ঢাকা: বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত সবসময়ই প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছে বলে অভিযোগ আছে। বিশেষ করে পতিত শেখ হাসিনার সরকারের ১৬ বছরের শাসনামলে এই প্রভাব অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠছিল সমালোচকদের কাছে।
যদিও হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে এ নিয়ে সমালোচনার সাহস হয়নি বিশ্লেষকদের। কেবল বিরোধী রাজনীতিকরা চুক্তিগুলোর বিস্তারিত প্রকাশের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অবিস্মরণীয় অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতন হলে ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। তারপর থেকে ভারতের সঙ্গে হাসিনার সরকারের সম্পাদিত চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক নিয়ে আবারও আলোচনা তৈরি হয়। বিভিন্ন মহল থেকে অসামাঞ্জস্য ও দেশের স্বার্থবিরোধী সব চুক্তির বাতিল দাবি করা হচ্ছে। কেউ কেউ চুক্তি পর্যালোচনার কথাও বলছেন। যদিও চুক্তি বাতিল করা সম্ভব কি না, সে প্রশ্নও উঠছে।
১৪ বছরে ৮৭ সমঝোতা-চুক্তি
বিতর্কিত ওয়ান-ইলেভেনের আমলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে ২০০৮ সালে সরকারে এসে তারপর টানা ১৬ বছর ক্ষমতায় ছিল শেখ হাসিনার সরকার। নবম জাতীয় নির্বাচন নিয়ে তেমন আলোচনা না হলেও পরবর্তী তিনটি অর্থাৎ দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন হয়েছে বিতর্কিত কায়দায়। এর মধ্যে দশম নির্বাচন বিনা ভোটের, একাদশ নির্বাচন রাতের ভোট এবং দ্বাদশ নির্বাচন ডামি ভোট হিসাবে কুখ্যাতি পেয়েছে। এই সবক’টি নির্বাচন নিয়ে দেশ-বিদেশে সমালোচনা থাকলেও আওয়ামী লীগ সরকারকে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়েছে ভারত।
পাশাপাশি দিল্লি এবং ঢাকা এই দীর্ঘ সময়ে তাদের ‘সুসম্পর্কের কথা’ প্রচার করে বেড়িয়েছে। এমনকি দুদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে হাসিনার সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন ‘স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মতো’ বলেও মন্তব্য করেছিলেন।
এ কথিত ‘সুসম্পর্কের’ সময়ে দুই দেশের মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ে অনেক সফর বিনিময় হয়েছে। শেখ হাসিনা একাধিকবার ভারত সফরে গেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীসহ সেদেশের অনেক শীর্ষ কর্তাও বাংলাদেশে এসেছেন। সফরকালে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি ও সমঝোতা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন পর্যায়ে দ্বিপক্ষীয় সফরকালেও চুক্তি ও সমঝোতা সই হয়েছে।
সূত্র মতে, ২০১০ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ২০টি চুক্তি হয়েছে। আর সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে ৬৭টি। এসব ছিল ট্রানজিট, যোগাযোগ, বন্দর, বিদ্যুৎ-জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠ আদানি গ্রুপের সঙ্গে অদ্ভুত বিদ্যুৎ সরবরাহ চুক্তি(২৫ বছর মেয়াদী চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি হিসেবে আমদানি করা কয়লা ব্যবহার হবে। কিন্তু যে পদ্ধতিতে কয়লা আমদানি করা হবে তাতে আমদানি খরচ বেশি দেখানোর সুযোগ রয়েছে। এতে আদানির মুনাফা বৃদ্ধির বিশেষ সুযোগ রয়েছে), রেল ট্রানজিট সংক্রান্ত চুক্তি (যাতে ভারতের ট্রেন বাংলাদেশের দর্শনা দিয়ে প্রবেশ করে চিলাহাটি-হলদিবাড়ি সীমান্ত দিয়ে ফের ভারতে যেতে পারে), ফেনী নদী থেকে ১ দশমিক ৮১ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুম শহরে সরবরাহে সমঝোতা, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর দিয়ে ভারত থেকে এবং ভারতে পণ্য আনা-নেওয়ায় স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং সিস্টেম (এসওপি) স্বাক্ষর ইত্যাদি দেশের মানুষের মনে নানা সন্দেহ-সংশয় তৈরি করেছে। এসব চুক্তিতে বাংলাদেশের লাভ কোথায় এমন প্রশ্ন যেমন এসেছে, তেমনি প্রকাশ হয়েছে দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে উদ্বেগও।
চুক্তির পুনর্বিবেচনার দাবি
শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বিভিন্ন পক্ষ থেকে ভারতের সঙ্গে হওয়া চুক্তি ও সমঝোতার পর্যালোচনা বা পুনর্বিবেচনার দাবি তোলা হচ্ছে। বিশেষ করে বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল থেকেই এই দাবি আসছে।
রেল ট্রানজিট চুক্তি নিয়ে গত বছরের জুনেই এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘চুক্তি ও সমঝোতার নামে এদেশের প্রতিরক্ষা ও জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টিকে ভারতের জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার অংশে পরিণত করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য খুবই বিপজ্জনক। ’
তিনি আরও বলেন, ‘একতরফাভাবে ভারতকে করিডোর সুবিধা দেয়ার জন্য এ চুক্তি করা হয়েছে। এ ট্রেন বাংলাদেশের কোনও মানুষ ব্যবহার করতে পারবে না। এতে বাংলাদেশের কোনো লাভও হবে না। ’
হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ডিসেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ‘আধিপত্যবিরোধী ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে আয়োজিত মশাল মিছিল পূর্ববর্তী সমাবেশে ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত সব চুক্তি জনসম্মুখে প্রকাশের দাবি জানায় একদল শিক্ষার্থী।
সবশেষ গত ১১ জানুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘বাংলাদেশে ভারত রাষ্ট্রের আধিপত্য: স্বরূপ ও করণীয়’ শীর্ষক এক সেমিনারে ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের আমলে করা চুক্তিগুলো প্রকাশের দাবি জানানো হয়।
সেখানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক বুদ্ধিজীবী আনু মুহাম্মদ বলেন, ভারত প্রসঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের সুনির্দিষ্ট কিছু বক্তব্য, অভিযোগ ও সমস্যা আছে। এটা সাম্প্রদায়িক কোনো বিষয় নয়। এটি আধিপত্যের সমস্যা। শেখ হাসিনার সরকার শর্তহীনভাবে আত্মসমর্পণ করেছে। একের পর এক চুক্তি করেছে। এর প্রধান কারণ ছিল নির্বাচন ছাড়া চিরস্থায়ী ক্ষমতা তৈরি করা। সে কারণে তার পুরো নির্ভরশীলতা তৈরি হয় ভারত রাষ্ট্রের ওপরে।
তিনি এ সময় ভারতের সঙ্গে করা সব চুক্তির পাশাপাশি অন্যান্য দেশের সঙ্গে সই করা চুক্তিগুলো প্রকাশ করার দাবি জানিয়ে বলেন, যেসব চুক্তি জনস্বার্থবিরোধী, দেশের জন্য ক্ষতিকর সেগুলো বাতিল করা, চুক্তি বাতিলের পথ অনুসন্ধান করা সরকারের প্রথম দায়িত্ব।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পাদিত চুক্তি ও সমঝোতা শুধু পরররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে হয়নি, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও হয়েছে। এসব মন্ত্রণালয়, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান চাইলে তাদের চুক্তি -সমঝোতা পর্যালোচনা ও পুনর্বিবেচনা করতে পারে।
ভারতের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা কি সম্ভব?
ভারতের সঙ্গে চুক্তি ও সমঝোতা বাতিল করা সম্ভব কি না, এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, যে কোনো দেশের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি ও সমঝোতা চাইলেও বাতিল করা সম্ভব না। চুক্তি ও সমঝোতা বাতিলের জন্য উভয়পক্ষের সম্মতি প্রয়োজন। দুই পক্ষ রাজী থাকলেই কেবল বাতিল করা সম্ভব। আবার কোনো কোনো চুক্তিতে ধারা উল্লেখ থাকে, সে চুক্তি কীভাবে বাতিল হবে। এছাড়া প্রতিটি চুক্তিরই নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে। এসব চুক্তি সাধারণত ২ থেকে ৫ বছর মেয়াদী হয়। নির্দিষ্ট সময় শেষে এসব চুক্তি-সমঝোতার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। মেয়াদ শেষে আবার উভয়পক্ষের সম্মতিতে নবায়ন করা হয়ে থাকে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যেসব চুক্তি ও সমঝোতা সই হয়েছে, সেসব বাতিল করা সম্ভব কি না জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, দুই দেশের সঙ্গে যেসব চুক্তি ও সমঝোতা সই হয়েছে, সেখানে অসামাঞ্জস্যতা রয়েছে কি না, সেসব পর্যালোচনার জন্য খুব ভালোভাবে হোম ওয়ার্ক করতে হবে। তাহলেই বলা যাবে, চুক্তি ও সমঝোতায় কোন কোন ধারায় অসামাঞ্জস্য রয়েছে, বা আমাদের আপত্তিগুলো কোথায়। তবে সেটি করার জন্য কোনো কমিটি হয়েছে বলে আমার জানা নেই। যদি মনে হয়, কোনো অসম চুক্তি বা সমঝোতা হয়েছে, তাহলে উভয়পক্ষের মধ্যে আলোচনার সুযোগ আছে।
তিনি আরও বলেন, ভারতের সঙ্গে চুক্তি পর্যালোচনা হতে পারে। আরও দুই একটি দেশের সঙ্গেও চুক্তি পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। তবে কোনো দেশের সঙ্গে চুক্তি পর্যালোচনা করতে হলে রাজনৈতিক সরকার হলে ভালো হয়। কেননা রাজনৈতিক সরকার থেকে চুক্তি পর্যালোচনা বা বাতিলের আলোচনা উঠলে সেটা খুব জোরালো হবে। কিন্তু আমাদের এখানে রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার যদি যে কোনো ফর্মে চুক্তিগুলোর পর্যালোচনা করে যেতে পারে, তাহলে পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারের জন্য পদক্ষেপ নেওয়া খুব সহজ হবে।
ভারতের সঙ্গে অসম চুক্তি-সমঝোতা স্মারক বাতিল করা সম্ভব কি না জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. সাহাব এনাম খান বাংলানিউজকে বলেন, কোনো দেশের সঙ্গে চুক্তি বাতিলের ক্ষেত্রে আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। চুক্তি চাইলেই বাতিল করা সম্ভব নয়। বাতিলের ক্ষেত্রে কোন চুক্তির কোন ধারায় কী আছে, সেটা বিবেচনায় নিতে হবে। তবে সমঝোতা সই যে কোনো পক্ষ সহজে বাতিল করে দিতে পারে।
তিনি আরও বলেন, জনস্বার্থে সব চুক্তিই প্রকাশ করা উচিৎ। তবে কিছু চুক্তি থাকে নিরাপত্তাজনিত, হয়তো সেগুলো প্রকাশের সুযোগ থাকে না। এমন দু-একটা বাদে জনসম্পৃক্ত সব চুক্তিই প্রকাশযোগ্য।
যা বলছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
ভারতের সঙ্গে চুক্তি বাতিল বা পর্যালোচনার বিষয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এম তৌহিদ হোসেন বলেন, ভারতের সঙ্গে যেসব চুক্তি হয়েছে, সবতো আর আমাদের মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে হয় না, সেখানে কিছু গোপনীয় আছে কি না আমার জানা নেই। তবে, বাই অ্যান্ড লার্জ যে চুক্তি হয়ে থাকে, সেগুলো কিন্তু ওপেন (প্রকাশিত)। এখানে গোপনীয় কিছু নেই। তবে অসামাঞ্জস্য চুক্তির কথা যদি বলেন, আপনি দরকষাকষি যদি করেন, সেটা করবেন চুক্তির আগে। চুক্তির পরে নয়। আর চুক্তির পর পর্যালোচনা করতে চাইলে সেটা দুই পক্ষ মিলেই করতে হবে। এক তরফাভাবে বাতিল করতে পারবেন না।
আওয়ামী লীগ আমলে ভারতের সঙ্গে যেসব চুক্তি ও সমঝোতা হয়েছে, সেসব চুক্তি ও সমঝোতা বাতিল বা পর্যালোচনা হবে কি না জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনকূটনীতি অনুবিভাগের মহাপরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রফিকুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, ভারতের সঙ্গে চুক্তি ও সমঝোতা সই আমাদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সঙ্গে হয়েছে। কোনো মন্ত্রণালয় ও সংস্থা পর্যালোচনা বা পুনর্বিবেচনা করতে চাইলে করতে পারে। ভারতের সঙ্গে যেসব চুক্তি হয়েছে, তার সব চুক্তি প্রকাশিত। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটেও দেওয়া আছে, এগুলো সবই প্রকাশিত।
বাংলাদেশ সময়: ০০০১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২৫
টিআর/এইচএ/