ঢাকা, শনিবার, ৬ পৌষ ১৪৩১, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

এভিয়াট্যুর

ঘুরে আসুন চন্দ্রদ্বীপ

শামসীর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪২ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০১৪
ঘুরে আসুন চন্দ্রদ্বীপ ছবি: লেখক

আপনার কোথাও ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করছে, আবার এজন্য বেশি কষ্টও করতে চাচ্ছেন না। আরামদায়ক, হেলে-দুলে ঘুরে বেড়াতে চান, তাহলে আপনি নিশ্চিন্তে ঘুরে আসতে পারেন চন্দ্রদ্বীপ।

   চন্দ্রদ্বীপ মানে হচ্ছে আজকের বরিশাল। শান্ত নিরিবিলি ছিমছাম একটা শহর, রিকশা দিয়েই পুরো শহর ঘুরে ফেলতে পারবেন আপনি।

বরিশাল শহরের মাধবপাশা এলাকা ছিল বাকলা চন্দ্রদ্বীপ রাজাদের আবাসস্থল। এ কারণে এ এলাকা চন্দ্রদ্বীপ নামেও পরিচিত। যদিও বরিশাল নামকরণ নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে।

কারো কারো মতে অনেক আগে এখানে খুব বড় বড় শাল গাছ জন্মাতো, আর এই বড় শাল গাছের কারণে (বড়+শাল) বরিশাল নামের উৎপত্তি। আবার কারো মতে পর্তুগীজ বেরি ও শেলির প্রেমকাহিনীর জন্য বরিশাল নামকরণ করা হয়েছে।

অন্য এক বর্ণনা মতে গিরদে বন্দরে (গ্রেট বন্দর) ঢাকার নবাবদের বড় বড় লবণের গোলা ও চৌকি ছিল। ইংরেজ ও পর্তুগীজ বণিকরা বড় বড় লবণের চৌকিকে 'বরিসল্ট' বলতো। অথাৎ বরি (বড়)+ সল্ট(লবণ)= বরিসল্ট। পরবর্তী সময়ে বরিসল্ট শব্দটি পরিবর্তিত হয়ে বরিশাল নামে পরিচিতি লাভ করে।

লবণ নিয়ে আপাতত কোনো কাজকর্ম না থাকলেও বরিশালের বর্তমান পরিচয় হচ্ছে- ধান-নদী-খাল, এই তিনে বরিশাল। কীর্তনখোলা নদীর তীরে অবস্থিত বরিশাল, অনেকে একে ‘বাংলার ভেনিস’ও বলে থাকেন, নামটাতেই কেমন যেন একটা ভালো লাগা কাজ করে।

কিভাবে যাবেন:  সড়ক বা নৌপথ দু’ভাবেই যাওয়া যায় বরিশাল, বিমানবন্দর থাকলেও সেখানে এখন কোনো বিমান ওঠানামা করে কিনা সে বিষয়ে জানা নেই। আরামদায়ক ভ্রমণ যেহেতু লক্ষ্য, সেহেতু নৌপথের প্রাধান্যই আগে।


পানি যারা ভয় পান তারাও একবার গিয়ে দেখতে পারেন, লঞ্চ জার্নি আসলেই আরামদায়ক এবং নিরাপদ। আর এই লঞ্চগুলোও ছোট খাট না, কতটুকু বড় সেটা ঢাকা সদরঘাটে গেলেই বুঝতে পারবেন।

বিলাসবহুল এই সব লঞ্চে এসি-ননএসি দু’ধরনের কেবিনই আছে। সুতরাং কিছুটা সময় ডেকে কাটিয়ে , নদীপথের মুক্ত হাওয়ায় আড্ডা গল্পগুজব করে আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়তে পারেন। ঘুম ভাঙবে কেবিন বয়ের ডাকে যখন আপনি বরিশাল ঘাটে পৌঁছে যাবেন। লঞ্চগুলোতে খাওয়া দাওয়ারও সুবন্দোবস্ত আছে, তরতাজা ইলিশ মাছ ভাজা, ইলিশের ডিম রান্না, আইড়, বোয়ালসহ নানা রকম মাছ, আর যারা মাছে তৃপ্ত নন তাদের জন্য মুরগিতো আছেই।

রাতের নৌপথেরও অন্যরকম একটা সৌন্দর্য আছে, আলো জ্বালিয়ে লঞ্চগুলো একে অন্যকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে, আর যখন চাঁদপুরের মোহনায় পৌঁছাবেন তখন দেখবেন বিপরীত দিক থেকেও এগিয়ে আসছে ঢাকাগামী লঞ্চের সারি । রিলাক্স মুডেই কেটে যাবে আপনার সময় ।

ঢাকার সদরঘাট থেকে প্রতিদিন রাতে ছাড়ে এমভি সুন্দরবন (০১৭১৩-০৩২০৮৯, ০১৭১৮৬৬৪৭০০), এমভি সুরভী (০১৭১৩-৪৫০১৪৫, ০১৭১১-৩৩২০৩২), এমভি দ্বীপরাজ (০১৭২৭৭০০৭৭৭), এমভি কীর্তনখোলা (০১৭২৭৭০০৭৭৭), এমভি কালাম খান, এমভি পারাবাত (০১৭১১৩৩০৬৪২, ০১৭১১৩৪৪৭৪৭) ইত্যাদি। এসব লঞ্চে প্রথম শ্রেণির একক কেবিন ৪৫০-৫৫০ টাকা, দ্বৈত কেবিন ৯০০-১০০০ টাকা, এসি কেবিন -১৬০০ থেকে ২৫০০ টাকা ।

কোথায় থাকবেন: ছোট শহর বরিশাল, থাকার জন্য হাতে গোনা অল্প কয়েকটি হলেও বেশ ভালো মানের হোটেল আছে, যেগুলোতে আপনি স্বাচ্ছন্দে উঠে যেতে পারেন। হোটেল এরিনা, এথেনা, ওয়ান, আলী ইন্টারন্যাশনালে নিশ্চিন্তে উঠতে পারেন,

এসি রুমের ভাড়া পড়বে ১০০০-২০০০ টাকার মধ্যে । আর যাদের সরকারি পদস্থ আত্মীয় স্বজন আছে তারা
বিআইডব্লিউটিসি’র গেস্ট হাউজে থাকার ব্যবস্থা করতে পারেন। দোতলা কাঠের বাংলো সামনে পদ্মপুকুর! অলস সময় কাটানোর জন্য এর থেকে ভাল আর কিছু হয় না । লঞ্চ ঘাটে নেমে রিকশা বা ব্যাটারি চালিত অটো রিকশাকে বললেই আপনাকে পৌঁছে দেবে সদর রোড কিংবা কাঠপট্টিতে, যেখানে বেশ কয়েকটি হোটেল রয়েছে।

বরিশালে ঘোরাঘুরি: বরিশালে ঘোরার জন্য আপনার সময় নিয়ে খুব বেশি চিন্তা না করলেও চলবে। হোটেলে পৌঁছে ভালো করে সকালের নাস্তা সেরে আরো কিছু সময় চাইলেই বিশ্রাম নিয়ে নিতে পারেন, ইচ্ছা করলে দুপুর পর্যন্ত ঘুমিয়েও কাটাতে পারেন। ভালো হয় দুপুরের লাঞ্চ শেষ করে ঘোরাঘুরি শুরু করলে।

প্রথম দিনের ঘোরাঘুরির লিস্টে রাখতে পারেন দুর্গাসাগর দীঘি ও গুঠিয়া বায়তুল আমান জামে মসজিদ । একটা অটো চুক্তিতে ভাড়া করে নিতে পারেন, সেই আপনাকে সব ঘুরিয়ে দেখাবে ।

দুর্গাসাগর-বরিশাল শহর থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে মাধবপাশা গ্রামে ছিল বাকলা চন্দ্রদ্বীপ রাজাদের আবাসস্থল। তারা পটুয়াখালী জেলার বাউফল থেকে মগ জলদস্যুদের ভয়ে কিংবা নদী ভাঙনের ফলে এখানে চলে আসেন বলে জানা যায়।

রাজা শিবনারায়ণের স্ত্রী দুর্গাদেবীর নামে নামকরণ করা হয় এ দীঘির। যা এলাকাবাসীর পানি সমস্যার সমাধানের জন্য খনন করা হয়। বিশাল এ জলাশয়ের ঠিক মাঝখানে আছে একটি ছোট্ট দ্বীপ। দীঘির টলটলে জলে গা ভেজানোর ইচ্ছা না জাগাটাই অস্বাভাবিক মনে হতে পারে আপনার, সাথে অতিরিক্ত কাপড় থাকলে একবার ডুব দিয়ে নিতে পারেন আর সাঁতার জানা থাকলে তো কথাই নেই।

কয়েকজন সঙ্গী সাথী থাকলে কিছুক্ষণ সাঁতারও কেটে নিতে পারেন। সুবিশাল ঘাট আড্ডা দিয়ে সময় কাটানোর জন্যও দারুন জায়গা।

গুঠিয়া বায়তুল আমান জামে মসজিদ: দুর্গাসাগর দেখে দিনের আলো থাকতে থাকতে আপনি চলে যেতে পারেন এখানে, সময় লাগবে ২০-২৫ মিনিট। বাংলাদেশে ব্যক্তি উদ্যেগে নির্মিত সম্ভবত সবচেয়ে সুন্দর মসজিদ। বিশাল কম্পাউন্ডের ভেতর পুকুর, হাঁটার রাস্তা। এই মসজিদ দিনের আলোয় এক রকম আর সন্ধ্যার লাইটিং এ সম্পূর্ণ ভিন্ন এক আবহ তৈরি করে, অনেকটা ক্যালেন্ডারের পাতায় দেখা বিদেশি মসজিদগুলোর মতন, সাথে আছে বিশাল মিনার।

এখান থেকে বরিশাল শহরে ফিরে এসে প্রথম দিনের ঘোরাঘুরি শেষ করতে পারেন, রাতে চাইলে রিকশা নিয়ে পুরো বরিশাল শহর ঘুরে দেখতে পারেন, নিরিবিলি পরিষ্কার শহর, অশ্বিনীকুমার টাউন হল, সদর রোডে আছে বাঁধানো ওয়াকওয়েসহ আরেকটি দীঘি, সেটাতে লাইটিংসহ ফোয়ারারও ব্যবস্থা করা আছে, সময় বেশ ভালোই কেটে যাবে আপনার।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সেরে চলে যেতে পারেন কীর্তনখোলা নদীর তীরে নির্মিত মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিপার্কে , নদীর পাড়ে কিছু সময় কাটিয়ে চলে যান বিআইডব্লিউটিসি’র গেস্ট হাউজে, সেখানে আপনার মন ফুরফুরে করে দেওয়ার জন্য রয়েছে পদ্মপুকুর, বিশাল পুকুরের পুরোটা সাদা পদ্মে ঢাকা, এমন পুকুর অন্য কোথাও খুব একটা দেখতে পাবেন বলে মনে হয় না।
বরিশাল এসে জীবনানন্দের স্মৃতির সাথে সাক্ষা‍ৎ না করে ফিরে যাবেন, তাহলে তো ঘুরে বেড়ানোটাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

এবার রিকশা করে চলে যান সোজা বগুড়া রোডে, সেখানে যে কাউকেই বললে দেখিয়ে দিবে জীবনানন্দের পিতামহ ও পিতার আবাসস্থল, যার কল্যাণে তিনিও সেখানে কিছু সময় কাটিয়েছিলেন।

হাতবদল হয়ে সেখানে এখন নতুন অধিবাসীরা বসবাস করলেও কবির স্মৃতিস্বরূপ তারা আদিবাড়ির দুটো পিলার এখনও রেখে দিয়েছেন, বাড়ির নামটিও রেখেছেন ধানসিঁড়ি, পাশেই রয়েছে জীবনানন্দ স্মৃতি মিলনায়তন।

জীবনানন্দের মা কুসুমকুমারী দাশও ছিলেন কবি, তার সুপরিচিত কবিতা আদর্শ ছেলে (আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড়ো হবে )।

বরিশাল শহরের আরেকটি সুন্দর স্থাপনা না দেখে ফিরে যাবার মানে হয় না, গ্রিক স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত অক্সফোর্ড মিশন গির্জা। অনেক বড় এলাকা নিয়ে নির্মিত প্রাচীন এই স্থাপনা ।

এতটুকু ঘুরেই আপনি আপনার চন্দ্রদ্বীপ তথা বরিশাল ভ্রমণ শেষ করে দিতে পারেন, যেহেতু এটি হচ্ছে হেলে দুলে আরাম করে ঘোরার ট্যুর।

এরপরও যদি আপনার ঘোরার ইচ্ছে থাকে তবে ঘুরে আসতে পারেন ঐতিহ্যবাহী বিএম ( ব্রজ মোহন ) কলেজ, সদ্য নির্মিত দপদপিয়া ব্রিজ, তার পাশেই নদীর ওপারে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। হাতে আরেকটু সময় থাকলে বরিশাল থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে চাখার এলাকায়  শেরে বাংলা স্মৃতি জাদুঘর। আর ইচ্ছে না হলে দুপুরে লাঞ্চ শেষে আপনি ফিরতি পথ ধরতে পারেন কিংবা রাতের লঞ্চের জন্য বসে বসে অলস সময় কাটাতে পারেন।

ফিরে আসা: একটু ভিন্ন পথে ফিরতে চাইলে কিংবা যারা কখনো পদ্মা নদী দেখেননি, ফেরীতে চড়েননি তরা চলে যান শহরের কাছেই নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনালে। সেখান থেকে প্রতি ঘণ্টায় বিআরটিসির এসি বাস ছেড়ে যায় মাওয়ার উদ্দেশ্যে, পথে আপনি দু’ঘণ্টার যাত্রায় পাড়ি দিবেন মাদারীপুর আর ফরিদপুর।

মাদারীপুরের রাজৈর পাড়ি দেওয়ার সময় দেখবেন বিস্তির্ণ ধান ক্ষেতের বুকে সারি সারি তাল গাছ, মনে হবে ক্যালেন্ডারের পাতায় দেখা সব তাল গাছের ছবিই বুঝি এখান থেকে তোলা হয়েছে।

মাওয়া-কাওড়াকান্দি ফেরী ঘাটে এসে অপেক্ষমান ফেরীতে চেপে বসুন। ক্ষীণকায় পদ্মা দেখে মন খারাপ হওয়ার আগেই তরতাজা ইলিশ ভাজা দিয়ে একবার ভাত খেয়ে নিতে ভুলবেন না । চলতে চলতে বিশাল চর পড়া পদ্মা দেখে কিছুটা উপলব্ধি করতে পারবেন হয়ত একসময় সে কি ছিল, কেনইবা প্রমত্ত পদ্মা নামে ডাকা হতো এ নদীকে।

সূর্যাস্ত দেখে দু’ঘণ্টা পদ্মার বুকে ফেরী পারাপার শেষে আপনি পৌঁছে যাবেন মাওয়ায়, সেখান থেকে গুলিস্তানগামী বাসে চেপে ফিরতে পারেন বাসায়। আর বাসায় ফিরে শেষ করুন এমনি এমনি হেলে দুলে ঘুরে আসা একটা ভ্রমণ।

আরো তাড়াতাড়ি ফিরতে চাইলে অবশ্য স্পিড বোট দিয়ে ২০-২৫ মিনিটে কিংবা লঞ্চে পদ্মা পাড়ি দিতে পারেন, আর এভাবে ভেঙে ভেঙে না আসতে চাইলে সরাসরি বাসেও বরিশাল থেকে ঢাকা ফিরতে পারেন।

খাওয়া দাওয়া: বরিশাল শহরে খুব বেশি ভালো মানের খাবার হোটেল নেই কিংবা বলা চলে ছোট শহরে যে কয়টা দরকার ঠিক সে কয়টাই আছে। রয়েল ক্যাফে, রোজ গার্ডেন কিংবা গার্ডেন ভিউতে আরাম করে খাওয়া দাওয়া করতে পারবেন, পাবেন পছন্দের সব খাবারই। আর গুঠিয়া মসজিদ দেখতে গিয়ে সেখানকার বিশেষ আকর্ষণ গুঠিয়ার সন্দেশ খেয়ে আসতে মোটেই ভুলবেন না।

প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।

আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।

প্রিয় পাঠক, আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন  [email protected] এই ঠিকানায়।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৪ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।