সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার মিশেলে এই জীবন। একগুচ্ছ মুহূর্তের কোলাজ।
খেলতে দেখেছি তাকে কলজে এবং চুনি দিয়ে
মরতে দেখেছি আমি তাকে
আব্দুল ওয়াহাব আল-বায়াতি
(আরব কবি)
১.
সকাল থেকে আকাশ ফুটো হয়ে বৃষ্টি ঝরছে। কাদায় সয়লাব হয়ে আছে ঢাকা শহর। পুরান ঢাকার অলিগলিতে পানি উপচে পড়ছে। বৃষ্টির পানি ড্রেনের পানির সঙ্গে মিশে কালো রং ধরেছে, দুর্গন্ধ আসছে। এই কাদাপানির মধ্যে সোবাহানকে ঘরের বাইরে যেতে হবে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সিনেমার গান শোনার উপায় নাই!
সোবাহানের বাবা লালু শেখ কানের কাছে রেডিওর মতো একটা গান ছেড়ে রেখেছে, কামে যা, কামে যা। হুমুন্দির পুত ঘর থিকা বাইর হবি না? আর কত শুইয়া থাকবি? তোর চেহারা দেখলে কি পেট ভরবো?
যে মা তগো জন্ম দিছে সে আজ কয়দিন ধইরা হাসপাতালে পইড়া আছে ঐখানে যাওনের নাম নাই। কারে কী কই? সব বাঞ্চোৎ আমার ঘরে জন্ম নিছে।
সোবাহানের বাপ্ লালু শেখ ঘরের দরজায় বসে প্যাচাল পাড়তে থাকে। ছেলের কানে দু-একটা কথা ঢোকে আবার কানে হেডফোন লাগিয়ে নতুন ধরনের হিন্দি গান শুনতে থাকে। সোবাহানের এই একটাই শখ গান শোনা। দুনিয়াতে যে কত রকমের গান আছে, ভাবলে সোবাহানের তালু গরম হয়ে যায়। কিন্তু সকাল সকাল এই বেজন্মা বাপের প্যাচাল শুনলে মাথার মধ্যে খুন ধরে যায়। বিছানা ছেড়ে হাত-পা ঝাড়া দিয়ে নিচে নামে সোবাহান। ঘরটা খুব ছোট, চারদিকে নোনাধরা দেয়াল। মাথার উপর সিলিঙের রড বের হয়ে আছে, যেন হা করা রাক্ষস গিলে খাবে। ঘরের মাঝ বরাবর দড়ি ঝোলানো। দড়িতে গেঞ্জি, প্যান্ট, শার্ট, আন্ডারওয়্যার সব ঝুলছে। কাপড়গুলো থেকে বোটকা গন্ধ আসছে। সোবাহানের গা গুলিয়ে ওঠে, অনেকদিন কাপড় ভালো করে ধোয়া হয় না। লাইলী ঘরের কাজ কিছুই করে না। সারাদিন মহল্লার বখাটে ছেলেদের সঙ্গে ফালতু আড্ডা, ঘোরাঘুরি। ছোটবোন লাইলীর প্রতি রাগে সোবাহানের গা জ্বলতে থাকে।
গতবছর সূত্রাপুর থেকে এক ছেলে আসলো লালবাগে মামার বাড়িতে, লাইলী তার সঙ্গে প্রেম করা শুরু করে দিল। সোবাহানের বন্ধুরা ওর বোন সম্পর্কে নানা কথা বলাবলি করে। লাইলী নাকি ওই ছেলের সঙ্গে ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটায়, চরিত্র খারাপ হয়ে গেছে, আরও কত কী! সোবাহান সারাদিন বাইরে বাইরে কাজে ব্যস্ত থাকে, এতো খবর রাখার সময় নাই তার। বাপটা হইছে ভাদাইম্যা, সারাদিন ঘরের দরজায় বইসা পুরানো দিনের প্যাচাল পাড়ে আর কিছু করার মুরোদ নাই।
লালু শেখ একসময়ে লঞ্চের সারেং ছিল। পানিতে ভেসে বেড়াতো। নদীর নীল জল আর আসমানের নীল এক হয়ে যেত, কখনও মুষল বৃষ্টি, কখনও প্রখর রোদ। সব আবহাওয়ায় নদীতে যেতে হতো। ঝড়ের তাণ্ডবে নদীর শান্ত জলই রুদ্র রূপ ধারণ করতো। তখন আর তাকে চেনা যেত না, একদম আগ্রাসী, ভয়ঙ্কর।
জল নেশার মতো শুধু টানে, টানতেই থাকে। ডাঙায় এলেও দরিয়ার জন্য ছটফটানি। ঘর-বাড়ি, সংসার, স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে সবাইকে ফেলে তার জীবন ছিল ওই দরিয়ার মধ্যে বাঁধা। কত ঘাটে লঞ্চ ভিড়িয়েছে। লঞ্চ নিয়ে বেশিরভাগ সময় বরিশাল, ভোলা, মাদারীপুর এইসব জায়গায় গিয়েছে। কত মানুষের সঙ্গে পরিচয়, তাদের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। মাদারীপুরের রহমত ভাই লালু শেখকে আপন ভাইয়ের মতো দেখতো, বিপদে-আপদে এগিয়ে আসতো। একবার লঞ্চে একটা লাশ পাওয়া গেলো মাদারীপুরে যাওয়ার পর। থানা, পুলিশ, কত হাঙ্গামা কিন্তু রহমত ভাই সব সামলে নিলো, লালু শেখের গায়ে একটা টোকাও লাগতে দেয় নাই। আপন ভাইরা আজ লালু শেখের খবরও রাখে না। সব চকবাজারের দিকে চলে গেছে, নানারকম ব্যবসা-বাণিজ্য করে আজ ভালো অবস্থায় আছে। একটা বোন ছিল, মরে গেছে।
রহমত ভাই সেই আগের আত্মীয়তা ধরে রেখেছে, একটু মলিন হতে দেয় নাই। লোক দিয়ে মাদারীপুর থেকে ডাব-নারকেল, পিঠা, নাড়ু, বরফি কত কিছু পাঠায়। দরিয়ায় ভেসে থাকার সময় বাড়ির কথাও ভুলে যেত লালু শেখ, আজ কত বছর হলো দরিয়ায় যায় না। কিন্তু দরিয়া যেন লালু শেখকে ডাকতে থাকে, ঘুমের মধ্যে আচমকা জেগে ওঠে। এক মুহূর্তের জন্যও সে আগের স্মৃতি ভুলে থাকতে পারে না।
বাপ-দাদারাও এই পেশায় ছিল। সাহেব-সুবোদের সঙ্গে তাদের কারবার ছিল। ঘাটে বড় বড় জাহাজ আসতো কলকাতা থেকে, বোম্বে থেকে, রেঙ্গুন থেকে, বিলাত থেকে। জাহাজের কাপ্তেনের সঙ্গে সারেং হয়ে তারা দেশ-বিদেশে ঘুরতো, জাহাজ চালাতো। কত দেশে তারা গেছে। মিশর, আরব, রেঙ্গুন আরও কত নাম, তার হিসাব নাই। একবার জাহাজ ছাড়লে কবে দেশের তীরে ভিড়বে বলা যেত না। হজের সময় মানুষ নিয়ে যেত আরব দেশে। লালু শেখের দাদা ভারতের গোয়া বন্দরে গিয়ে একটা জমিও কিনেছিল, সেখানে একজনকে বিয়ে করে, ছেলে-মেয়ে হয়। এসব শোনা কথা, লালু শেখের দাদি নূরজাহান বিবি কোনোদিন বিশ্বাস করতো না।
বলতো মানুষ দেশ-বিদেশে ঘুরলে, আয়-উন্নতি করলে অমন কত কথা রটনা হয়। আমার স্বামী কোনোদিন কথার খেলাপ করে নাই। আমারে রাইখা কোনোদিন একটা খাবার খায় নাই। পুরান ঢাকার মহল্লায় আমার মতো ইজ্জত খুব কম মাইয়ালোক পাইছে। লোকের খাইয়া কাজ নাই, আমাগো মইধ্যে ভাঙন ধরানোর জন্য যত আকথা-কুকথা কয়। হিংসা হিংসা আর কিছু না।
লালু শেখের কাছে তার দাদার আমলের একটা বিলাতি কয়েন আছে। কয়েনের মধ্যে রানির ছবিটা ঝাপসা হয়ে গেছে। কয়েনটাকে এখন একটি ধাতব পিণ্ড ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। লালু শেখ মাঝে মধ্যেই ঘরের একটা পুরানো সিন্ধুক থেকে কয়েনটা বের করে নাড়াচাড়া করে, তার গন্ধ শোকে, পুরানো দিনের স্মৃতি রোমন্থন করে। সিন্দুকটা লালু শেখের দাদার আমলের, এখন আগের জৌলুস কিছুই নাই। কাঠের তৈরি সিন্দুকের উপরের ডালা খুললে সারি করে কিছু কাঠের খোপ দেখা যায়। খোপগুলোতে কারুকাজ করা ঢাকনা দেয়া। গোলাপি রঙের তুলো দিয়ে ফুল বানানো কাচের মধ্যে। লালু শেখ খুব যত্ন করে ডালাটা খোলে। উপরের খোপকাটা অংশটা খুলে নামিয়ে রাখলে ভেতরে কাঠ দিয়ে বিভাজন করা কয়েকটা অংশ। এই বিভাজনগুলোতে কারুকাজ করা ঢাকনি। ময়ূর, পাখি, নানা ফুল। হিন্দুদের থেকে কেনা হয়েছিল। আগেকার দিনে বনেদি হিন্দুদের বাড়িতে সুক্ষ কারুকাজ করা কাঠের নানা আসবাবপত্র থাকতো। সিংহের পায়ের নকশা লাগানো চেয়ার, বাঘের পায়ের টেবিল, ময়ূরপঙ্খী পালঙ্ক, বেলজিয়াম কাঠের ড্রেসিং টেবিল। সেসব আসবাবপত্র তৈরি করার জন্য তেমন শিল্পী ছিল। যারা বংশ-পরম্পরায় এই কাঠের কাজ করতো। লালু শেখদের ঘরেও একটা ময়ূরপঙ্খী পালঙ্ক ছিল, সেই পালঙ্ক দেখার জন্য অনেক মানুষ আসতো বাড়িতে।
লালু শেখ প্যাচাল পাড়তে থাকে। শোন লাইলী আমার দাদির অনেক অলংকার ছিল, সেইগুলা সে এই সিন্দুকে ছোট ছোট তামার কৌটার মধ্যে ভইরা রাখতো। একটা দুই নড়ি হার ছিল। দাদি যখন নীলাম্বরী শাড়ির সাথে হারখানা পড়তো তারে রানির মতো দেখাইতো, সারা মহল্লার মানুষ দাদিরে দেখনের জন্য চুপি মারতো। কিন্তু হে আছিলো পর্দানশীন, কেউ কোনোদিন তার চেহারা দেখে নাই। শুনছি তার গায়ের রং আছিলো মুক্তার মতো গোলাপি। সাধারণ ঘরের মাইয়ালোক ছিল না। বিক্রমপুরের বেলায়েত খাঁদের ঘরের বেটি। তখন দাদার অনেক নাম ডাক। জাহাজের সারেং, টাকা-পয়সা ভালো, একটাই সমস্যা সারাবছর দরিয়াতে থাকে, ডাঙায় কবে আসে-যায় বলা যায় না। এলাকার সবাই চিনতো, মান্য করতো, যখন দেশে থাকতো তারে ছাড়া কিছুই হইতো না। সব আলাপ-সালিশে তার থাকা চাই। ইয়া লম্বা, ঘন কালো চুল, চেহারায় একটা খানদানি ভাব।
দাদারাতো এই এলাকায় আসছে বর্মা থিকা। কোনো পূর্ব পুরুষ নৌকায় ভাসতে ভাসতে বুড়িগঙ্গার পাড়ে আইসা উপস্থিত হয়, এইখানে বসতি গড়ে। দাদার সাথে সম্বন্ধ করার জন্য কত বনেদি ঘর থেকে প্রস্তাব আইতো, শেষে দাদার বাপজান বিক্রমপুর থিকা দুধে-আলতা মিশানো রঙের নূরজাহান বিবিরে ছেলের বউ করে ঘরে আনল। ওই বিয়েতে হাজার লোক খাইছে। পুরান ঢাকার নামজাদা বাবুর্চি মোগলাই বিরিয়ানি রান্না করেছে। এলাকার মুরুব্বিরা বলতো অমন রান্ধন নাকি জীবনে খায় নাই। বড় বড় মাছ ভাজি, কাচ্চি বিরিয়ানি, মোরগ-মোসাল্লাম, দই-মিষ্টি। এলাকায় তখন অনেক হিন্দু পরিবার আছিলো সেইজন্য গরু রান্না হইতো না। এই এলাকায় সব বড় বড় বংশীয় হিন্দুরা থাকতো। তারাই এলাকাগুলোর পত্তন করছে। কত দালান-কোঠা। পূজার সময় আমরাও জামা-কাপড় নিতাম। কত খাইছি হিন্দুগো পূজা-পার্বনে। চ্যাটার্জিদের বাড়িতে পিসিমা আমারে খুব আদর করতো। নাড়ু-মুড়কি তুইলা রাখতো আমার জন্য।
ঘরে গেলেই বলাইরে ডাকতো, বলাই এই বলাই লালুরে বসতে দে, পিঁড়ি দে। ব্রাহ্মণদের ঘরে মুসলমানের ঢোকার নিয়ম ছিল না কিন্তু আমি পিসির শোয়ার ঘর পর্যন্ত গেছি।
নভেরা হোসেন
জন্ম ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫, মাদারীপুর শহরে নানাবাড়িতে। শৈশব থেকেই ঢাকায় বেড়ে ওঠা। তিনি লেখাপড়া করেছেন ধানমন্ডির কাকলি উচ্চ বিদ্যালয়, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ এবং নৃবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। লিটল ম্যাগাজিনে লেখা শুরু করেছেন ২০০০ সালের পর থেকে। বিশেষত কবিতা, গল্প ও নৃবৈজ্ঞানিক লেখালেখি করেন। e-mail: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১০১৩ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০২০
টিএ