২৬ নভেম্বর শনিবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টায় সিডনিস্থ কনকর্ডে “অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার রাজনীতিতে বাঙ্গালিদের অংশগ্রহণঃ সমস্যা এবং সম্ভাবনা” শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ড. শাখাওয়াৎ নয়ন এর মূল প্রবন্ধ পাঠ ও সঞ্চালনায় এবং বঙ্গবন্ধু কাউন্সিল, অস্ট্রেলিয়ার সার্বিক ব্যবস্থাপনায় গোলটেবিল বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়।
উক্ত গোলটেবিল বৈঠকে আলোচক হিসেবে অস্ট্রেলিয়ান লিবারেল পার্টির সাবেক সংসদ সদস্যপ্রার্থী মোহাম্মাদ জামান টিটু, বঙ্গবন্ধু কাউন্সিলের সভাপতি শেখ শামীমুল হক, প্যারাম্যাটার প্রাত্তন কাউন্সিলর প্রবীর মৈত্র, ক্যাম্পবেল টাউন সিটি কাউন্সিলের বর্তমান কাউন্সিলর মাসুদ চৌধুরী, সিটি অফ কানাডা বে কাউন্সিলের বর্তমান কাউন্সিলর ড. তানভীর আহমেদ, গ্রেটার প্যারাম্যাটা এবং ব্লাকটাউনের লেবার পার্টির ইলেক্টরেট সুমন সাহা, লেবার পার্টির লাকেম্বা ব্রাঞ্চের সভাপতি জামিল হোসেন, লিবারেল পার্টির কিংসফোর্ড এলাকার ট্রেজারার এডভোকেট আমজাদ খান, লেবার পার্টি নেতা আল-নোমান শামীম, স্ট্রার্থফিল্ডের সিটি কাউন্সিলের কাউন্সিলর রাজ দত্ত এবং লেখক অজয় দাশগুপ্ত অংশগ্রহণ করেন।
ড. শাখাওয়াৎ নয়ন তাঁর মূল প্রবন্ধে মূলত অস্ট্রেলিয়ার তিন স্তর বিশিষ্ট সরকার ব্যবস্থায় (স্থানীয়, প্রাদেশিক এবং কেন্দ্রীয়) বাঙ্গালিদের অংশগ্রহণ, সফলতা এবং বিফলতার একটি সম্যক চিত্র তুলে ধরেছেন। প্রবন্ধকার অন্যান্য আলোচকদের কাছে প্রশ্ন রেখেছেন, ইংল্যান্ডে যদি টিউলিপ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে পারেন, তাহলে অস্ট্রেলিয়াসহ অন্যান্য যেসব দেশে বাঙ্গালিরা বসবাস করেন তারা কেন পারবেন না? প্রবন্ধকার প্রবাসী বাঙ্গালিদের মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতির প্রতি প্রবল আকর্ষণ, এবং একই সাথে যে দেশে থাকেন সেই দেশের রাজনীতির প্রতি দুঃখজনক উদাসীনতার বিষয়ে গভীর হতাশা ব্যক্ত করেন।
আলোচনার শুরুতেই শেখ শামীমুল হক বঙ্গবন্ধু কাউন্সিল আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণ করার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বলেন, ‘আমরা আজকে আমাদের কমিউনিটির জন্য গুরত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেছি। এটা আমাদের একটি বড় পরিকল্পনার প্রথম প্রয়াস। আমরা নিয়মিত ভাবে কমিউনিটির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে ধারাবাহিকভাবে গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করবো এবং মিডিয়ার মাধ্যমে তা সবাইকে জানাবার চেষ্টা করবো। এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু কাউন্সিলের পক্ষ থেকে আপনাদের সহযোগিতা কামনা করছি’। অতঃপর তিনি আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘এই দেশে বাঙ্গালি কমিউনিটির জন্য কিছু করতে হলে, আপনাকে অবশ্যই রাজনীতি অথবা ব্যবসা করতে হবে। অন্য পেশায় থেকে আপনি উল্লেখযোগ্য কিছু করতে পারবেন না’।
অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ প্রবীর মৈত্র বলেন, অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা খুব কঠিন নয়। অস্ট্রেলিয়ার যে কোনো নাগরিক কিংবা পার্মান্যান্ট রেসিডেন্ট মাত্র ২০ ডলার ফি দিয়ে লেবার পার্টির সদস্য হতে পারেন, যদি তার বিরুদ্ধে কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের রেকর্ড না থাকে। তবে কেউ যদি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবার জন্য এদেশের রাজনীতিতে আসতে চান; তাকে নিরুৎসাহিত করছি। কারণ এই দেশে কেউ রাজনীতি করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারে না। সেই সুযোগ নেই। কিন্তু কেউ যদি জনসেবা করতে চান, নিজের কমিউনিটি বাংলাদেশিদের জন্য কিছু করতে চান, এমনকি বাংলাদেশের জন্যও কিছু করতে চান, অবশ্যই তাঁর অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা উচিৎ। ‘
কাউন্সিলর এবং লেখক ড. তানভীর আহমেদ ইংরেজিতে বক্তব্য রেখে বলেন, ‘যারা সত্যি সত্যিই মানুষের জন্য কাজ করতে ইচ্ছুক, শুধুমাত্র তাদেরই রাজনীতিতে আসা উচিৎ। রাজনীতি সবার জন্য নয়’। তিনি অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার রাজনীতিতে বাঙ্গালিদের আরো বেশি অংশগ্রহণের উপর গুরত্বারোপ করেন। মোহাম্মাদ জামান টিটু ফেডারেল নির্বাচনে অংশগ্রহণের অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘সংসদীয় এলাকা ওয়াটসন থেকে লিবারেল পার্টির একজন প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছি; জয়ী হতে পারিনি। তবে উক্ত আসন থেকে লিবারেল পার্টির পক্ষে এ যাবৎকালের মধ্যে আমিই সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছি, যা প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্ণবুলও বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। আজকের এই গোলটেবিল বৈঠকের মাধ্যমে সবার উদ্দেশ্যে জানাতে চাই, আমি নির্বাচিত হতে পারিনি, তাতে কোনো দুঃখ নেই। কারণ আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ঠিকই একদিন এদেশে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবে। এরকম একটি বিষয় নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করার জন্য তিনি বঙ্গবন্ধু কাউন্সিলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন’।
লেবার পার্টির নেতা এবং মাসিক মুক্তমঞ্চের সম্পাদক আল-নোমান শামীম মূল প্রবন্ধকারের সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতিতে আমাদের প্রথম প্রজন্মের সফলতা খুব কম নয়। আমরা যদি আরেকটু কৌশলী পদক্ষেপ নিয়ে আগাই, তাহলে আরো সফলতা পাওয়া যাবে। বাঙ্গালিরা যেহেতু লেবার পার্টিকে অপেক্ষাকৃত বেশি পছন্দ করে, তাই যেসব এলাকায় লেবার পার্টির ভোট বেশি সেসব এলাকা থেকে নির্বাচনে মনোনয়ন পাবার চেষ্টা করতে হবে। তাহলেই জয়ী হবার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। একই সাথে আমি ইয়ং লেবারদের ব্যাপারে খুবই আশাবাদী। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের অনেকেই ইয়ং লেবার পার্টিতে বেশ ভালো করছেন’।
লেবার পার্টির নেতা জামিল খান বাঙ্গালি কমিউনিটির ঐক্যের ব্যাপারে জোর দিয়ে বলেন, ‘একতাবদ্ধ হওয়া ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারবো না’। কাউন্সিলর মাসুদ চৌধুরী বিশেষভাবে বলেন, ‘এদেশে যে কেউ রাজনীতিতে আসতে পারে। কোনো সমস্যা নেই কিন্তু মনে রাখতে হবে-- এদেশে কেউ চেয়ে কোনো পদ পায় না। দল যাকে যেভাবে মূল্যায়ন করে, সে সে রকম পদ পায়। দলই বলবে ‘উই নিড ইউ ইন দিস পজিশন’। দলে দায়িত্বশীল পজিশনে যেতে হলে কাজ করতে হবে; লেবার পার্টিতে ‘ৠাংক এন্ড ফাইল’ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়’।
লিবারেল পার্টির নেতা আমজাদ খান বলেন, ‘লিবারেল পার্টি ধনীলোকের পার্টি। মেম্বার হতে ১০০ ডলার লাগে, অন্যদিকে লেবার পার্টিতে লাগে ২০ ডলার । দলীয় কাজ-কর্মও খুব একটা সহজ নয়। কমিটিতে থাকতে হলে প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়। সেটা সব সময় সম্ভব হয় না। সুতরাং এদেশে রাজনীতি করতে হলে সিরিয়াসলি করতে হয়’। লেবার পার্টির নেতা সুমন সাহা এ রকম একটি বিষয়ের গোলটেবিল বৈঠকে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য বঙ্গবন্ধু কাউন্সিলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘প্রবাসে থেকে বাঙ্গালিদের জন্য কিংবা নিজের জন্মভূমির জন্য কিছু করতে হলে মূলধারার রাজনীতিতে অংশগ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। বাঙ্গালিরা অধিক সংখ্যক হারে অস্ট্রেলিয়ান রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করলে আমরা কোনো দিনই খুব একটা ভালো অবস্থায় যেতে পারবো না। এক্ষেত্রে বাঙ্গালিদের মূলধারার রাজনীতির প্রতি উৎসাহী করে তুলতে হবে। আর এই কাজে আমাদেরকে সাহায্য করতে পারে বাঙ্গালিদের মিডিয়া এবং কমিউনিটি সংগঠনগুলো। বঙ্গবন্ধু কাউন্সিলের মতো যদি অন্যান্য সংগঠনগুলোও এভাবে আমাদেরকে প্লাটফর্ম তৈরি করে দিত, আমার বিশ্বাস আমাদের অর্জন এবং অগ্রগতির পরিমাণ আরো অনেক বেশি হতো’।
কলামিস্ট অজয় দাশগুপ্ত বলেন, ‘বিদেশে আমাদেরকে বিভাজিত করছে বাংলাদেশের রাজনীতি। যুক্তরাজ্যে টিউলিপের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া প্রসংগে তিনি প্রবন্ধকারের সাথে একমত পোষণ করে বলেন, আমাদেরকে নিজের ঘর থেকে কাজ শুরু করতে হবে। পরিবারের সদস্যদেরকে উৎসাহিত করতে হবে। নিজের ঘরে পরিবর্তন আনতে পারলেই সামগ্রিক পরিবর্তন হয়ে যাবে’। স্ট্রার্থফিল্ডের সিটি কাউন্সিলের কাউন্সিলর রাজ দত্ত মুঠোফোনের মাধ্যমে গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনায় অংশগ্রহণ করে অধিক সংখ্যক বাঙ্গালিকে মূলধারার রাজনীতিতে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান। উল্লেখ্য, উক্ত গোলটেবিল বৈঠকটি আয়োজনে সুরজিৎ রায় বিশেষ ভাবে সহযোগিতা করেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৮২২ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩০, ২০১৬
আরআই