ঢাকা, শনিবার, ৬ পৌষ ১৪৩১, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

এভিয়াট্যুর

জলের স্বর্গ গ্রেট ফলস

মোকারম হোসেন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৫০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৪
জলের স্বর্গ গ্রেট ফলস

নিউইয়র্কের চায়না টাউন থেকে ওয়াশিংটন ডিসির উদ্দেশে বাস ছাড়ার পরই আত্মীয় মাসুদকে জানিয়ে দিয়েছি। আপাতত আর কোনো দুশ্চিন্তা নেই।

সময় হিসেব করে মাসুদ বাসস্ট্যান্ডে এসে আমাকে নিয়ে যাবে।

পথের দু’পাশের দৃশ্য খুবই মনোমুগ্ধকর। আমেরিকায় গ্রীষ্ম উৎসব শুরু হয়েছে। চারপাশ ঘন সবুজে মোড়ানো। বিচিত্র বুনোফুলও ফুটেছে। এসব দেখতে দেখতে কখন যে ৫ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলো, টেরই পেলাম না।

পৌঁছে গেলাম ওয়াশিংটন ডিসি। আবহাওয়া বেশ চমৎকার। গরমের মাত্রাটাও মোটামুটি সহনীয়।

মাসুদ যথাসময়ে গাড়ি নিয়ে উপস্থিত। আমরা যাব ভার্জিনিয়ার উডব্রিজ এলাকায়, মাসুদের বাসায়। ঘণ্টাখানেকের ড্রাইভ। কিন্তু সময় এক ঘণ্টা হলেও বৈচিত্র্যের শেষ নেই। কারণ চারপাশে অত্যাধুনিক দালানকোঠা যেমন আছে তেমনি আছে নয়নাভিরাম লেক, নদী, জনপদ, বিরানভূমি আর মাঝারি গোছের জঙ্গল।

সবচেয়ে পুলকিত হয়েছি বিখ্যাত পটোম্যাক নদী দেখে। এ নদীর কথা কত যে শুনেছি! আরো মজার ব্যাপার হলো পটোম্যাক পাহাড়ি নদীর মতো গোটা ভার্জিনিয়াকে জড়িয়ে রেখেছে। নদীটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ৬৫২ কি.মি., আর নদীর দু’তীরে বসবাস প্রায় ৫ লাখ লোকের। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, পটোম্যাকের হয়তো আলাদা সৌন্দর্য আছে কিন্তু আমাদের নদীর মতো এতটা রূপসী আর কোথাও দেখিনি। কোনো এক মায়াবি সন্ধ্যায় পদ্মা আর পটোম্যাকের পাড়ে বসে থাকার অনুভূতি তো আর এক হতে পারে না!

প্রথম দিন মাথার ভেতর ঢুকে যাওয়া এই পটোম্যাক কিন্তু আমাকে ছাড়লো না। এই ফাঁকে একদিন সদলবলে স্থানীয় আরেকটি নদীও দেখা হলো, কিন্তু নিয়তি বার বার আমাকে পটোম্যাকের কাছেই নিয়ে গেল। মাত্র কয়েকদিন পরই এলো সেই বিশেষ সুযোগ।

মেহেদী হাসান প্রস্তাব দিল, চলুন গ্রেট ফলস ঘুরে আসা যাক। মেহেদী টাঙ্গাইলের ছেলে। পড়াশোনা করছেন ভার্জিনিয়ার জর্জ মেইসন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এবার অবশ্য নানা কারণে দল ভারি করে নায়াগ্রা যাবার পরিকল্পনাটা বাতিল করতে হয়েছে। তাই মেহেদীর লোভনীয় প্রস্তাবটা লুফে নিলাম। অগত্যা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো যাক।

পরদিন খুব ভোরে আমরা বেরিয়ে পড়ি। ভার্জিনিয়া প্রাকৃতিক ভাবে সমৃদ্ধ আমেরিকার একটি অঙ্গরাজ্য। যে দিকেই গিয়েছি, বন-বাদাড়ে ভরা। চারপাশ বাহরি ফুল আর লতা-গুল্মে আচ্ছাদিত। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ম্যগানোলিয়ার রকমফের আর সুগন্ধি হানিস্যাকল। আছে বর্ণিল অ্যাজালিয়াও। ছোটখাটো টিলা, গড়ানো রাস্তা আর সবুজের সমারোহ ভার্জিনিয়াকে ভিন্ন সুষমা দান করেছে। যাবার পথেই সিনানদহ রিভার এবং চার্লস শহরটা দেখা হয়ে গেল।

এখানকার প্রকৃতি যতটা শৈল্পিক তার চেয়েও বেশি সুসজ্জিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। শহর ছাড়িয়ে খানিকটা দূরেই কিছু খামারবাড়ির দেখা মেলে। অবশ্য অনুমতি ছাড়া এসব বাড়িতে ঢোকা নিষেধ। সাধারণত বদরাগী রেডনেকরাই এসব খামারের মালিক।

গ্রেটফলস পার্ক এলাকায় পৌঁছাতে প্রায় দুপুর। জায়গাটির অবস্থান ভার্জিনিয়ার ফেয়ারফেক্স কাউন্টিতে। টিকিট কেটে গাড়ি নিয়ে আমরা পার্কিং এলাকায় ঢুকে পড়ি। কোনো ভিড় নেই। ফলে শব্দ দূষণও নেই। আমাদের দেশে এমন দর্শনীয় স্থানে পৌঁছানোর অন্তত আধা কিলোমিটার আগেই বেশ টের পাওয়া যায়। শব্দদূষণ, জলদূষণ ভূমিদূষণ আর কাকে বলে। তার সঙ্গে আছে বিভিন্ন পর্যায়ের দালালদের উৎপাত। এখানে এসব অকল্পনীয়। কানপাতলে শুধু জল গড়ানোর শব্দ।

পার্কিং এলাকা থেকে কয়েক পা এগোলেই গ্রেটফলস। দুপুর বলে তেমন ভিড় নেই। যেখানে দাঁড়ালে যুৎমতো জলগড়ানোর দৃশ্যটা দেখা যাবে এমন কয়েকটি স্থানে ঝুলবারান্দার মতো করা হয়েছে। দর্শনার্থীরা সেখানে দাঁড়িয়েই গোটা জলপ্রপাতের দৃশ্য দেখে।

পাড় ধরে খানিকটা এগুনোর পরই মেহেদী একটি স্মারক দণ্ড দেখালো। তাতে কোন সালে জলপ্রপাতের জল কতটা উঁচুতে উঠেছে তার পরিসংখ্যান লিপিবদ্ধ আছে। দণ্ডটির নাম ‘হাই ওয়াটার মার্কস’। ১৯৩৬ এবং ১৯৪২ সালে সবচেয়ে বেশি পানি উঠেছিল এখানে। দণ্ডের পাশে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারি উচ্চতায় আমার দ্বিগুণ তো হবেই।

আমরা অনেকটা সামনে গিয়ে একটা ঝুল বারান্দায় দাঁড়াই। মাথার উপরে ঝকঝকে নীল আকাশ। চারপাশে সোনারোদ ছড়িয়ে আছে। অনেক দূর থেকে সফেদ জলরাশি সমান্তরালভাবে ভেসে এসে লাফিয়ে পড়ছে অনেক নিচে। তারপর পাথুরে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে আরো নিচে গড়িয়ে পড়ছে। এভাবেই একটি গভীর জলধারা ছুটে চলছে বন-প্রান্তর, লোকালয় ছাড়িয়ে আরো অনেক দূরে। আর এখান থেকেই বিখ্যাত পটোম্যাক নদীর জন্ম। খুবই চমকপ্রদ তথ্য। গ্রেটফলস না এলে এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি কখনোই জানা হতো না।

আমাদের উল্টোদিকে সবুজে মোড়ানো অনুচ্চ পাহাড়। অনেক ঘোরানো পথে দু’জন মৎস শিকারী ছিপ নিয়ে বসে আছে নিচে। সাহসের তারিফ করতে হয়। ঝুলবারান্দা থেকে তাদের চুনোপুঁটির মতো মনে হচ্ছে।

এতক্ষণ তো জলের গান শোনা হলো। আর দেখাও হলো জলের রাজসিক ভঙ্গিতে ছুটে চলার আয়োজন। এবার জলধারার উৎস সন্ধানে খানিকটা এগুনো যাক। আমরা নদীর পাড় ধরে উজানের দিকে হাঁটতে থাকি। গাছপালার ঘনত্ব থাকলেও লতা-গুল্মের তেমন কোনো ঠাসবুনন নেই। উষ্ণমণ্ডলীয় আর শীতের দেশের বনাঞ্চলে এটা প্রধান পার্থক্য। উজানের দিকে অনেকটা চওড়া সমতল মাঠের মতো। আমাদের হাতের কাছেই ঘোলাজল ছুটে চলছে তার গন্তব্যে।

বেশ খানিকটা যাবার পর দুর্গম হয়ে ওঠে পথ। সাহেবী কেতায় আর হাঁটা সম্ভব নয়। আমরা কিছুক্ষণ দাঁড়াই। কান পেতে উজানজলের ছলছাতুরী বোঝার চেষ্টা করি...   

প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে। আর মাস শেষে ‘ট্রাভেলার্স নোটবুক’র সেরা লেখকের জন্য তো থাকছেই বিশেষ আকর্ষণ..

আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।  

প্রিয় পাঠক, আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন-[email protected] এই ঠিকানায়।


বাংলাদেশ সময়: ০২৫৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।