তৎকালীন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেরণায় ও পৃষ্ঠপোষকতায় একঝাঁক সূর্যবিজয়ী স্বাধীনতাপ্রেমী তারুণ্যের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় এশিয়া মহাদেশের ‘বৃহত্তম’ ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৭২ বছরের ইতিহাস জাতির মুক্তির স্বপ্ন, সাধনা এবং সংগ্রামকে বাস্তবে রূপদানের ইতিহাস।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার পর সর্বপ্রথম মাতৃভাষা বাংলার জন্য সংগ্রাম করেছিল। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গৌরবোজ্জল ভূমিকা ছিল। বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছিল অনেককে। তারপর আমরা আমাদের ভাষা হিসেবে বাংলাকে পেয়েছি।
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী ছিলেন, যাতে ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুর ভ্যানগার্ড ছিল। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের অগ্রণী ভূমিকা ছিল। তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দুর্বার ছাত্র আন্দোলন গড়ে, তোলে যা বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে কেউ মুছে ফেলতে পারবে না।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ৬ দফা দাবি দিয়েছিলেন, যা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন বেগমান হয়। তৎকালীন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সাহসী আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল।
১৯৬৯ সালে ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১৯৬৯ সালে বাংলার ছাত্রসমাজ সারাদেশে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তোলে, যা গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ বাংলার ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেন, যা ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের গতিকে ত্বরান্বিত করে।
১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে তৎকালীন ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। তখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভ্যানগার্ড হিসেবে ছাত্রলীগ কাজ করত। সারা বাংলাদেশে পাকিস্তানের অপশাসনের বিরুদ্ধে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তুলে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্বাচিত করতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ছাত্রলীগ সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে, যার মধ্য দিয়ে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের গতি ত্বরান্বিত হয়।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী শহীদ হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে সারা বাংলাদেশে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। নূরে আলম সিদ্দিকী, তোফায়েল আহমেদ-সহ তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতারা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। ছাত্রলীগের নেতৃত্বে প্রতিটি জেলায়, উপজেলায়, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। তৎকালীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিল।
জাতিকে স্বাধীনতা যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ ও যুক্ত করার ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। ৩০ লাখ শহীদদের রক্তের মধ্য দিয়ে লাল-সবুজের পতাকা আমরা পেয়েছি, যাতে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ একটি দেশ হিসেবে স্থান পেয়েছে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর বাংলাদেশ অনেক দূর পিছিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন থেমে থাকেনি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষে ছাত্রলীগ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ভূমিকা প্রশংসনীয়। গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে যুদ্ধাপরাধ মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ রাজপথে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে।
অতীতে বাংলাদেশে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকগণের নেতৃত্বে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় এবং শাখা কমিটি যেভাবে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন একইভাবে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। যার ধারাবাহিকতায় স্বৈরাচার সরকারের পতন হয় এবং গণতান্ত্রিক সরকারের উত্থান হয়। যাতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ১/১১’র সময় শেখ হাসিনাসহ ছাত্র-শিক্ষক সবার মুক্তির দাবিতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। যার ধারবাহিকতায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সব রাজবন্দি মুক্তি পেয়ে ২০০৮ সালে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকারের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশকে একটি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ উন্নত রাষ্ট্রে রূপান্তরের লক্ষে কার্যক্রম শুরু হয়। যাতে প্রধান অন্তরায় ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার সময় ছাত্রলীগ রাজপথ পাহারা দিয়েছিল, যাতে কোনো ধরনের সহিংসতা না ঘটে। ছাত্রলীগের শত শত ছেলের আত্মত্যাগের বিনিময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয় এবং অনেকের বিচারের রায় বাস্তবায়ন হয়। অনেকের মামলা এখনো চলমান। আশা করি সব যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ শতভাগ কলঙ্কমুক্ত হবে।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ ও উন্নত রাষ্ট্রে রূপান্তরের লক্ষে ছাত্রলীগের সব নেতাকর্মী রাজপথে সাহসী ভূমিকা রেখেছে। ছাত্রলীগের ইতিহাসে যেমনই হাজার হাজার যোগ্য নেতার জন্ম হয়েছে তেমনই কিছু সংখ্যক অযোগ্য নেতার জন্ম হয়েছে। যার কারণে মাঝে-মধ্যে বিতর্কিত হতে হয় বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সংঠনটিকে। তবে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সময়োপযোগী নেতৃত্বে সব পর্যায়ের নেতাকর্মীরা অবিচল। ছাত্রলীগ সব ভুল সংশোধন করে আগামীদিনে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে রাজপথে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ও দিকনির্দেশনায় কাজ করে গেলে বাংলাদেশের সুনাম অক্ষুন্ন থাকবে। ছাত্রলীগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এটুকু প্রত্যাশা।
লেখক: খোন্দকার তারেক রায়হান
সাবেক সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ
সাবেক সদস্য, কেন্দ্রীয় দপ্তর উপ কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
বাংলাদেশ সময়: ০০১৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৪, ২০২০
এসএইচ