ঢাকা: সকল সম্ভাবনা তৈরি করেও ফের গতি হারাচ্ছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। ‘অবৈধভাবে, অগ্রহণযোগ্য’ কারণ দেখিয়ে বিমানের বোর্ড ভেঙ্গে দেওয়ায় এমন ঘটনা ঘটছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখলেও তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এমনকি দুটি নতুন উড়োজাহাজ কিনে প্রধানমন্ত্রী নিজেই তার নামকরণ করে উদ্বোধন করার পরেও তা পড়ে রয়েছে মাসাধিককাল ধরে। এতে দিনেই ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ২০ কোটি টাকা করে। আরও উড়োজাহার কেনার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং কোম্পানিকে প্রি-ডেলিভারি পেমেন্ট দিতে বিলম্ব করায় ১ মিলিয়ন ডলার জরিমানা দিতে হচ্ছে।
মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাকে নিয়মবহির্ভূত উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন বোর্ড ভেঙ্গে দেওয়ার কারণে এক ডজনেরও ওপরে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আটকে রয়েছে। এ বিষয়ে এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে বিমান কর্তৃপক্ষ।
দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, বোয়িং কোম্পানিতে প্রস্তুতকৃত উড়োজাহাজ ড্রিমলাইনার বোয়িং ৭৮৭ ও ৭৩৭-এর প্রি ডেলিভারি পেমেন্ট সময় মতো পরিশোধ করা সম্ভব না হওয়ায় ১ মিলিয়ন ডলার জরিমানা গুনতে হচ্ছে বিমানকে।
বিষয়টি চিঠি দিয়ে মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে বিমান কর্তৃপক্ষ। তবে তার কোনও সদুত্তর পাওয়া যায়নি।
বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের ক্ষমতা বাড়াতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পালনের অংশ হিসেবেই ১৭টি মাইক্রোবাস কেনার কথা যা এই স্থবিরতার কারণে সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া ২০১৬ সালের হজ কার্যক্রম পরিচালনায় হজ ফ্লাইট নিয়ে এখুনি সিদ্ধান্ত হওয়া প্রয়োজন, যা সম্ভব না হলে চলতি বছরে হাজিদের দুর্ভোগ হতে পারে। আরও রয়েছে ৬টি নতুন রুট চালু করা, তিনটি দেশে জেনারেল সেলস এজেন্ট (জিএসএ) নিয়োগ, মেয়াদোত্তীর্ণ ৮টি দেশে জিএসএ ও সিএসএ (কার্গো সেলস এজেন্ট) নিয়োগের সিদ্ধান্ত।
যথা সময়ে বিমানের সাধারণ সভা (এজিএম) অনুষ্ঠিত না হওয়ার কারণে মৌখিক নির্দেশেই পরিচালনা পর্ষদের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। যাকে বিমান সংশ্লিষ্টরা স্রেফ নিয়ম বহির্ভূত বলে মত দিয়েছেন। তারা বলছেন, কোম্পানি আইন অবজ্ঞা গত ৩১ ডিসেম্বর থেকে বিমান পরিচালনা পর্ষদের সব কার্যক্রম স্থগিত করে দেয় মন্ত্রণালয়।
বিষয়টিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল জামালউদ্দিন আহমেদ বলেন, এভাবে চলতে থাকলে বিমানে শিগগিরই ফের বিপর্যয় নেমে আসবে। বোর্ড ভেঙ্গে দেওয়ার খবরটি তাকেও জানানো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভেঙ্গে দেওয়া কোনও সমাধান নয়, বিমানের এজিএম হওয়া পর্যন্ত এর মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়াই হতো যথার্থ সমাধান। জামালউদ্দিন বলেন, পাবলিক লিমিডেট কোম্পানির আইন অনুযায়ী বার্ষিক সাধারণ সভার পরেই কোনও বোর্ড ভাঙ্গার নিয়ম। ওই সভার পরেই শেয়ারহোল্ডাররা বোর্ড গঠন করবেন। আর তা না হলে প্রধানমন্ত্রী তার ক্ষমতা বলে বোর্ড গঠন করতে পারবেন।
লাভের মুখ দেখতে চলা বিমানকে কোনও কারণে যারা ক্ষতিগ্রস্ত করতে চায় তারাই এমন উদ্যোগগুলো নিচ্ছে বলে মনে করেন বিমান চেয়ারম্যান।
এদিকে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত মন্ত্রী নিজেই জানেন না, এমন একটি বিষ্ময়কর তথ্যও জানা গেছে। একটি সংবাদপত্রকে মন্ত্রী সরাসরি জানিয়ে দিয়েছেন, বোর্ড এখনো বলবৎ রয়েছে। আর বিমান থেকে পাঠানো কোনও চিঠি তিনি পাননি।
বোর্ড চেয়ারম্যান ইচ্ছা করলেই সভা ডাকতে পারেন বলেও মত দেন মন্ত্রী।
বোর্ড সভা করার উদ্যোগ যে নেওয়া হয়নি তা নয়। একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায় এ বিষয়ে বিমান সচিব খোরশেদ আলম চৌধুরীকে একাধিকবার চিঠি ও ই-মেইল পাঠিয়ে যোগাযোগ করা হলেও তার লিখিত কোনও উত্তর তিনি দেননি। তবে টেলিফোন করে বিমানের কোম্পানি সেক্রেটারি আতিকুর রহমানের কাছে টেলিফোন করে বোর্ডের সব কার্যক্রম স্থগিত করে রাখার নির্দেশ দেন। এদিকে খোরশেদ আলম মিডিয়ার সঙ্গে বলা বলা বন্ধ করে রেখেছেন। তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করতে সাংবাদিকরা ব্যর্থ হচ্ছেন বলেও খবর বেরিয়েছে।
সম্প্রতি দুটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজ বিমান বহরে যুক্ত হয়। গত ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ময়ূরপঙ্খী ও মেঘদূত নামে বিমানের ওই দুটি উড়োজাহাজ উদ্বোধন করেন। সূত্র জানায়, বিমানের একটি বোর্ড সভায় সিদ্ধান্ত হয় এই দুটি উড়োজাহাজ দিয়ে ছয়টি নতুন রুট- দিল্লি, হংকং, গোয়াংজো, কলম্বো, মালে ও ইয়াঙ্গুন চালু করে যাত্রীসেবা বাড়ানো হবে। ওই বোর্ড সভায় এক সপ্তাহের মধ্যে এ বিষয়ে গ্রাউন্ড ওয়ার্ক শেষ করে রিপোর্ট প্রদানের জন্যও বলা হয়। যা বিমানের পরবর্তী বোর্ড সভায় অনুমোদন করা হবে। আর এমনই একটি পরিস্থিতিতে বোর্ড ভেঙ্গে দেওয়ার মৌখিক আদেশ আসে। বিমান সচিবের এই নির্দেশে বোর্ডের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ফলে দুটি উড়োজাহাজ এখন অলস সময় কাটাচ্ছে। যাতে প্রতিদিনই গড়ে ২০ কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে বিমানের।
এদিকে পরিচালনা পর্ষদ না থাকায় বিমানজুড়ে আবারও বাড়ছে দুর্নীতি। দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, বিমান ম্যানেজমেন্ট এখন বোর্ডের আগের সিদ্ধান্তও মানছে না। খোদ বিমান মন্ত্রণালয়ও বোর্ডের নেয়া আগের সিদ্ধান্তগুলোও আমলে নিচ্ছে না। বোর্ডের সর্বশেষ সভায় বিমানের একজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বহিষ্কার, চার্জশিট ও তদন্ত করার সিদ্ধান্ত হলেও তা কার্যকর হয়নি। উল্টো তাকে লোভনীয় পদে বসানো হয়েছে। আর সেখানেও রয়েছে বিমান সচিব খোরশেদ আলমের হাত। ওই কর্মকর্তা বিমান সচিবের ঘনিষ্ঠ বলেই বিমানে চাউড় রয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, বোর্ড ভেঙে দেয়ার পর থেকে সচিব খোরশেদ আলম চৌধুরী প্রতি সপ্তাহে বিমানের প্রধান কার্যালয় বলাকায় যাচ্ছেন। এরই মধ্যে তিনি বিমানের সব নির্বাহী পরিচালকের সঙ্গেও জরুরি বৈঠক করেছেন। সচিবের নির্দেশেই চলছে এখন বিমানের সবকিছু।
আরেকটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায় ৩০ ডিসেম্বর বিমানের এজিএম করার পূর্ণ প্রস্তুতি থাকলেও ওইদিন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে তা বাতিল করা হয়। পৌর নির্বাচন হওয়ার কারণেই এই সিদ্ধান্ত হয়। এ অবস্থায় আইন মেনেই মার্চের কোনও একটি দিনে হতে পারে বিমানের এজিএম। যা হাইকোর্টের আদেশেরও অপেক্ষায় রয়েছে। এমন একটি সহজ বিষয়কে স্রেফ মন্ত্রণালয়ের খামখেয়ালিতে জটিল করে তোলা হচ্ছে বলে মত বিমান সংশ্লিষ্টদের। আর মন্ত্রী দায়িত্ব না নেওয়ায় নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে স্রেফ সচিব খোরশেদ আলমের খামখেয়ালিপনা এর জন্য দায়ী।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৬
এমএমকে