দূতাবাস গেইটে আগে থেকেই প্রস্তুত রাখা কাউন্টারগুলোতে তাদের নাম, মালিক, কোম্পানির নামসহ যে দালালের মাধ্যমে বাহরাইনে এসেছে তার নাম ও মোবাইল নম্বর লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। রাত ৯ টা পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার শ্রমিক দূতাবাস প্রাঙ্গণে হাজির হয়ে তাদের দুঃখ, দুদর্শার বর্ণনা দেন।
ভুক্তভোগী শ্রমিকরা বলেন- অতীতে এক সময় বাহরাইনে অনেকেই ব্যবসায়িকভাবে প্রতিষ্ঠিত হলেও বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক অবস্থায় নতুনভাবে সফল হওয়া খুবই কঠিন।
সাদ্দাম হোসেন নামে এক প্রবাসী বাংলাদেশি বাংলানিউজকে বলেন, সাড়ে চার লাখ টাকা খরচ করে দালালের মাধ্যমে বাহরাইনে আসেছেন। তাকে দুই বছরের ভিসা দেওয়ার চুক্তি হলে, এক বছরের ভিসা দেওয়া হয়েছে এবং বাহরাইনে আসার দুই মাসের মাথায় তার ভিসা বাতিল করে দেওয়া হয়। একমাত্র ভিটেমাটির দলিল বন্ধক রেখে বাহরাইনে এসে এখন নিঃস্ব তিনি। বৈধ উপায়ে বিদেশে এসেও তার এ সর্বনাশের দায় কে নেবে, প্রশ্ন রেখে কেঁদে ওঠেন সাদ্দাম।
বগুড়ার রমিজ উদ্দীন জানান, একমাত্র ফসলি জমি বিক্রি করে ও সুদে টাকা নিয়ে চার লাখ আশি হাজার টাকায় বাহরাইনে আসেন, এখানে এসে পাঁচ মাস খোঁজ করে ও মালিকের দেখা পাননি, বাহরাইনে প্রবেশের ১৫দিন পরেই তার ভিসা বাতিল হয়ে যায়, বাধ্য হয়ে ঋণের টাকার যোগান দিতে, রাস্তায় কোমলপানীয়ের বোতল খুঁজে বিক্রি করেন তিনি।
কুষ্টিয়া দৌলতপুরের হাসান জানান, দালালের কাছে ৬০ হাজার টাকা বেতন পাবেন শুনে মহাজনী সুদে ঋণ করে বাহরাইনে আসেন, চাকরি ও মালিক কিছুই না পেয়ে এখন রাস্তায় সবজি বিক্রি করেন তিনি। বছর শেষে না হতেই তার সুদমূলে দ্বিগুন টাকা গুণতে হচ্ছে। কিভাবে এ ঋণ পরিশোধ করবেন কান্নাজড়িত কণ্ঠে এমন প্রশ্নেই ছিল হাসানের?
এ রকম অসংখ্য হাসান, সাদ্দাম ও রমিজদের কান্নাজড়িত কণ্ঠের প্রশ্নের উত্তর বাহরাইনের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) কে এম মমিনুর রহমানসহ উপস্থিত কেউ দিতে পারেনি।
মূলত মধ্যপ্রাচ্যের বৃহৎ শ্রমবাজার সৌদি আরব, দুবাইসহ অন্যান্য শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যাওয়া বেপরোয়া হয়ে ওঠে ভিসার দালালরা। ফ্রি ভিসার ও মাসে লাখ টাকা আয়ের মিথ্যা লোভ দেখিয়ে সহজ, সরল মানুষদের বাহরাইনে নিয়ে আসেন তারা।
ফ্রি ভিসা নামে কোনো ধরনের ভিসা বাহরাইনে নেই। বাহরাইনের আইন অনুযায়ী স্থানীয় একটি কমার্শিয়াল লাইসেন্সের (সিআর) মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট কাজের চুক্তিতে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভিসা দেওয়া হয়। চুক্তিকৃত প্রতিষ্ঠান ব্যতিত শ্রমিকদের অন্য কোথাও কাজ করাটা সম্পূর্ণ অবৈধ ও বেআইনি। নিয়োগ প্রাপ্তরা প্রতিষ্ঠানের বাইরে কাজ করলে মালিক ও শ্রমিক উভয়কে ২ লাখ টাকা করে জরিমানাসহ অন্যান্য শাস্তির বিধান রয়েছে।
কিছু সংখ্যক বাংলাদেশি ও বাহরাইনিদের সমন্বয়ে গঠিত দালাল চক্রের সদস্যরা বেশি লাভের আশা দেখিয়ে ফ্রি ভিসার লোভ দেখিয়ে বাংলাদেশিদের বাহরাইনে নিয়ে আসেন।
অর্থনৈতিক মন্দার কারণে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়াতে বাহরাইনে যারা নতুন এসেছেন কাজ না পেয়ে তার দিশেহারা হয়ে পড়েন, খাদ্য ও বাসস্থান সংকটসহ ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে তখন তারা যেকোনো কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
দূতাবাসের একটি সুত্র জানায়, বর্তমানে বাহরাইনে অবৈধ শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ২০হাজার, এর মধ্যে প্রায় পাঁচহাজার শ্রমিক খাবার ও বাসস্থান সংকটে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
তথ্য যাচাই করে দেখা যায়, বাহরাইনে প্রতিবছর বছরে গড়ে ২০ থেকে ২৫ হাজার বাংলাদেশি আসে, কিন্তু দালালদের প্ররোচনায় ২০১৬ সালে বাহরাইনে প্রায় ৭৫ হাজার বাংলাদেশি লোক ঢুকেছে। চাহিদার তুলনায় অস্বাভাবিক শ্রমিক আসায় শ্রমের দাম অর্ধেকে নেমে এসেছে। কাজ না পেয়ে হাজার হাজার বেকারের সৃষ্টি হয়েছে।
অস্বাভাবিক শ্রমিক আসায় বাহরাইন থেকে দেশে রেমিটেন্স যাওয়ার বদলে বিকাশ ও হুন্ডির মাধ্যমে (প্রতিটি ভিসা বাবত ৩/৪ লাখ টাকা) বিশাল অংকের টাকা বাহরাইনে পাচার হয়েছে।
অবৈধ শ্রমিকেরা ভিসা স্থগিত করার জন্য দূতাবাসকে ধন্যবাদ জানান এবং তারা বৈধ না হওয়া পর্যন্ত ভিসা স্থগিত রাখার আহ্বান জানান।
রাষ্ট্রদূত শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, দূতাবাসে সব অবৈধ শ্রমিকদের তালিকা করা হচ্ছে, নতুন করে কোনো কোম্পানি কর্মী নিতে চাইলে তাদের এ তালিকা থেকে শ্রমিক দেওয়া হবে-যাতে করে অবৈধরা তাড়াতাড়ি বৈধ হতে পারে ।
রাষ্ট্রদূত বলেন, আমরা বিদ্যমান পরিস্থিত মোকাবলায় নতুন করে ভিসা সত্যায়ন স্থগিত করেছি তবে, যে সব কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত এবং শ্রমিকদের হয়রানির কোনো অভিযোগ নেই, যাচাই-বাচাই করে তাদের আবেদন বিবেচনা করা হবে।
রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, কাজ না থাকায় এখানে হাজার হাজার প্রবাসী মানবেতর জীবনযাপন করছে, হাজারো পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পথে বসেছে, তাই আগে এদের একটা সুব্যবস্থা করতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৪০০ ঘণ্টা, মার্চ ০৫, ২০১৭
ওএইচ/