ঢাকা: প্রসঙ্গ হুমায়ূন আহমেদের ‘দেয়াল’ উপন্যাস। এই উপন্যাসের প্রকাশনার ওপর আদালতের নির্দেশনা থাকলেও তা উপেক্ষা করার ঘটনা ঘটেছে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজার থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিক তার শুক্রবারের সাময়িকীতে `দেয়াল`-এর আরও একটি অধ্যায় প্রকাশ করেছে। অথচ সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে `দেয়াল` প্রকাশ না করার জন্য উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। গত ১৫ মে মঙ্গলবার ওই নির্দেশনা দেন আদালত। এর আগে দেয়ালের দুটি অধ্যায় প্রকাশ করে বিতর্কের সূত্রপাত করে ওই দৈনিক।
বঙ্গবন্ধু হত্যা সম্পর্কিত ভুল তথ্য সংশোধন না করা পর্যন্ত জননন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তার ‘দেয়াল’ উপন্যাস প্রকাশ করবেন না, নির্দেশনায় এমনটিই `প্রত্যাশা` করেছিলেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের এই প্রত্যাশাকে সম্মান দেখিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ নিজেও।
‘দেয়াল’-এ বঙ্গবন্ধু হত্যা সম্পর্কে কিছু ভুল তথ্য এবং ভুলভাবে ঘটনাটি উপস্থাপন করার অভিযোগ উঠলে বিষয়টি আদালতের নজরে এনেছিলেন স্বয়ং অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
সংশ্লিষ্টদের ধারণা, হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর তার লেখা এই অসমাপ্ত উপন্যাসটিই এখন পাঠকের বিপুল আগ্রহের কারণ হবে এবং তা বই আকারে ছাপা হয়ে বের হলে হটকেকের মতো বিক্রি হবে ---স্রেফ এমন মুনাফামুখি বিবেচনা থেকেই দৈনিকটি আদালতকে উপেক্ষা করে আরও একটি অধ্যায় প্রকাশ করলো। সেইসঙ্গে তারা চাইছে বিতর্কের কেন্দ্রে থেকে ফায়দা লুটতে।
এ প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বাংলানিউজকে বলেন, ``দৈনিক সম্পূর্ণ অনুচিত একটি কাজ করেছে। আদালতের নির্দেশনা থাকার কারণে ‘দেয়াল’ এর কোনো ধরনের প্রকাশনায় যাওয়া উচিত নয়। ``
``হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর `দেয়াল` কিভাবে প্রকশিত হতে পারে বা তার ভবিষ্যত কি হবে``--এ প্রশ্ন করা হলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ``বিষয়টি নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। ``
দৈনিকটিতে প্রকাশিত `দেয়াল`-র নতুন অংশ পড়ে এ নিয়ে বিস্তারিত কথা বলবেন বলেও বাংলানিউজকে জানান অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
উল্লেখ্য, দেয়ালের প্রথম দুটি অধ্যায় প্রকাশিত হওয়ার পর তা নিয়ে দেশজুড়ে ও দেশের বাইরে বাংলাভাষী মানুষের মধ্যে সমালোচনার ঝড় ওঠে। প্রকাশিত ওই দুটি অধ্যায়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিভিন্ন তথ্য ও প্রসঙ্গ ভুলভাবে আসার কারণেই মূলত সেই সমালোচনা। এ বিষয়টি গুরুত্বসহ গত ১৫ মে তা হাইকোর্টের নজরে আনেন অ্যাটর্নি জেনারেল। এতে স্বত:প্রণোদিত হয়ে ওই দিনই প্রথমে বঙ্গবন্ধুর হত্যা সম্পর্কিত ভুল তথ্য সংশোধন না করা পর্যন্ত ‘দেয়াল’ উপন্যাস প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে ভুল সংশোধনের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুলও জারি করেন। বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দীন চৌধুরী ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিমের ডিভিশন বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ওই আদেশ দেন। দুপুরের দেওয়া নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত আদেশটি সন্ধ্যায় সামান্য পরিবর্তন (রিভাইজ) করেন আদালত। পরিবর্তিত আদেশে হাইকোর্ট বেঞ্চ বলেন, আদালত প্রত্যাশা করছে হুমায়ূন আহমেদ তার উপন্যাসে বর্ণিত তথ্যগত অসঙ্গতি ও বিভ্রান্তিগুলো দূর করে তাতে ইতিহাসের সঠিক ঘটনা চিত্রায়ন করবেন।
ওই দিন আদালত বলেছিলেন, ``হুমায়ূন আহমেদ একজন শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি। তিনি বর্তমানে দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। তার ওপরে আদেশ দিয়ে তাকে আমরা বিব্রত করতে চাই না। আবার নতুন প্রজন্ম ভুল ইতিহাস জানুক সেটাও চাই না। কারণ মীর মশাররফের ``বিষাদসিন্ধু``তে কারবালার ইতিহাস যেভাবে অতিরঞ্জিত করে বর্ণনা করা হয়েছে, মানুষ সে ইতিহাস সেভাবেই জানে। ``
এ কারণে আদালত শিক্ষা, তথ্য ও সংস্কৃতি সচিবকে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ও সাক্ষ্য-বিবরণ হুমায়ূন আহমেদের কাছে সরবরাহ করতে নির্দেশ দেন। যাতে তিনি ভুল সংশোধনের সুযোগ পান। বিষয়টি হয়ে ওঠে সে সময়ের প্রধান আলোচ্য বিষয়।
আদালতের নির্দেশে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার পেপারবুক হুমায়ূন আহমেদকে পাঠানো হয়। বিষয়টি বাংলানিউজকে নিশ্চিত করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
২৯ মে বাংলানিউজকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে মাহবুবে আলম বাংলানিউজকে বলেন, “হুমায়ূন আহমেদের ওপর আমাদের আস্থা আছে। তার কাছে একটাই প্রত্যাশা, তিনি জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে বিয়োগান্তক ঘটনাটিকে এমনভাবে তুলে ধরবেন যাতে জাতির চেতনা জাগ্রত হয়। ”
মাহবুবে আলম বলেছিলেন, ``হুমায়ূন আহমেদের পাঠক লাখ লাখ মানুষ। তার মধ্যে যুবক-তরুণরাই বেশি। তাদের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টিও করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। এমন একজন লেখকের লেখা, যা হাজার লক্ষ পাঠক পড়বে তাতে কোনো ভুল তথ্য থাকলে তা গোটা সমাজকে প্রভাবিত করবে বলেই আমি মনে করি। ”
বিষয়টি মেনে নিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ নিজেও। বাংলানিউজকে একান্ত সাক্ষৎকারে তিনি বলেছিলেন, “আদালতের নির্দেশ মেনে আমি আমার বইয়ে প্রযোজনীয় সংশোধনী আনবো। সে লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছি। ”
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় সংক্রান্ত পেপারবুক হাতে পেয়েছেন এবং তা পড়তে শুরু করেছেন বলে জানিয়ে হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, “এটি একটি বিশাল নথি। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সময় নিয়ে পড়ছি। শেষ করতে সময় লাগবে। ”
বইটি কবে নাগাদ সংশোধন করে প্রকাশ করা হতে পারে জানতে চাইলে জবাবে হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, “আদালত যে নির্দেশ দিয়েছেন তা অক্ষরে অক্ষরে পালনের চেষ্টা করবো। আই অ্যাম আ ল’ অ্যাবাইডিং সিটিজেন (আমি একজন আইন মান্যকারী নাগরিক)। ”
এই ``ল’ অ্যাবাইডিং সিটিজেন``-এর অনেক আশা ছিলো ক্যান্সারের অপারেশনের পর সুস্থ হয়ে উঠে বইটি লেখার কাজ শেষ করবেন। কিন্তু তার সে ইচ্ছাপূরণ হয়নি। তিন দফা অপারেশনের পর একটি মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে অস্ত্রোপচার -পরবর্তী ভাইরাস সংক্রমণের শিকার হয়ে কোটি ভক্তকে কাঁদিয়ে চলে যান হুমায়ূন আহমেদ।
এ অবস্থায় ‘দেয়াল’র ভবিষ্যত কি হবে? সে প্রশ্ন অনেকের মধ্যে তৈরি হলেও কেউ তা সামনে আনেনি। শোকের ধকল কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছিলো। ঠিক তেমনই একটি সময়ে হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর এক সপ্তাহ পার না হতেই ওই দৈনিকটি প্রকাশ করলো দেয়ালের আরও একটি অধ্যায়।
হুমায়ূন আহমেদের এই `দেয়াল-বিতর্ক` হয়তো আরও দীর্ঘ সময় ধরে চলবে। তবে তা প্রকাশের আগে আদালতের নিষেধাজ্ঞা বা হুমায়ূন আহমেদের ইচ্ছার দিকটিও বিবেচনায় রাখা পত্রিকাটির উচিত ছিলো বলেই মনে করছেন অনেকে।
- হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ‘দেয়াল’ প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা
- সংশোধন করে ‘দেয়াল’ প্রকাশ করা হবে, আশা আদালতের
- ভুলে ভরা বই আগেই নিষিদ্ধ হওয়া উচিত ছিলো: হুমায়ূন আহমেদ
- একান্ত সাক্ষাৎকারে অ্যাটর্নি জেনারেল
আগেই পেপারবুক পড়ে নিতে পারতেন হুমায়ূন আহমেদ
বাংলাদেশ সময় ১৪৩৫ ঘণ্টা, জুলাই ২৮, ২০১২
এমএমকে[email protected];
জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর
[email protected]