১.
বেঁচে থাক আমাদের প্রধানমন্ত্রী
বৈভবে
বিলাসে
ক্ষমতায়
এবং
কবি বিনয় মজুমদার
ক্ষুধা
শোক
আর
শূন্যতায়...
বছর কয়েক আগে একবার কোনও এক পত্রিকায় খবর দেখলাম, কবি বিনয় মজুমদার গুরুতর অসুস্থ। মনে আছে এরও বছর কয় আগে একবার ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় মৃত্যুর দিনকয় আগে শিল্পী এস এম সুলতানের মারাত্মক অসুস্থতার কথা ছাপা হয়েছিল।
বিনয় মজুমদার আর এস এম সুলতানের ক্ষেত্রে একটা মিল আছে, দুজনেই ‘প্রতিষ্ঠা’ পাবার পরও নিজের শেকড়েই ফিরে গিয়েছিলেন, এরপর আমৃত্যু বিনয় মজুমদার ছিলেন তার গ্রাম শিমুলপুরে আর সুলতান মাছিমদিয়ায়। দুজনেই ছিলেন অবিবাহিত।
বিনয়ের সংবাদটি জানার পরই হঠাৎ একদিন দেখলাম দেশের প্রধানমন্ত্রী কোথাও যাচ্ছেন। ক্বরিৎকর্মা নিরাপত্তাকর্মী ও ট্রাফিকদের কল্যাণে ঢাকার যানজটবহুল রাস্তাও কেমন ফাঁকা, সুমসাম। তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে যেন একটি মাছিও যেতে পারবে না। যার যত কাজ বা তাড়া থাক, সবাইকে স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করা হয়েছে ফুটপাথে। তারপর অনেকটা সময় কেটে গেলে দেখা গেল প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর রাজকীয় ভঙ্গিতে সাঁই সাঁই করে চলে গেল। এসবের মধ্যে মতা বিলাস আর বৈভবের কী প্রাচুর্য! যদিও এই দৃশ্য নতুন কিছু নয়, কিন্তু পৃথিবীর এক নিঃস্ব কবি আর মতাবান প্রধানমন্ত্রীর তুলনাটা হঠাৎই মনে এল। এবং উভয়ের জন্যই কল্যাণ প্রার্থনা করতে ইচ্ছে হলো। আর রচিত হলো এই ক্ষুদ্র কবিতাটি। প্রসঙ্গত, এই কবিতার শিরোনাম ‘কল্যাণকাব্য’। এটি গ্রন্থিত হয়েছে আমার প্রথম বই ‘শহর যৌবন ও রাত্রি’-তে।
২.
বিনয় মজুমদার তার ‘ফিরে এসো, চাকা’র ভিতর দিয়ে বাংলা কবিতায় এমন এক দৃশ্য-ভাবনার নতুনত্ব আনলেন, যা অনেকটাই অভূতপূর্ব। রবীন্দ্রনাথের পর জীবনানন্দই সবচে বেশি শব্দের ভিতর দিয়ে বোধের অপূর্ব অর্থ বের করে আনলেন, শব্দের অর্থকে বহুদূর প্রসারিত করে দিলেন আর বোধকে শব্দের ভিতর দিয়ে চারিয়ে দিয়ে বোধ আর শব্দ উভয়েরই ইলাস্টিসিটি বাড়িয়ে দিলে বহু বহু পরিমাণে। আর বিনয় মজুমদার অনেকটা জীবনানন্দের হাত ধরেই করলেন আরও একটি নতুন ধরনের কাজ। তিনি পরিচিত শব্দ আর দৃশ্যের ভিতর দিয়ে তার বোধকে এমনভাবে প্রকাশ করলেন, যাতে খুব চেনা বস্তু-দৃশ্যও আরও অর্থময় আর বাঙ্ময় হলো। পরিচিত শব্দ-বস্তুও অপরিচিত আর নতুন অর্থ নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হলো। আমাদের মনে হলো, এই বিষয়টি কেন আমরা এইভাবে আগে দেখিনি! বিনয় এভাবেই তার দার্শনিক প্রতীতী খুব নির্ভার ও সহজ ভাষায় তুলে আনলেন কবিতায়। বাংলা কবিতা পেল এমন এক কাব্যদার্শনিককে, যিনি কবিতার শব্দশক্তিকে আরও সম্প্রসারিত করলেন। কবিতায় বোধ প্রকাশের নতুন কৌশল চিনিয়ে দিয়ে গেলেন। এত দিন বাংলা কবিতায় যা ছিল প্রায়-অনাস্বাদিত, প্রায়-অজ্ঞাত তাকে তিনি তার সহজাত-স্বভাব দিয়ে করে তুললেন একটি ঘরানা।
পরবর্তী সময়ে বিনয় নিজেকে আরও বহুদূর প্রসারিত করেছেন। কবিতার সঙ্গে গণিতের, কবিতার সঙ্গে পাগলামির, কবিতার সঙ্গে জীবনের সবকিছুকে এমনভাবে অঙ্গীভূত করে নিলেন যে, তার সবকিছুই হয়ে উঠল কবিতা, যেন তিনি পরিণত হলেন এক কবিতা-গাছে, যার ফল হিসেবে কেবল কবিতাই ঝরে। এমনকি তার ডায়রির পাতা, ছেঁড়া কাগজে লেখা, কিংবা অবহেলায় টুকে রাখা দু-চারটে পঙক্তিও আমাদের কাছে কবিতার চেহারা নিয়ে হাজির হয় আর মনে হয়, এ কেবল কবি বিনয় মজুমদারই করতে পারেন।
বিনয়, সত্যিকার অর্থেই, এই একুশ শতকের কুজ্ঝটিল পৃথিবীতেও, কবিতা হয়েই বেঁচে রইলেন। যেন এর কোনও বিকল্প ছিল না, থাকতে পারে না। তাই মৃত্যুর চার বছর পরও মনে হয় বিনয় মজুমদার মৃত্যুবরণ করেননি, আছেন আমাদের মাঝখানে, তার সমস্ত রচনা আর সব কষ্ট-যাতনা-পাগলামিসমেত। বিনয়, বাংলা কবিতায়, বেঁচে থাকবেন আরও বহুকাল। কেননা, বিনয়-পাঠ ছাড়া বাংলা কবিতার পাঠ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, যদি কেউ হন সত্যিকারের কবিতা-পাঠক।
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৫১৫, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১০