বাউল গান শিখবেন, গবেষণা করবেন। কিন্তু অর্থনৈতিক দৈন্যতার কারণে বাস্তবায়ন হয়নি তার এ স্বপ্ন।

তবে বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের সৃষ্টিগুলো ধরে রাখতে ও তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন তার একমাত্র সন্তান শাহ নুর জালাল করিম।  

শাহ নুর জালাল করিম বাংলানিউজকে বলেন, বাবার সঙ্গীত বিদ্যালয়ের অবস্থা জরাজীর্ণ। অনেক মানুষ এখানে গান শিখতে আসেন, তবে বিদ্যালয়ে গানের তেমন কোনো বাদ্যযন্ত্র নেই। বিদেশ থেকেও মানুষ আসে, তাদের থাকার কোনো জায়গা নেই। শাহ আবদুল করিম অভাব অনটনের মধ্যেও যা সৃষ্টি করে গেছেন, সেগুলো জাতীয়ভাবে না হয় কোনো ব্যক্তি উদ্যোগে সংরক্ষণ করা দরকার। বর্তমানে প্রায় ৭০০ গানের পাণ্ডুলিপি আছে, এগুলো সংরক্ষণ করতে না পারলে হারিয়ে যাবে।

দেশবরেণ্য সাহিত্যিক, পরিচালক হুমায়ুন আহমেদ একটি ঘরোয়া আড্ডায় ‘আজ রবিবার’ নাটকের হিমু চরিত্রের অভিনেতা ফজলুল কবির তুহিনের কণ্ঠে ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’ গানটি শোনেন। এই গানটি আমরা এখন যে সুরে শুনি, সেই সুরটিও করেছেন হিমুখ্যাত অভিনেতা ফজলুল কবির তুহিনই। গানটি হুমায়ুন আহমেদের এতটাই ভালো লেগে যায় যে, গান ও গানের গীতিকার সম্বন্ধে তিনি ভীষণ আগ্রহী হয়ে ওঠেন।  

সেদিনের স্মৃতি প্রসঙ্গে ফজলুল কবির তুহিন বাংলানিউজকে বলেন, আমার কাছ থেকে আবদুল করিমের ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’ গানটি শুনে হুমায়ুন আহমেদ স্যার আবদুল করিমের সঙ্গে দেখা করার জন্য, তার গান শোনার জন্য সাংঘাতিকভাবে আগ্রহ প্রকাশ করেন। আমাকে স্যার দায়িত্ব দিলেন শাহ আবদুল করিমকে ঢাকায় নিয়ে আসার।  

‘তাকে ঢাকায় আনতে আমার অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। শাহ আবদুল করিম ছিলেন একজন প্রচার বিমুখ মানুষ। আমি প্রায় একবছর চেষ্টা করে আবদুল করিমকে ঢাকায় নিয়ে আসি। স্যারের ইচ্ছা ছিল শাহ আবদুল করিমের গান আধুনিক কিছু যন্ত্রসংগীতের মাধ্যমে জনপ্রিয় কিছু গায়ককে দিয়ে কম্পোজ করানো, যাতে সারাদেশের মানুষ আবদুল করিমের গান শুনতে পারে এবং আবদুল করিমকে জানতে পারে। ’ 

‘‘এরপর সুবীর নন্দী গাইলেন- ‘আমি কূলহারা কলঙ্কিনী’, দিলরুবা খান গাইলেন- ‘আমি ফুল বন্ধু ফুলের ভ্রমরা’, বেবি নাজনীন- ‘তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো’, সেলিম চৌধুরী- ‘মানবে কি, বুঝবে কি’ আর আমি গাইলাম- ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’,’’ যোগ করেন ফজলুল কবির তুহিন।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) শাহ আবদুল করিমের এক অনুষ্ঠান প্রচার হওয়ার পর থেকেই সারাদেশের মানুষ তার গান সম্বন্ধে জানলো এবং তিনি দেশ-বিদেশে ব্যাপক পরিচিত হয়ে ওঠেন। তারপর আরও অনেকেই তার গান গাইতে শুরু করলো। একটা কথা আছে- গুণীজনের কদর গুণীজনেরাই জানে। হুমায়ুন আহমেদ শাহ আবদুল করিমের একটি গান শুনেই বুঝতে পেরেছিলেন তার প্রতিভা।  

শাহ আবদুল করিম বাঙালির হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবেন তার কালজয়ী সব গানের মাধ্যমে। শাহ আবদুল করিমের সঙ্গীত বিদ্যালয় এবং তার সৃষ্টি কর্মগুলো যেনো হারিয়ে না যায়, সেজন্য সুনামগঞ্জে শাহ আবদুল করিম জাদুঘর নির্মাণের দাবি করেন বাউল গান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। যা করা গেলে বাউল সম্রাট আবদুল করিমকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হবে বলেও মনে করেন তারা।

বাংলাদেশের সময়: ১০৪০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৯
আরকেআর/এসএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।