বাহরাইন ঘুরে: প্রদীপের আগুনে পুড়ছে সুগন্ধি তেল। ঘরময় তারই সুবাস।
কিন্তু পারস্য উপসাগরের ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র বাহরাইনের রাজধানী মানামায় এই সংস্কৃতি যিনি চর্চা করছেন তিনিও আর এক দ্বীপেরই মানুষ বটে! তবে তার দ্বীপটা ভারত মহাসাগরে, এখান থেকে তিন হাজার সাতশ’ কিলোমিটার দূরে।
কিন্তু পারস্য উপসাগরের এই দ্বীপে এসে কি পরম মমতায় উপসাগরীয় মরু সংস্কৃতি ধারণ করেছেন বাংলাদেশ স্কুল বাহরাইনের শ্রীলংকান প্রিন্সিপাল!
অনেকটা কৌতূহলী হতে দেখেই যেনো ভরাট অথচ শান্ত গলায় বললেন, পারফিউম ইজ গুড় ফর হেলথ। এতে অতিথির স্বস্তিবোধ হয়। আর আরব সংস্কৃতিতে মিষ্টি কিছু রাখার চল আছে।
বাংলাদেশের স্কুলে শ্রীলংকান শিক্ষক কেনো বলে মনের মধ্যে যে স্বাভাবিক প্রশ্নটা এতোক্ষণ ঘুরপাক খাচ্ছিলো তাও কেটে গেলো নিমিষে। বাহরাইন প্রবাসী কর্মজীবী বাংলাদেশিদের সন্তানদের শিক্ষার দেখভালে তো তাকেই মানায়। এই মরুদ্বীপে তিনিও তো বাংলার বাতিঘরের উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা।
শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষা নেওয়া আমানুল্লা এম সালিহ তার নিজের দেশ শ্রীলংকায় শিক্ষকতা করেছেন সাড়ে ৯ বছর। তারপর সাড়ে ছয় বছর মালদ্বীপে উড়িয়েছেন শিক্ষকতার ঝাণ্ডা। বাহরাইনে এসে ইউনিভার্সিটির প্রশাসনিক পদে ৪ বছর খণ্ডকালীন কাজের পর এখন তিনি দেড় লাখ বাংলাভাষীর স্কুলের প্রিন্সিপাল।
তার ছোট্ট কক্ষটার একপাশের দেওয়ালে একটা ডিজিটাল বোর্ড। তাতে লাল নিয়নে দুপুর একটা ৩৯ মিনিট শো করছে। তাপমাত্রা দেখাচ্ছে ২২ ডিগ্রি। দিন, মাস আর সাল ছাড়াও এদিন যে মঙ্গলবার তাও বেশ লেখা আছে তাতে।
কথায় কথায় জানা যায়, জুতা জেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ সবই করতে হয় প্রিন্সিপাল আমানুল্লাহকে। তার স্কুলের নয়শ’ ছাত্রের অভিভাবক যেমন তিনি, তেমনি তিনি স্কুলের অর্থেরও তত্ত্বাবধায়ক। কোনো ভাইস প্রিন্সিপাল না থাকাও দায়িত্বটা একটু বেশিই।
সব মিলিয়ে সমস্যার অন্ত নেই তার স্কুলে। একে তো ভাড়া ভবন। মাসে ভাড়া গুণতে হয় তিন হাজার ডিনার (এক ডিনারে ২০৬ টাকা)। জায়গাও পর্যাপ্ত নয়।
তাই জায়গার অভাবে লাইব্রেরিটাও গড়া যায়নি। শিক্ষকদের জন্য রেফারেন্স লাইব্রেরিটা কেবল আছে। কিন্তু ক্লাসরুমগুলো ছোটো ছোটো। খেলাধুলার সুযোগ সুবিধাও কম। সাংস্কৃতিক আয়োজনও নেই বললেই চলে।
নিজের কাজের চ্যালেঞ্জ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশিদের ইংরেজিতে দক্ষতা কম। তাই সংগ্রামটা বড়। তাছাড়া ভিসা জটিলতায় স্পেশাল বিষয়ে পুরুষ শিক্ষক আনা যাচ্ছে না। উপরন্তু অনেক অভিভাবকই সিনসিয়ার নন। অভিভাবক সমস্যায় প্রতি বছর ২৫/৩০জন ছাত্র চলেও যাচ্ছে স্কুল থেকে। কেউ কেউ হয়তো দেশেই ফিরে যাচ্ছে অভিভাবকের হাত ধরে।
শিক্ষার্থীদের ইংরেজি দক্ষতার বাড়ানোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে জানান প্রিন্সিপ্যাল। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ন্যাশনাল কারিকুলাম অনুয়ায়ীই চলে বাহরাইনের বাংলাদেশ স্কুল। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পড়ানো হয় ব্রিটিশ কারিকুলামেও।
জি১২ পর্যন্ত নয়শ’ ৩০ ছাত্রকে পড়ানোর জন্য আছেন ৫৪ জন শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের ব্যাগ, ডায়েরি আর বই স্কুলই সরবরাহ করে।
স্কুলের ক্লাসরুমগুলো বেশ পরিপাটি। শিশুদের আঁকা মাছ-গাছের চিত্রগুলো দেওয়ালে ডিসপ্লে করা। সব মিলিয়ে শিশুদের ক্লাস রুমে শিশুদের নানা তৎপরতার ছাপ বেশ স্পষ্টই।
ক্লাসরুমের বাইরেটাও বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। এখানে ওখানে মেঝেতে পেতে ও দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা মাটির টবে বাহারি সব ফুলের সমারোহ। ক্লাসরুম লাগোয়া উন্মুক্ত উঠোনেও সবুজ সিনথেটিক কার্পেট।
একপাশে শিশুদের পানের জন্য পানি শোধনের মেশিন। বারান্দার একাংশ জুড়ে কয়েশ’ প্লাস্টিকের চেয়ার খামাল দিয়ে রাখা। কোনো অনুষ্ঠান-আয়োজনে কদর বাড়ে ওগুলোর।
আন্তরিক যত্নে পুরো স্কুল ক্যাম্পাস ঘুরে দেখালেন প্রিন্সিপাল। তারপর বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন নিজের কাজ গোছাতে।
স্কুলের একমাত্র স্টুডেন্টস কাউন্সেলর ফরিদা ইয়াসমিনকে পাওয়া গেলো পেছন দিকটায়। নিজের দুই সন্তানকে নিয়ে খেলছেন। স্কুল ছুটি থাকায় অস্থায়ী সেডের নিচে বাঁধানো চত্বরটা খা খা করছে।
ফরিদা জানালেন, আরো দু’তিন জন কাউন্সেলর নিয়োগ দেওয়া হবে শিগগিরই। ঘুরে আসার পথে চোখে পড়লো, প্রিন্সিপালের অফিস ভবনে প্রবেশ পথের দু’পাশে মাটির টবে মরুঘাসের ঝোপ। যেনে মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করছে। ঢোকার সময় নজরে আসেনি।
পাতা বাহারের টবও আছে ক’টা। আর অস্থায়ী স্কুল ভবন ঘিরে বেশ ক’টি বরই গাছের লাজুক উপস্থিতি পুরো পরিবেশটাকেই অন্যরকম এক আবহে বেঁধেছে।
অচেনা ক’টি গাছের সামনে দাঁড়িয়ে নাম কি হতে পারে ভেবে ভেবে যখন হাল ছাড়ার দশা, তখন ফের আবির্ভূত হলেন প্রিন্সিপাল আমানুল্লাহ। আজকের মতো তার কাজের পর্ব সাঙ্গ।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য বাংলাদেশ দূতাবাসে পৌছে দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন প্রিন্সিপাল আমানুল্লা। জায়গাটা তার বাসার পথেই পড়বে। এমন সুযোগ আর সম্মান হাতছাড়া করে কোন পাগলে!
গাড়ি রাস্তায় গড়াতেই বাহরাইন কেমন লাগছে জানতে চাইলেন বাংলাদেশ স্কুলের প্রিন্সিপাল।
উত্তরে বাহরাইনকে সুন্দর দেশ বলে দিলাম নির্দ্বিধায়। ঠোঠের কোনে কৌতূকের হাসি ফুটলো প্রিন্সিপালের। অমায়িক হেসে বললেন, কারণ, তুমি এখানে ডিসেম্বরে এসেছো।
এমন মন্তব্যে রসিকতাময় এক পরিবেশ তৈরি হলো গাড়ির ভেতরে। বাস্তবিকই তাই। এখন এখানকার তাপমাত্রা ২২ ডিগ্রি। আকাশে সূর্যটা ঢুলুঢুলু। চারিদিকে সাগর হওয়ায় দিনের বাতাসটা বেশ উপভোগ্যই। সূর্যের তেজকে শরীরে বসতেই দিচ্ছে না মাতাল হওয়া।
কিন্তু গরমের মৌসুমে এখানে তাপমাত্রা প্রায় ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছে চলে যায়। স্বরূপে আবির্ভূত হয়ে আগুন ঝরাতে থাকে সূর্য। যেনো ফুটতে শুরু করে মরুভূমির বেলেমাটি। বাতাসে ভাসতে থাকে আগুনের হলকা।
সেই গরমে কোমলমতি শিশুদের অনেকের নাকমুখে রক্ত চলে আসে। দেখা দেয় আরো সব গরমজনিত উপসর্গ। প্রকৃতির আশীর্বাদ তখন ঢাকা পড়ে মরুহাওয়ার অভিশপ্ত দাপটে।
বৈরি আবহাওয়া থেকে বাঁচতে তাই তখন বন্ধ থাকে বাংলাদেশ স্কুল। এখানকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুই মাস ছুটি থাকে গরমের মৌসুমে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬২৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৫