সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার মিশেলে এই জীবন। একগুচ্ছ মুহূর্তের কোলাজ।
১০
লাইলী সোবাহানের দেওয়া নম্বর দুটোতে ফোন দিলে একটা বন্ধ পায় অন্যটি ধরে একজন ভারী গলার লোক।
হ্যালো।
হ্যালো, জি স্লামালাইকুম ভাই। আমি লালবাগের সোবাহানের বোন।
হুম কও।
ভাইরে ছাড়ানোর জন্য আপনারে ফোন করতে বলছিল।
বললেইতো আর হবে না। অনেক খরচ-পাতি আছে, কোর্ট-কাছারি, উকিল-পুলিশের ঝামেলা আছে, নানান ফ্যাসাদ। হাতে টাকা-পয়সা আছে? কেস খুব জটিল।
টাকা অল্প কিছু দিতে পারব।
আচ্ছা নিয়ে আসো দেখি কী করা যায়। একা আসতে হবে, কাউকে সাথে করে আনা যাবে না।
লাইলী বাবার চিকিৎসার কথা বলে মোস্তাক সাহেবের কাছ থেকে দশ হাজার টাকা ধার করে। মোস্তাক বলে তোমাকে টাকা দিতে আমার অসুবিধা নাই। কিন্তু শোনো যখন তোমাকে চাইব, আসতে হবে। কখনও না করতে পারবে না। তোমাকে নিয়ে একটা গেস্ট হাউজে যাব। ঐটা আমাদের। ওখানে কয়েকদিন থাকবে। সময় পেলেই যাব।
কিন্তু বাড়িতেতো আব্বা অসুস্থ, তাকে রেখে কেমনে যাব?
ঐসব আমি জানি না, ম্যানেজ করবে, এই নাও টাকা এটা ফেরত দেওয়া লাগবে না, তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। তোমার মধ্যে ছিনালীপনা কম। অন্য মেয়েরাতো স্ট্রিট গার্ল। একদম রাস্তা থেকে উঠে আসছে।
লাইলী টাকা নিয়ে সোবাহানের পরিচিত বড় ভাইয়ের কাছে যায়। মোহাম্মদপুরে রাজিয়া সুলতানা রোডে একটা একতলা পাকা বাড়ি। বাড়িতে অনেকদিন রং করা হয় নাই। গেটে মরিচা ধরে গেছে। বাসার বাম পাশে একটা বড় ঝোপের মাধবীলতা গাছ। সারা গাছ ফুলে ছেয়ে আছে। লাইলী কিছুক্ষণ মাধবীলতা ঝাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকল। এত সুন্দর ফুল, অথচ তার তেমন কোনো গন্ধ নাই।
এতদূরে লাইলী কখনও আসে নাই। ওর দৌড় পুরান ঢাকার লালবাগ থেকে ওয়ারী। নতুন ঢাকায় ওরা খুব একটা আসা-যাওয়া করে না। বেশ কয়েকবার কলিং বেল বাজানোর পর ভেতর থেকে একটা শুকনামতো ছেলে বেরিয়ে এলো।
লাইলী বললো মতিন ভাই আছেন? উনি আমাকে আসতে বলছেন।
আছে, আসেন।
বারান্দার পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকলো লাইলী। ঘরের মধ্যে নানা জিনিস ছড়ানো। কেমন সব রাসায়নিক দ্রব্যের ঘ্রান, কিছু একটা বানানো হচ্ছে। ছোট ছোট শিশিতে লাল, নীল, সবুজ নানা রঙের তরল। একটা বড় কার্টুন ভর্তি নানারকম গুঁড়ো পাউডার। ছেলেটি লাইলীকে ভেতরের ঘরে নিয়ে যায়। ওখানে দুজন লোক বসা। একজন খুব মোটাসোটা, একটা লুঙ্গি আর সেন্ডো গেঞ্জি পরে আধশোয়া হয়ে বিছানায়, অন্যজন একটা পাঞ্জাবি গায়ে, চুলগুলো একটু লম্বা।
লম্বা চুলের মতিন লাইলীকে দেখে বললো।
বসো বসো।
লাইলী দাঁড়িয়ে রইল।
সত্যি সোবাহানের জন্য খারাপ লাগে। কত ভালো ছেলে। করও সাথে-পাছে নাই। আমাদের সাথে কত মিল-মহব্বত করে চলতো। আজ বিপদে পড়ছে বলে আমরা হেল্প করব না? তাতো হয় না। মতিন লাইলীকে পাশে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কথা বলে।
ফেন্সি-ড্র্যাগ এইসবের লাইনটাই খারাপ। সোবাহান ভালো ছেলে, ভদ্র। তোমাদের বংশ ভালো কিন্তু ওর মাথা গরম। যদি আরেকটু বুঝে শুনে চলতো, তাহলে এত সমস্যা হতো না। দেখি ওর জন্য কী করতে পারি।
লাইলী চুপ করে খাটে বসে থাকে। মতিন একটু একটু করে ওর সারা শরীরে হাত বোলাতে থাকে। লাইলী দম বন্ধ করে বসে থাকে।
তোমার বাবা কেমন আছে?
বাবার শরীর ভালো না, চিকিৎসা চলতেছে।
বাবার খেয়াল রাখো।
কই দেখি কত টাকা আছে সাথে দাও।
লাইলী ব্যাগ থেকে দশ হাজার টাকা তুলে দেয় মতিনের হাতে।
এই টাকা দিয়ে তো কিছুই হবে না। পুলিশের চা-সিগারেটও হবে না। পঞ্চাশ হাজারের মতো জোগাড় করো, উকিল ধরি ওর শাস্তি কিছু কমানো যায় কি-না চেষ্টা করি। তবে কত টাকা লাগবে এর কোনো হিসাব নাই। তুমি পারবা টাকার জোগাড় করতে?
ভাই এই উপকারটা করেন আমাদের। ভাইজানকে জামিন করানো যাবে না?
শোনো মেয়ে এটা মুখের কথা না। ওর নামে মার্ডারের মামলা দেওয়া আছে। তাও ভালো উকিল হইলে দিনকে রাইত বানানো যায়। মতিন একটু একটু করে লাইলীর জামার ভেতরে ব্রাতে হাত দেয়। লাইলী হঠাৎ খাট থেকে উঠে বলে, মতিন ভাই এখন আমি যাই, কাজে যাইতে হবে। দেরি হইয়া গেছে।
মতিন বলে এত তাড়াহুড়ার কী? আসছো বসো, চা-নাস্তা খাও।
লাইলী দরজার দিকে যেতে উদ্যত হয়। অন্য লোকটি ঘর থেকে বের হয়ে যায়। মতিন দরজার সাথে লাইলীকে ঠেসে ধরে। লাইলী ছোটার চেষ্টা করে, হাত-পা নাড়াতে থাকে। মতিন লাইলীকে ছেড়ে দিয়ে বলে এত রাগ নিয়ে আসছো শরীরে? যাও ভাগো।
লাইলী মতিনের হাত ধরে বলে আপনি আমার ভাইয়ের মতো, একটু চেষ্টা করেন। আপনার টাকা জোগাড় করে দেব।
মতিন খাটের ওপর উঠে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলে আচ্ছা টাকা নিয়ে আসো আমি উকিলের সাথে কথা বলতেছি। তবে পঞ্চাশ হাজারের কম না। লাইলী মোহাম্মদপুর রাজিয়া সুলতানা রোডের রং জ্বলা বাসাটি থেকে বেরিয়ে বড় করে শ্বাস নেয়।
সব শালা কুত্তার বাচ্চা। ভাইর এতদিনের বন্ধু, আজ ওকে একা পেয়ে হামলে পড়েছে। জামিন করবে না ঘোড়ার ডিম! চোখ ফেটে পানি চলে আসে লাইলীর। সব টাকা খাওয়ার ফন্দি! এখন আর কাউকে বিশ্বাস করা যাবে না। ভাই যাদের বিশ্বাস করেছে তারা কেউ ওর জন্য কিছু করে নাই। কিন্তু এই অবিশ্বাসীদের কাছেই আজ ওরা জিম্মি, ভাইকে ছাড়ানোর জন্য হয়তো আবার এই মতিনের কাছেই আসতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতে লাইলী কাকরাইলে যাওয়ার জন্য সিএনজি ঠিক করে।
আজ নাসিমার মেজাজ খুব ভালো, সারা বাড়ি ফুল দিয়ে সাজানো। মেয়েরা সাজগোজ করে বসে আছে। নাসিমা ড্রইংরুমে সোফায়, সবাই তাকে ঘিরে। একটা সুরমা রঙের সিল্কের শাড়ি, পাথরের অলংকার পরে নাসিমা বেশ রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে আছে। মেয়েরা কেউ সোফায় বসে, কেউ কার্পেটে।
নাসিমা মেয়েদের ডেকে বলে সবাই শোনো, আজ আমাদের জন্য একটা আনন্দের দিন। আমার ছোট বোনের ছেলে হয়েছে, ওরা লিবিয়া থাকে। সবাই তোমরা আজ আমার মেহমান। কারও কোনো কাজ করা লাগবে না। কাস্টমারদের ফোন বন্ধ করে রেখেছি। সবাই ওদের জন্য দোয়া করো, আল্লাহ যেন ওদের ভালো রাখে। চুমকি ভেতর থেকে মিষ্টি, কেক, সমুচা, কোক এনে সবাইকে খেতে দেয়। ঘরে উচ্চস্বরে গান বাজছে। মেয়েরা কেউ কেউ নাচতে শুরু করে। নাসিমা বলে সবাই আনন্দ করো। প্রতিদিন কাজ করো আজ বিশ্রাম, আনন্দ, খাওয়া-দাওয়া। রাতে ফখরুদ্দিনের বিরানি আসতেছে।
নাসিমার ঘরে দশ থেকে পনেরোজন মেয়ে কাজ করে। বেশিরভাগই নিম্ন-মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। লুসি ব্যতিক্রম, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। খুব চটপটে মেয়ে, ভালো ইংরেজি জানে। নাসিমার কিছু বিদেশি খদ্দের আছে তাদের জন্য লুসিকে রাখা হয়েছে। লুসি নিজেও কিছু খদ্দের নিয়ে আসে। একটা বায়িং হাউসের সাথে ওর ভালো জানাশোনা। ওখানে যেসব বিদেশি বায়ার আসে, তারা অনেকে লুসিকে ফোন করে। অনেক সময় লুসি তাদের সাথে হোটেলে যায়, অনেক সময় নাসিমার ডেরায় নিয়ে আসে। নাসিমার কাছেও কিছু ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানি খদ্দের আসে, তখন লুসির খোঁজ পরে। নাসিমা ইদানিং ভাবছিল লাইলীকে বিদেশি খদ্দরদের কাছে পাঠানো যায় কিনা। কিন্তু মোস্তাক এ কথা শোনার পর নাসিমাকে স্রেফ জানিয়ে দেয় এখন থেকে রুমকিকে বিদেশি কেন, দেশি কারও কাছেও পাঠানো যাবে না। এই নিয়ে নাসিমার সাথে মোস্তাকের তর্ক-বিতর্ক হয়। নাসিমা বলে রুমকি আমার এখানে কাজ করে, আমি তাকে যেভাবে চালাব সে তা মেনে চলতে বাধ্য।
কিন্তু আমি রুমকির জন্য তোমাকে ডাবল টাকা দেব, তুমি ওকে অন্য কারও কাছে পাঠাবে না এটা আমার অনুরোধ।
নাসিমা চুপ করে থাকে। প্রথম কিছুদিন মোস্তাকের কথা মতো লাইলীকে মোস্তাক ছাড়া অন্য কারও কাছে পাঠায় না। কিন্তু আবার পাঠানো শুরু করে।
এ কথা জানার পর মোস্তাক লাইলীকে বলে তুমি নাসিমার এখানে আর কাজ করো না, আমি তোমাকে আমার গেস্ট হাউজে নিয়ে যাব। তুমি বাসায় থাকবে লালবাগে, যেদিন আমি যাব গাজীপুর তোমাকে সাথে করে নিয়ে যাব। কয়েকদিন থাকব, আবার চলে আসব।
লাইলী বলে কিন্তু নাসিমা আপাকে কী বলব?
বলবে তুমি আর কাজ করবে না, অন্য চাকরি পেয়েছো।
কিন্তু আমার কথা ওরা বিশ্বাস করবে? যদি কোনো ঝামেলা করে?
ঝামেলা করলে, আমি দেখব, তুমি মোবাইলের সিম বদলে ফেলো। ওদের কারও ফোন ধরবে না। আমি তোমাকে ভালো টাকা দেব। তোমার ভাইয়ের মামলা চালানোর টাকা দেব।
লাইলী সোবহানকে ছাড়ানোর টাকা জোগাড় করার জন্য মোস্তাকের প্রস্তাবে রাজি হয়।
লালু শেখ জানে মেয়েকে অফিসের কাজে সিলেট যেতে হবে। ওই কয়দিন নূরীর মা ঘরের কাজ করবে। রান্না-বান্না, লালু শেখের দেখা-শোনা সব করবে নূরীর মা। অনেকদিনের বিশ্বস্ত লোক, লালু শেখের স্ত্রী জোৎস্না তাকে দিয়ে অনেক সময় কাজ করাতো।
লাইলী তোর এই চাকরিটা কিন্তু আমার ভালো ঠেকতেছে না। সিলেটে কী কাজ? তুই তো ঢাকার অফিসে কাজ করিস।
আব্বা ওনারা সিলেটে আরেকটা অফিসে খুলছে। মাসে কয়েকবার যাইতে হবে। ট্রেনিং দিবে!
কী জানি আমি তোর কথার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝি না। তুই যা বলতেছিস তাই মাইনা নিতেছি।
আব্বা তুমি এত চিন্তা কইরো না।
তুই তো কোনোদিন ঘর থেকে এত দূরে যাস নাই কোনোদিন।
যাই নাই, তাই যাইতে হবে না কোনোদিন? লালবাগের এই ঘুপচি ঘরেই কী পইড়া থাকুম সারাজীবন?
নভেরা হোসেন
জন্ম ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫, মাদারীপুর শহরে নানাবাড়িতে। শৈশব থেকেই ঢাকায় বেড়ে ওঠা। তিনি লেখাপড়া করেছেন ধানমন্ডির কাকলি উচ্চ বিদ্যালয়, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ এবং নৃবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। লিটল ম্যাগাজিনে লেখা শুরু করেছেন ২০০০ সালের পর থেকে। বিশেষত কবিতা, গল্প ও নৃবৈজ্ঞানিক লেখালেখি করেন। e-mail: [email protected]
আরও পড়ুন>> লালবাগ (পর্ব-৯)
বাংলাদেশ সময়: ১০০২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০২০
টিএ