গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) থেকে ফিরে: ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার কলতাপাড়া বাজার। ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কের এ পয়েন্টেই সুন্দর ও ঝকঝকে একটি টিনশেড ঘর।
নিজে বিশ্রামের জন্য বছর বিশেক আগে এ সেবালয় গড়েছিলেন ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) আসনের সরকার দলীয় সংসদ সদস্য ও সাবেক স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব:) মুজিবুর রহমান ফকির। তার ব্যক্তিগত এ কার্যালয় অবশ্য স্থানীয়দের কাছে পরিচিত পেয়েছে ‘টর্চার সেল’ নামে। আর সাইনবোর্ডে লেখা ‘মা ও শাশুড়ি বৃদ্ধাশ্রম। ’
কথিত এ বৃদ্ধাশ্রমের আড়ালে এখানে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলীয় নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষকে ধরে এনে অমানুষিক নির্যাতন চালাতেন এমপি ও তার ক্যাডাররা। এ ঘরের সামনেই ছাউনি বেষ্টিত একটি টেবিল ও জনা দশেক চেয়ার। প্রতিদিন নিয়ম করে এখানে বসতেন এমপি। সার্বিক বিষয়ে নজর রাখতেন। সঙ্গে থাকতেন তার চ্যালা-চামুন্ডারা।
সোমবার (২ মে) হঠাৎ করেই বদলে গেছে সেবালয়ের পরিবেশ। বিকেল থেকে সন্ধ্যা নাগাদ সেখানে অবস্থান করেও কাউকে ভিড়তে দেখা যায়নি। শূন্য পড়ে রয়েছে চেয়ার-টেবিল। যেন মুহূর্তেই নীরব-নিথর হয়ে উঠেছে সাবেক স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর কুকীর্তির সাক্ষী এ টর্চার সেল।
এখানে অবস্থানকালেই মুখ ভার করে এগিয়ে এলেন সাত্তার নামে এক বয়সী ব্যক্তি। প্রায় ২৩ বছর ধরে এমপি ফকিরের সঙ্গে তার গভীর সখ্য। সাবেক প্রতিমন্ত্রীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। নিজের মুখেই বলেন, এখানে এমপি সাহেব প্রতিদিন বসতেন। বিচার-আচার করতেন। কত মানুষকে চড়-থাপ্পড় দিয়েছেন। কিন্তু আমারে রাগ কইরাও কোনদিন কোন কথা কয় নাই। আমি বুঝাইলে গুরুত্ব দিতেন।
নিজের সংসদ সদস্যের দ্বিতীয় মেয়াদের মাঝামাঝি সময়ে আলোচনায় উঠে আসে ‘সেবালয়’। নাম সেবালয় হলেও এর কোথাও সেবা শব্দটি’রও অস্তিত্ব মেলেনি। মূলত এটি স্থানীয় সংসদ সদস্যের নির্যাতন কেন্দ্র। আর এ নির্যাতন কেন্দ্রের কাপ্তান তারই ভাতিজা ফারুক। চাচা’র সুবাদে আঙুল ফুলেছে ফারুকের। রকেট গতিতে ঘুরেছে ভাগ্যের চাকা।
স্থানীয়দের কেউ কেউ আবার এ সেবালয়ের নাম দিয়েছেন ‘ন্যাড়া সেন্টার। ’ দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সাবেক প্রতিমন্ত্রীর ক্যাডাররাই এখানে বিভিন্ন অভিযোগে স্থানীয় ভাঙনামারী ইউনিয়নের যুবলীগ নেতা ছোটনসহ কয়েকজনকে ধারাবাহিকভাবে ধরে এনে মাথা ন্যাড়া করেন। বিরুদ্ধবাদীদের আটকে রেখে নির্যাতন চালান।
স্থানীয় সূত্র জানায়, এমপি’র ভাতিজা ফারুকের চেয়েও কম যান না আরো দু’ভাতিজা দীপু ও শহীদ মাস্টার। তাদের ভয়েও তটস্থ থাকে স্থানীয় এলাকার বাসিন্দারা। এ টর্চার সেলেই নির্যাতনের ভুরি ভুরি ঘটনাও এখন স্থানীয়দের মুখে মুখে।
বছর দুয়েক আগে স্থানীয় ডৌহাখলা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক বিল্লাল হোসেনকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যান এমপি মুজিবুর রহমান ফকির নিজেই। পরে এ টর্চার সেলে নিয়ে তাকে বেদম পেটানো হয়। এমপি’র অপছন্দের ব্যক্তিকে অতিথি করেছেন এমন অযুহাতে পরে তাকেও ছোটনের মতো মাথা ন্যাড়া করতে চাইলে ভয়ে মুর্চ্ছা যান এ শিক্ষক।
এমপির খবর পেয়েও আওয়ামী লীগে যোগ না দেয়ার অপরাধে বিএনপি কর্মী মোকসেদুলকেও সেবালয়ে মাথা ন্যাড়া করে গোটা বাজার ঘুরানো হয়। পরে তাকে আবারো নির্যাতন করা হয়। একইভাবে ডৌহাখলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদকে লোহার রড দিয়ে নির্যাতন করে এমপির ক্যাডাররা পা ভেঙে দেন।
এ টর্চার সেলের শ্রীবৃদ্ধিতে নিয়মিত কাজ করতেন এমপি ফকির। এ কথিত বৃদ্ধাশ্রমের শেষ অংশে নিজের কবরের জায়গা নির্ধারণ করে গেছেন ফকির নিজেই। এ কবরের গেটে পা রাখতেই চোখে পড়ে সাবেক প্রতিমন্ত্রীর বিকৃত মানসিকতার প্রতীক ‘দিগম্বর মোড়’ নামের সেই সাইনবোর্ড। দিন ঘুরলে এ সাইনবোর্ডটি আবারো মোড়ে সাঁটানোরও পরিকল্পনা ছিল এমন দাবিও সূত্রের।
নব্য গডফাদার এ সংসদ সদস্যের আকস্মিক মৃত্যুর পর অনেকটাই নিথর হয়ে পড়েছে এ টর্চার সেলের গোটা শরীর। এখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত ক্যাডাররা সোমবার (২ মে) দিনভর আর সেবালয়মুখী হয়নি। সামনে থাকা চেয়ার-টেবিলগুলোও যেন খাঁ খাঁ করছে। ভ্রু-কুঁচকে কয়েকজনকে দেখা গেলো সেবালয় পাড়ি দিতে। কিন্তু কারো মুখে ‘টু’ শব্দ নেই।
তবে ভেতরে ভেতরে এ টর্চার সেলের ভবিষ্যত নিয়ে নানা কানাঘুষা চলছে। স্থানীয়রা জানায়, টর্চার সেলের রূপকারের মৃত্যুতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন তার সেনাপতিরা। জনরোষে পড়ার দুশ্চিন্তাও পেয়ে বসেছে তাদের।
ভুক্তভোগীরা অতীতের কৃতকর্মের জন্য তাদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠলে হয়তো তাদের জন্য অপেক্ষা করছে কঠিন পরিণতির। খানিকটা অদূরেই এক চায়ের দোকানি নিচু স্বরে বলেন, কত কিছুই অইছে এ সেবালয়ে। একদিনেই সব ঠাণ্ডা হইয়া গেছে। সবাই চাচা আপন প্রাণ বাঁচা....। ’
এমপি ফকিরের হাতে নির্যাতিতরা
‘দিগম্বর হবার পর আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না’
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৭ ঘণ্টা, মে ৩, ২০১৬
এমএএএম/জেডএম