ঢাকা: শুরুটা ৯২’তে। তারপর আর থামেননি।
শফি উদ্দিনকে তার দেশ কমার্শিয়াল ইমপর্টেন্ট পারসন (সিআইপি) খেতাব দিয়েছে। প্রবাসে থেকে দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় তাকে সিআইপি কার্ড দিয়েছে। এ স্বীকৃতিই ধরে রাখতে চান তিনি। নিজ দেশ তাকে যে সম্মান দিয়েছে সেই দেশকে বিদেশের মাটিতেও অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে চান।
মঙ্গলবার সিআইপি কার্ড পাওয়ার দিন রাতেই এসেছিলেন বাংলানিউজে। এ স্বীকৃতির কথা উঠতেই প্রথমেই বললেন, ‘আমি একা এগিয়ে চলতে চাই না। এতে আত্মতৃপ্তি নেই। বাহরাইনে বাংলাদেশিদের নিয়ে সাধ্য অনুযায়ী এগিয়ে যেতে চাই। ’
শফি উদ্দিন প্রচার বিমুখ। বাংলানিউজের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিলো তখন হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমি আসলে হাইলাইটেড হতে চাই না। কাজ করে যেতে চাই। প্রবাসে কোনো বাঙালির মুখে হাসি ফুটলেই আত্মতৃপ্ত হই। এই আমার শান্তি…’
বাহরাইনে অনেক বাঙালির কাছেই তিনি প্রিয়ভাজন। বাঙালিদের প্রতি তার দরদ আর আন্তরিকতার জন্য সেখানকার কমিউনিটিতে তিনি প্রশংসিত। নামের সঙ্গেই যেনো ‘উপকারী মানুষ’ বিশেষণটা লেগে আছে।
বাংলানিউজের প্রধান কার্যালয়ে যখন কথা শুরু হয় তখন তার ফ্লাইটের আর সাড়ে ৩ ঘণ্টা বাঁকি। সময়ের সঙ্গে চলা শফি উদ্দিন এক ঘণ্টা সময় বরাদ্দ রেখেছেন আলাপচারিতার জন্য। কনফারেন্স রুমে আলাপচারিতায় নিজের শুরুর কথা উঠতেই বললেন, ‘আমার শুরুটা ৯২’তে। ওই বছরের ২৩ জুন আমি বাহরাইনে আসি। ৬ মাস ভাষাসহ কিছু বিষয়ের প্রশিক্ষণ নিই। ওইদেশের পরিপার্শ্বিক অবস্থা বুঝি, শিখি। পরের বছর কাজ শুরু করি। ’
আলাপচারিতা চলে শফি উদ্দিনের সঙ্গে। চলে কথার পিঠে কথা। মিটিং রুমে উপস্থিত বাংলানিউজের কনসালট্যান্ট এডিটর জুয়েল মাজহার, হেড অব নিউজ মাহমুদ মেনন, আউটপুট এডিটর জাকারিয়া মণ্ডল, চিফ অব করেসপন্ডেন্টস সেরাজুল ইসলাম সিরাজ কৌতুহল নিয়ে শোনেন তার কথা।
শফি উদ্দিন বলেন, ‘বাংলাদেশে থাকাকালীন স্কুলে ৯ম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমার বিদেশের পোকা মাথায় ভর করে। এরপর উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে (৯২ সাল) থাকাকালীন প্রথম বাহরাইনে যাই। ’
কথা চলতে থাকে শফির। বলেন, ‘আমার মনে হয়েছে বিদেশে গিয়ে কিছু করবো নিজের জন্য, দেশের জন্য, দেশ বলতে তো দেশের মানুষই...তো আমি বিদেশ গিয়ে পরের বছর ’৯৩ সালে যখন আল ধাবি নামক একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করি তখন প্রতিষ্ঠানটির মালিক আমার কাজ ও সততায় মুগ্ধ হন। আমি যে বছর প্রথম আল ধাবিতে কাজ শুরু করি তখন ওটা নতুন প্রতিষ্ঠান। আমি নতুন এ প্রতিষ্ঠানে চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করি। আমার মালিক কাজে খুশি হন। ’৯৯ সালে হঠাৎ আমাকে সারপ্রাইজ দিয়ে বসেন আমার মালিক আল ধাবি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার খালিফা মুহাম্মাদ মুহাম্মদ আলী আল নায়েমি। ওই সারপ্রাইজ আমার বাহরাইনের জীবনকে বদলে দিয়েছে। ওই সারপ্রাইজ থেকেই আমার কয়েক বছরের পরিশ্রম স্বার্থক হয়। ’
কি সেই সারপ্রাইজ তা বলার আগে বলেন, ‘আসলে আমি কাজে সৎ থেকেছি। পরিশ্রম করেছি। চ্যালেঞ্জ নিয়েছি। এগুলোর কারণেই মালিক আমার কাজে খুশি হয়ে সারপ্রাইজটি দিয়েছেন। ’
এবার শফি সেই সারপ্রাইজের কথা বলেন, ‘আমিতো আল ধাবির এমপ্লয়ি ছিলাম। একদিন হঠাৎ মালিক আমাকে এমপ্লয়ি থেকে মালিকানার সারপ্রাইজ দিয়ে বসলেন। এরপর তো আমি ওই প্রতিষ্ঠানের সাধারণ একজন কর্মকর্তা বা কর্মচারি নই। অংশিদারিত্ব পেয়ে আমিও প্রতিষ্ঠানটির গর্বিত মালিক হই। প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশিদের কাজের সুযোগ দিই। ’
তিনি বলেন, ‘আমি বেতনভুক্ত হিসেবে কাজ করলেও প্রতিষ্ঠানকে নিজের মনে করে কাজ করেছি। কাজকে ভালোবেসেছি। ’
’৯৩ থেকে ’৯৯ সাল পর্যন্ত চাকরি করার পর এমন সারপ্রাইজে তার আর পেছনে তাকাতে হয়নি। বলেন, ‘এরপর আমি খালিফা মুহাম্মাদ মুহাম্মদ আলী আল নায়েমির সঙ্গেই ন্যাশনাল ফিশ কোম্পানি ডব্লিউএলএল নামক বড় একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করি। যেটি এখন বাহরাইনে পারস্য উপসাগরের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মাছ কিনে নেয়। জাপান, কোরিয়া আর ইউএসএতেই মূলত এই পারস্য উপসাগরের মাছ রপ্তানি করা হয়। ’
তিনি জানান, পারস্য উপসাগরের পশ্চিম-দক্ষিণ এলাকায় দ্বীপরাষ্ট্র বাহরাইন ঘিরে যেসব জেলে প্রতিদিন মাছ ধরেন তাদের অধিকাংশই বাংলাদেশি। বিশেষ করে সন্দ্বীপ, সিলেট, হাতিয়া, চট্টগ্রাম আর চাঁদপুরের।
শফির পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ পাওয়া প্রায় দুই শ’ বাঙালি কাজ করলেও পরোক্ষভাবে তার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কয়েক হাজার বাঙালি জড়িত। কেবল পারস্য উপসাগরেই প্রতিদিন জাল ফেলছেন পাঁচ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি। যারা শফি উদ্দিনের সঙ্গে লেনদেন করে খুশি থাকেন।
আল ধাবী, ন্যাশনাল ফিশ, প্যাসিফিক এলুমুনিয়ামসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রধান মালিক এখন চট্টগ্রামের শফি।
সফলতার কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘আমি পারবো না বা আমাকে দিয়ে হবে না—এসব শব্দ আমার কাছে নেই। আমি পারবো আমাকে দিয়ে হবে—এগুলোই সফলতার মূলমন্ত্র। ’ আরও যোগ করেন, ‘কোনো কাজ ধরলে আমাকে তা শেষ করতে হয়। অসম্পূর্ণ কাজ রেখে থাকতে পারি না। ’
’৭৪ সালে জন্ম নেওয়া চট্টগ্রামের বাসিন্দা শফি উদ্দিন শুধু যে বিদেশ নিয়েই ভাবছেন তা নয়। দেশেও কিছু করতে চান তিনি।
তবে সরকারের কাছে শফি উদ্দিনের প্রত্যাশা, ‘বিদেশ থেকে দেশে যারা বিনিয়োগ করতে চান তাদের যেনো সকল সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত থাকে। কোনো হয়রানির স্বীকার যেনো না হন। ’
শফি উদ্দিন দৃঢভাবে বলেন, ‘ফরেন ইনভেস্টমেন্ট দেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। সেজন্য বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেনো কোনো জটিলতা না থাকে সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। ’
দুই ছেলে ও এক মেয়ে সন্তানের জনক চট্টগ্রামে জন্ম নেয়া এ বাহরাইন প্রবাসী ব্যবসায়ী পরিবারসহ বিদেশে থাকলেও শেকড় ভুলে যাননি। বছরে একাধিকবারই ছুটে আসেন শেকড়ের টানে।
এ শেকড়ের টানেই তিনি চট্টগ্রামে আনোয়ারায় একটি হাসপাতাল এবং একটি ভালো স্কুল করার পরিকল্পনা করেছেন। নিজের এলাকায় স্বাস্থ্য আর শিক্ষায় নিজেকে নিয়োজিত রাখবেন এ স্বপ্নই এখন দেখছেন এই তরুণ সিআইপি।
বাংলাদেশ সময়: ১১৫৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১৬
এডিএ/জেডএম