ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৭ ফাল্গুন ১৪৩১, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২০ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

৪০ দেশের দেড় কোটি প্রবাসীর জন্য ‘অনলাইন ভোট’ আসছে

ইকরাম-উদ দৌলা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৩৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২৫
৪০ দেশের দেড় কোটি প্রবাসীর জন্য ‘অনলাইন ভোট’ আসছে

ঢাকা: প্রবাসীদের দীর্ঘদিনের চাহিদার প্রতিফলন হতে যাচ্ছে। চল্লিশটি দেশে বসবাসকারী প্রায় দেড় কোটি প্রবাসী ভোটারের জন্য ভোটদান ব্যবস্থা আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

এজন্য পাঁচ ধরনের ভোটিং ব্যবস্থা নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়েছে। শেষে অনলাইন ভোটিং ব্যবস্থাকেই সবার ওপরে রাখছে সংস্থাটি।

ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নির্বাচনী সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ও প্রবাসীদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে এএমএম নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন কমিশন বিদেশে মাটিতে বসেই ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ নিয়ে ইসি সচিবালয়কে প্রস্তাবনাও তৈরি করতে বলেছে। এক্ষেত্রে কোন কোন দেশ তাদের প্রবাসীদের ভোটিংয়ের ব্যবস্থা করেছে, কোন প্রক্রিয়ায় তারা এগিয়েছে তাও খতিয়ে দেখতে বলেছে।

জানা গেছে, এস্তোনিয়া ২০২৩ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করেছে অনলাইন ভোটিংয়ের মাধ্যমে। সিকিউর ডিজিটাল আইডির মাধ্যমে তারা ভোট নিয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ অংশগ্রহণ পেয়েছে দেশটি। ফ্রান্সে চালু আছে ইন-পারসন (সশরীরে), পোস্টাল ব্যালট (ডাকযোগে) ও প্রক্সি ভোটিং (অনুমতি সাপেক্ষে একজনের ভোট আরেকজন দেওয়া)। দেশটির ১১ আসনে প্রবাসীদের ভোট নেওয়া হয়েছে ২০২২ সালের প্রেসিডেন্টশিয়াল নির্বাচনে। এতে ভোট পড়ার হার ছিল সর্বোচ্চ।

যুক্তরাষ্ট্র ২০২০ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে পোস্টাল এবং ইলেকট্রনিক ভোটিং (ইভিএম) করেছে। সামরিক বাহিনী ও বেসামরিক সহায়তার মাধ্যমে ভোট হয়েছে। কিছু স্টেটে ই-মেইলে নিয়েছে ভোট। অস্ট্রেলিয়া ২০২২ সালের যুক্তরাষ্ট্রীয় নির্বাচনে পোস্টাল ব্যালট ও ইন-পারসন ভোটিং করেছে। এক্ষেত্রে ভোটারদের অগ্রিম রেজিস্ট্রেশন করতে হয়েছে। ভারতের ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে প্রক্সি ভোট ও ইন-পারসন ভোট হয়েছে। অগ্রিম নিবন্ধনের মাধ্যমে ভোটিং চালু করা হয়েছিল।

কানাডার যুক্তরাষ্ট্রীয় নির্বাচনে ২০২১ সালে পোস্টাল ও ইলেকট্রনিক ভোটিং ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

২০২১ সালে জার্মানি যুক্তরাষ্ট্রীয় নির্বাচনে পোস্টাল ব্যালটে ভোট নিয়েছিল। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রীয় নির্বাচনে সুইজারল্যান্ড পোস্টাল ও ইলেকট্রনিক ভোটিং ব্যবস্থা করেছিল। এছাড়া ২০২২ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দক্ষিণ কোরিয়া ইন-পারসন ও পোস্টাল ভোটিংয়ের ব্যবস্থা করেছিল। এই নির্বাচনগুলোকে রেফারেন্স হিসেবে নিয়ে প্রবাসীদের ডাকযোগে ভোটদান, প্রক্সি ভোটদান, দূতাবাস/কনস্যুলেটে ব্যক্তিগত ভোটদান, ইলেকট্রনিক ভোটদান (অনলাইন বা ইমেল) ও হাইব্রিড সিস্টেমে ভোটদানের বিষয়গুলো নিয়ে ভাবছে নির্বাচন কমিশন।

এক্ষেত্রে পোস্টাল ব্যালট, অনলাইন এবং প্রক্সি ভোট ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তবে অনলাইন ভোটিং সিস্টেমকেই প্রাধান্য দিচ্ছে সংস্থাটি।

এই পাঁচ ব্যবস্থায় ভোটদানের কিছু সুবিধা ও অসুবিধাও খুঁজে বের করেছে ইসি সচিবালয়। কর্মকর্তারা বলেছেন, পোস্টাল ব্যালট বা ডাকযোগে ভোটের অসুবিধা হলো বিলম্ব হওয়া। ডাকযোগে নির্ভরযোগ্যতা ও নিরাপত্তা উদ্বেগ রয়েছে। সহজ ও ডাকযোগে বিলম্ব এড়ানো গেলেও প্রক্সি ভোটের অসুবিধা হচ্ছে আস্থা অর্জন চ্যালেঞ্জ। কেননা, এই ব্যবস্থায় একজনের ভোট অন্যজন দেয়। এক্ষেত্রে ভোটারকে আগে থেকেই অন্যজনকে ভোট দেওয়ার ক্ষমতা প্রদান করতে হয়।

দূতাবাসে ব্যক্তিগত (ইন-পারসন) ভোটদান পদ্ধতি নিরাপদ ও স্বচ্ছ হলেও এতে দূরে থাকা ব্যক্তিদের প্রবেশাধিকার সীমিত। এক্ষেত্রে ভোটারকে দূতাবাসে ব্যালট দেওয়া হয় চাহিদার ভিত্তিতে।

ইলেকট্রনিক বা অনলাইনে ভোটিং সিস্টেম সবচেয়ে সুবিধাজনক ও দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায়। তবে সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে। এই ব্যবস্থায় ভোটার আগেই নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করে নেন। এছাড়া হাইব্রিড সিস্টেম সহজ হলেও বাস্তবায়ন জটিল। এই ব্যবস্থায় ভোটার অনলাইনে নিবন্ধন করার পাশাপাশি সরাসরি ব্যালটে ভোট দিয়ে থাকেন।

বিদেশে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ও ভোটদানে চ্যালেঞ্জ

প্রবাসীদের ভোটদানের ব্যবস্থা আনতে ১৫ ধরনের সমস্যা চিহ্নিত করেছেন ইসি কর্মকর্তারা। এগুলো হলো- লজিস্টিক সমস্যা, আইনি বাধা, নিরাপত্তা উদ্বেগ, সচেতনতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, কর্মস্থল থেকে দূরত্ব, কর্মস্থল থেকে ছুটি, প্রবাসী শ্রমিকদের আর্থিক ক্ষতি, হোস্টিং দেশের অনুমতি, মিশন/দূতাবাসে স্থান সংকুলান, বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, ব্যালট পেপার বিতরণ, ফলাফল শিট তৈরি, সমন্বয়, ব্যয়ভার প্রভৃতি। কর্মকর্তারা বলছেন, সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে আইনি। কেননা

পোস্টাল ব্যালটের জন্য আইন থাকলেও অন্যগুলোর জন্য আইন নেই। কিন্তু পোস্টাল ব্যালটে ভোটাদানের বিষয়টি কার্যকর নয়। তাই অন্যপন্থাগুলোই বিবেচনায় নিতে হবে। অন্যদিকে প্রবাসীদের অনেকেই নিরক্ষর কিংবা প্রযুক্তিজ্ঞান কম। তাই অন্য ব্যবস্থাগুলোও তাদের জন্য একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। তাদের ছুটির বিষয়ও রয়েছে। সবগুলো বিষয় পর্যালোচনা করেই এগোতে হচ্ছে কমিশনকে।

এ বিষয়ে ইসির সিস্টেম ম্যানেজার রফিকুল হক বলেন, অনলাইন ভোটিং ব্যবস্থাকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আমরা এখনো কাজ করছি। কোনো সিদ্ধান্ত এখনো নেয়নি কমিশন। যেসব দেশে অধিক সংখ্যা প্রবাসী রয়েছে তাদেরকেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অনলাইনে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে যারা ভোট দিতে চান, তাদের আগে নিবন্ধন করতে হবে। সে অনুযায়ী, নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে নিবন্ধনের পর তারা একটা টোকেন নম্বর পাবেন। সে অনুযায়ী ব্যালট ইস্যু করা হবে। তারপর সেখানে ভোট দিয়ে ই-মেইলে বা সেই পোর্টালের মাধ্যমেই ব্যালট জমা দিতে পারবেন। তবে বিষয়গুলো এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।

প্রবাসীদের ভোটিং ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করার আগে রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের মতামত নেওয়া হবে। তারা বিষয়টি চায় কি না, চাইলেও কীভাবে চায় সেটা নিয়ে আগে ঐক্যমত্য হতে হবে। কেননা, এটা খুব স্পর্শকাতর বিষয়। দলগুলোর মতামত ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না ইসি। সবাই একমত হলে সে অনুযায়ী, প্রথমে মক ভোটিং করা হবে। এরপর হবে পাইলটিং। আর সেটা কীভাবে হবে পরে সে সিদ্ধান্ত নেবে কমিশন।

এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেছেন, প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটিং পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তিনটি পদ্ধতি আমাদের সামনে আছে। একটি হলো- পোস্টাল ব্যালট, যদিও ওটা খুব একটা কার্যকরী নয়।

দ্বিতীয়টা হচ্ছে প্রক্সি ভোটিং। এই বিধান বিভিন্ন দেশে আছে। আর তৃতীয় অপশন হচ্ছে অনলাইনে ভোটের ব্যবস্থা। কিন্তু এটি খুব সহজ নয়। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি প্রথম দুটি উপায়কে ডেভেলপ করব এবং অনলাইন ভোটিংটা আরও বেশি পর্যালোচনা করব। পরে অনলাইন ভোটিংয়ের ওপর একটা পাইলটিং করব।

৪০ দেশের প্রবাসীদের জন্য ভোটিং ব্যবস্থা

নির্বাচন কমিশন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, জনশক্তি ব্যুরো, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসহ (বায়রা) বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে দেখেছে ৪০টি দেশে বাংলাদেশি প্রবাসীদের আধিক্য রয়েছে। এইসব দেশকেই মাথায় রেখে কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। দেশগুলো হলো- সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার, বাহরাইন, লেবানন, জর্ডান, লিবিয়া, সুদান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাজ্য, ইতালি, হংকং, মিশর, ব্রুনাই, মরিশাস, ইরাক,
যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, গ্রিস, স্পেন, জার্মানি, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, ব্রাজিল, চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, নিউজিল্যান্ড, রাশিয়া, তুরস্ক ও সাইপ্রাস। এই সব দেশে এক কোটি ৪০ লাখ ৪৬ হাজার ৫৩৪ জন প্রবাসী রয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে রয়েছে বেশি অর্থাৎ ৪০ লাখ ৪৯ হাজার ৫৮৮ প্রবাসী রয়েছে সৌদি আরবে আর সবচেয়ে কম রয়েছে নিউজিল্যান্ডে ২৫০০ জন।

বর্তমান তালিকা অনুযায়ী, ভোটার সংখ্যা হলো ১২ কোটি ১৮ লাখ ৫০ হাজার ১৬০ জন। এদের মধ্যে পুরুষ ভোটার ছয় কোটি ২১ লাখ ৪৪ হাজার ৫৮৭ জন, আর নারী ভোটার পাঁচ কোটি ৯৭ লাখ ৪ হাজার ৬৪১ জন। আর হিজড়া ভোটার ৯৩২ জন। চলমান হালনাগাদে আরও ৫০ লাখের মতো ভোটার তালিকায় যুক্ত হবেন।

বাংলাদেশ সময়: ০০৩৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২৫
ইইউডি/এমজে/এইচএ/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।