বাহরাইন ঘুরে: অবৈধদের এখন আর কেউ কাজে নিতে চাইছে না বাহরাইনে। কোনো কারখানায় অবৈধ কাউকে পাওয়া গেলে নিয়োগকর্তাকেই মোটা অঙ্কের জরিমানার বিধানই এই কর্মসঙ্কটের প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
আর যেহেতু অবৈধ অভিবাসীদের সিংহভাগই বাংলাদেশি তাই কপাল পুড়ছে মূলত তাদেরই।

জনশক্তি রপ্তানি ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) হিসেবে, বাহরাইনে বৈধভাবে বসবাসকারী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় তিন লক্ষ। তবে এ হিসাব কেবল যারা বাহরাইনে গেছে তাদের। যারা ফিরে আসছে তাদের হিসাব ব্যুরোর কাছে নেই।
আর বাহরাইনের জনশক্তি বিষয়ক সংস্থা লেবার মার্কেট রেগুলেটরি অথরিটির (এলএমআরএ) হিসাবে, বাহরাইনে বর্তমানে এক লাখ বাংলাদেশি কর্মরত রয়েছেন।
এর মধ্যে ৩৬ হাজার ৫৭২ জন অবৈধ বলে জানা গেছে বাহরাইনেরই এক সাম্প্রতিক জরিপে। তবে অনুমান নির্ভর ওই জরিপের চেয়ে অনেক বেশি অবৈধ বাংলাদেশি বাহরাইনে অবস্থান করছেন বলে মনে করেন বাংলাদেশ দূতাবাস কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশি কমিউনিটি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কার্যত দালালের খপ্পরে পড়ে, ফ্রি ভিসায় এসে অধিক সময় থেকে, ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও নবায়ন না করে বাংলাদেশের শ্রমিকরা অবৈধ হয়ে পড়ছেন।
এর আগে মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে অবৈধভাবে বসবাসকারী বিদেশি নাগরিকদের দেশটি থেকে বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাহরাইন মন্ত্রিসভা। বিভিন্ন কোম্পানিকে অবৈধভাবে বসবাসকারী কোনো নাগরিককে চাকরি না দেওয়ার জন্যও সতর্ক করে দেয় দেশটির সরকার।
ফলশ্রুতিতে অবৈধ বাংলাদেশিরা অনেকটা ফেরারি আসামিরই জীবনযাপন করছেন বাহরাইনে। একদিকে তারা যেমন জীবিকার অনিশ্চয়তায় ভুগছেন, তেমনি সদা তটস্থ থাকছেন ধরাপড়ার ভয়ে।
আর কর্মক্ষেত্রে শারীরিকভাবে তারা নির্যাতনের শিকার তো হচ্ছেনই, সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলোও করানো হচ্ছে তাদের দিয়েই।
তাই দুর্ঘটনায় মৃত্যু বেশি বাংলাদেশি শ্রমিকের। উপরন্তু এই অবৈধরাই জড়িয়ে পড়ছেন অপরাধ, অসামাজিক কার্যকলাপ, বেআইনি কর্মকাণ্ড ও কুসংস্কৃতিতে। আর এসবে যে দেশের ভাবমূর্তি চরম সংকটে পড়ছে তা বলাই বাহুল্য।


সরেজমিন অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যমতে, অনেক নিয়োগ কর্তা বা দালাল শ্রমিকদের ভিসা নিয়ে আটকে রাখছে যা বাহরাইনে বেআইনি। কর্মী আনার দু’তিন মাসের মধ্যে অনেক কমার্শিয়াল রেজিস্ট্রেশন (সিআর) অকার্যকর করে দেওয়া হচ্ছে। বহু দালাল কাগজপত্রসহ বাহরাইন ত্যাগ করছেন। ফলে শ্রমিকদের কাছে কোন কাগজপত্রই থাকছে না।
পাসপোর্ট আটকে রেখে টাকা আদায় করা হচ্ছে অনেক কোম্পানিতেই। কর্মীদের পলাতক দেখানো হয়ে উঠেছে নিত্যকার ঘটনা। লাভজনক না হলে অন্যত্র কাজ করতে পাঠানো হচ্ছে বাংলাদেশি শ্রমিকদের। বৈধতার লোভ দেখিয়ে বিনা পয়সায় খাটানো হচ্ছে দিনের পর দিন। অবৈধ হওয়ায় আইনের আশ্রয়ও নিতে পারছেন না বাংলাদেশি শ্রমিকরা।


অবৈধ হয়ে পড়ার পেছনে অনেক কারণ আছে জানিয়ে বাংলাদেশ স্কুল অ্যান্ড কলেজ বাহরাইন এর চেয়ারম্যান কেফায়েত উল্যাহ মোল্লা বাংলানিউজকে বলেন, ভিসার মেয়াদ শেষে তা নবায়নের খরচ অনেকেই করতে চান না। তাই মেয়াদ শেষে তারা অবৈধ হয়ে পড়েন। আর চুক্তির মেয়াদ শেষেও অনেকে দেশে গিয়ে কি করবেন বুঝতে না পেরে অবৈধ হলেও এখানে রয়ে যান।
লিন্নাস গ্রুপের চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন বাংলানিউজকে বলেন, দু’পক্ষকেই জরিমানা করা হয় বলে যারা অবৈধ তারা কাজ পান না। আর যারা কাজ পান না তাদের জীবন কাটাতে হয় অবর্ণনীয় দুর্ভোগে। অবৈধদের জন্য আইনের দরজাও বন্ধ এখানে। তাই অবৈধদের অধিকাংশই মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

বাহরাইন বিএনপি সভাপতি জাহাঙ্গীর তরফদার বলেন, অবৈধরা সহজে কাজ পান না। চুরিধারি করে কাজ করতে হয় তাদের। যেহেতু এখানে কর্মীদের বৈধতা যাচাইয়ের অডিট নিয়মতিই হয় তাই অবৈধরা কাজ পেলেও থাকতে হয় টেনশনে।
এ প্রসঙ্গে বাহরাইনে বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সেলর মহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, আগে অনেকেই লুকিয়ে কাজ করতেন। কিন্তু এখন আর কেউ অবৈধদের কাজে নিতে চায় না। কারণ অপরাধ না করলে প্রতি বছরের জন্য ১৫ দিনার দিয়ে একজন অবৈধ অভিবাসী বৈধ হতে পারেন। কিন্তু অবৈধ কেউ ধরা পড়লে যে প্রতিষ্ঠানে ধরা পড়বেন সেই কোম্পানিকে এক হাজার ডিনার (প্রায় দু’লক্ষ টাকা) জরিমানা করা হবে।
শ্রম কাউন্সেলর বলেন, আর যদি কেউ অপরাধ করে থাকেন বা স্পন্সর বলে যে- তিনি পলাতক ছিলেন তাহলে শাস্তি অনিবার্য। আর শাস্তি শেষে নিজের খরচেই ফিরতে হবে দেশে।

এক্ষেত্রে একটি সেলুনের উদাহরণ দিয়ে মহিদুল ইসলাম বলেন, ধরা যাক, কোনো সেলুনে ৪টি চেয়ার আছে। সেখানে চার জন শ্রমিকের কাজ করার সুযোগ আছে। কিন্তু সেলুনের যে ক্রেতাতালিকা তাতে দু’জনের বেশি কর্মী লাগে না। এক্ষেত্রে ওই সেলুন কিছু বাড়তি টাকা নিয়ে অতিরিক্ত দু’জন কর্মী আনবে, যারা ওই সেলুনের ঠিকানায় ভিসা নিয়ে এলেও কাজ করবেন অন্য জায়গায়। এমন শর্তেই তাদের আনা হয়। স্বভাবতই এরা অবৈধ হয়ে পড়েন।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৫