ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

আওয়ামী লীগ

বাংলানিউজকে স্পিকার

নারীরা সারাজীবন অন্যের জন্য কাজ করেন

শাহজাহান মোল্লা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৫ ঘণ্টা, মে ১০, ২০১৬
নারীরা সারাজীবন অন্যের জন্য কাজ করেন

ঢাকা: নারীর অধিকার আদায়ে নারীকেই দায়িত্ব নিতে হবে। অন্য কেউ এসে অধিকার প্রতিষ্ঠা করে  দেবে না।

স্পেসটা (ক্ষেত্র) নিজেকেই তৈরি করে নিতে হবে।
 
নারীরা কর্মক্ষেত্রে নারী হিসেবে নয়, যোগ্যতার ভিত্তিতেই আসে। তাই কারো অনুপ্রেরণা, দয়া দাক্ষিণ্য আমার (নারীদের উদ্দেশ্যে) দরকার নেই। আমাদের ক্ষেত্রটা আমরাই ঠিক করব।

‘আমার পীরগঞ্জের মানুষ কমপ্লিকেটেড না’

নারীদের প্রতি এ তাগিদ জাতীয় সংসদের স্পিকার ও কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর।
 
রোববার (৮ মে) বিশ্ব মা দিবসে জাতীয় সংসদে তার (স্পিকারের) নিজ কার্যালয়ে বাংলানিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় তিনি এ তাগিদ দেন।
 
বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন কতোখানি এগিয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা বেশ এগিয়েছি, এগিয়ে যাচ্ছি। তবে আরও অনেক কাজ করার রয়েছে।
 
নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় আর কি করা দরকার- এমন এক প্রশ্নে স্পিকার বলেন, আমাদের অধিকার আমরাই (নারীরাই) ঠিক করবো। অধিকারের কথা বললেই আসে না, আদায় করে নিতে হবে। কাজেই আমাদের অধিকার আমরাই ঠিক করবো,অন্য কেউ না।
 
তিনি বলেন, আমার দায়িত্ব আমাকে সুচারুরূপে পালন করতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে। স্পেসটা কেউ করে দেবে না। নারীরা যত বেশি দায়িত্ব পালন করবে ততই পরিবর্তন আসবে। আমি আমার নারী কলিগদের বলি, অধিকার নিয়ে ঘ্যান ঘ্যান করে কোন সুযোগ আসবে না। তোমার সুযোগ তোমাকেই করে নিতে হবে,কেউ তোমাকে দেবে না। আমার মনে হয়- এই পরিবর্তনটা যত বেশি আসবে ততোই নারীরা স্বাধীন হবে।
 
প্রধানমন্ত্রী নারী, বিরোধী দলীয় নেতা নারী, স্পিকার নারী, সাবেক বিরোধী দলীয় নেতা নারী। এমন সুবিধাজনক অবস্থানের প্রেক্ষাপটে নারীর ক্ষমতায়নে সমস্যা গুলো কি? এমন প্রশ্নের জবাবে স্পিকার বলেন-দেখুন, শুধু আমাকে বা অন্য  দুই চারজনকে দিয়ে পরিমাপ করলে হবে না।   আমাদের দেশের অনেক নারীই এখনো নির্যাতিত হচ্ছেন। নারী নির্যাতন পৃথিবীর সব জায়গায় ঘটে। নারীরা এখনো অনেক পিছিয়ে। কেউ নীরবে সহ্য করছে, কেউ বেশি ‘ভোকাল’ হলে হয়তো সংসার ভেঙে যাচ্ছে। যেভাবেই হোক নারীরা নির্যাতনের শিকার  কিন্তু হচ্ছে।
 
আর এই নির্যাতিত নারী বা মহিলার সার্পোট দেওয়া খুব সহজ না। যারা প্রথম দিকে পাশে থাকে তারও এক পর্যায়ে সরে যায়। দেখে ওই নারীর সামাজিক মর্যাদা, পারিবারিক সাপোর্ট সবই আস্তে আস্তে সরে যায়। যে কারণে নারী নির্যাতন আইন থাকার পরেও খুব একটা সুফল পায় না নারীরা।
 
স্পিকার বলেন, বর্তমান যুগে নারীরা আরও বেশি দায়িত্ব পালন করছে। এখন নারীরা ডাবল দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছেন। নারীদের ক্ষেত্রে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন হচ্ছে। আমাদের মায়েদের ভূমিকায় মেয়েরা শিক্ষিত হচ্ছে, উচ্চশিক্ষত হচ্ছে। তারা বিভিন্ন পেশায় যাচ্ছে। পেশায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পেশাগত দায়িত্ব বাড়ছে।
 
তিনি বলেন, মেয়েরা অফিস থেকে বাড়িতে ফেরার পর সংসারের দায়িত্ব কোন সময় অবজ্ঞা করতে পারে না। যারা খুব স্বচ্ছল তারা হয়তো ৪/৫টা কাজের লোক রাখছে। কিন্তু যাদের সেই রকম অবস্থা নেই- তারা কিন্তু ভোর বেলা উঠে কাজ করেই অফিসে যাচ্ছেন। আবার বাসায় এসে সবকিছু সামলাতে হচ্ছে।
 
আবার দেখেন, বাড়িতে গেলে বুয়া মনে করে- আপা তো ‘আয়ছেই’, কোলে বাচ্চাটা দিয়েই চলে গেল। অথচ একবারও মনে করলো না- আমি বাইরে কতোটা পরিশ্রম করে এসেছি। আর বাচ্চাটাও তো আপনাকে (মাকে) ছাড়তে চায় না, সেও তো সারাদিন পর মাকে পায়, কাজেই আপনার ক্লান্তিটা তখন বড় বিষয় না। সুতরাং কর্মজীবী নারীরা ডাবল দায়িত্ব পালন করছেন। এটাতে কোন ছাড় নেই। আর এই জায়গায় একজন পুরুষ সারাদিন পর বাড়িতে ফিরলে কেউ একটা শরবতের গ্লাস এনে দেবে, বলবে- আহারে কি পরিশ্রম করে এসেছে । মায়ের কিন্তু সেই স্বস্তি নেই। মেয়েরা এখন আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হচ্ছে,  তারা তাদের মতামত দিতে পারছে। এটা ইতিবাচক পরিবর্তন।
 
ওই মায়েদের (যারা কর্মজীবী নয়) সঙ্গে আমার পার্থক্য, আমরা বাইরের জগতের সঙ্গে মিশতে পারছি, নেগোশিয়েট করতে পারছি- সেই সুযোগ পেয়েছি এবং বুঝতে পেরেছি ‘হাও টাফ ইট ইজ’। সারাক্ষণ সংসারের গন্ডিতে থাকলে বাইরের পরিবেশের সঙ্গে মিশতে পারছে না, বুঝতে পারছেন না পার্থক্য। যে কারণে যে কেউ তাকে ভুল বুঝাতে পারে। ধরুন আমার নানীকে একজন ভুল বুঝিয়ে নিয়ে যেতে পারবে, কিন্তু আমাকে তো পারবে না। আমি তো বাইরে নেগোশিয়েট করা শিখেছি। আমাকে কেউ এক্সপোজ করতে পারবে না। এটা একটা বড় পরিবর্তন। নারীদের লেখাপড়ায় অংশগ্রহণ বাড়ছে, এটা ইতিবাচক দিক। লেখাপড়ায় যতো বেশি আসবে, তত বেশি জড়তা কাটবে।
 
স্পিকার বলেন, আমাদের মায়েরা এতো পরিশ্রম করেন। কিন্তু করেন নীরবে, একেবারে নিভৃতে। আজ (রোববার ৮ মে) আজাদ প্রোডাক্টস এর রত্নগর্ভা মা পুরস্কার দিচ্ছিলাম। মায়েরা আমার কাছ থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন, কিন্তু তাদের আচরণে মনে হচ্ছিল না-এটা উনাদের জন্য পুরস্কার, এটা যে উনার প্রাপ্য, সেটা কাউকে দেখেই মনে হচ্ছিল না। আমাকে অনেককেই ডাকতে হয়েছে, আবার অনেকে অন্যের হাত ধরে এসেছেন। এ থেকেই বোঝা যায়, তিনি সারাজীবন অন্যের জন্য করেছেন। এটা মায়েদের সবচেয়ে বড় গুণ। তার‍া নিজের জন্য করেন না, সবসময় অন্যর জন্য করেন।
 
আবার দেখেন, নারীরা শরীরে দীর্ঘদিন একটা অসুখ  বহন করছে। অথচ কেউ কারো কাছে শেয়ার করছে না। নারীদের মধ্যে এগুলোর জড়তা আছে। নারীদের বাস্তবতায়- এখনো সবাইকে খাইয়ে তারপর সে খায়। সবার খাওয়ার পর অনেকের কিছু থাকেও না খাওয়ার,  আপনি কিন্তু জানছেনও না সে (মা) শুধু পানি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে। এটা কেউ জানার চেষ্টাও করে না।
 
তিনি বলেন, মানুষ ঠেকে শেখে। ধরুন, আপনার বাড়িতে কারো অসুখ হল গভীর রাতে ওষুধ দরকার। প্রথমে ডাক আসবে পুরুষের, আর যদি পুরুষ না থাকে তাহলে বাড়ির সিনিয়র কেউ করবে, হয় মা, না হয় দাদি, নানী। বাড়িতে পুরুষ না থাকলে নারীকেই দায়িত্ব নিতে হয়। তবে দায়িত্বের জায়গায় নারীদের কোন খাদ নাই।
 
নারী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে কোন বাধার সন্মুখীন হয়েছেন কি না জানতে চাইলে শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন,  নারী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে- আমি কিছু করতে গেছি হয়নি, এমন হয়নি। তবে হ্যাঁ অনেক পদক্ষেপ নিতে গেলে অনেক বাধা আসছে। তাছাড়া কাজের ক্ষেত্রে কে নারী কে পুরুষ এই বিচারে হয় না। আমরা আমাদের যোগ্যতার বলেই আছি। কাজেই ওই দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখলে চলবে না।
 
নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে সরকার এত বেশি সোচ্চার, তারপরেও সরাসরি ভোটে নারীর অংশগ্রহণ কম কেন?
 
স্পিকার বলেন, আমাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্যে অনেকগুলো সংস্কার দরকার। যদি আরো সহজীকরণ না করা হয়, রিফর্ম না করা হয় তাহলে ডাইরেক্ট প্রসেসে একজন মহিলার আসা খুবই কঠিন। প্রথমত অর্থ সংকুলান- এটা খুবই কঠিন। যে পরিমাণ অর্থ লাগে নির্বাচন করতে সেটা তো খুবই কঠিন ব্যাপার।
 
তাছাড়া নমিনেশন (মনোনয়ন)  তো মহিলাদের সেভাবে দেওয়া হয় না, কারণ পার্টি তো সিট চায়, জয়ের নিশ্চয়তা না থাকলে দেবে কেনো। কাজেই অনেক জায়গা আছে- সেগুলোতে অনেক কাজ করতে হবে। তারপরেও নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
 
স্পিকার ড. শিরীন  শারমিন চৌধুরীর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ১৯৬৬ সালের ৬ অক্টোবর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম রফিকুল্লাহ চৌধুরী ও মায়ের নাম নাইয়ার সুলতানা। পৈত্রিক নিবাস নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলার পাঁচগাও গ্রামে। বাবা ছিলেন সিএসপি অফিসার ও বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব। মা ছিলেন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ এবং বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য। তার স্বামী সৈয়দ ইশতিয়াক হোসেন ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন। তাদের সংসারে এক পুত্র ও এক কন্যা রয়েছে।

ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে ৪৬ বছর বয়সে সর্বকনিষ্ঠ ও বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম নারী স্পিকারের দায়িত্ব নেন। এরপর দশম সংসদের শুরু থেকে এখন অবধি স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। স্পিকার হওয়ার আগে নবম জাতীয় সংসদে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন তিনি। সর্বশেষ কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারপার্সন হন শিরীন শারমিন চৌধুরী। দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ফোরামেও তিনি সমান দক্ষতা দেখিয়ে চলছেন।  
 
বাংলাদেশ সময়: ১৩০৮ ঘণ্টা,  মে ১০, ২০১৬
এসএম/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।