ঢাকা: ১৬ বছর আগে রাজধানীর পিলখানায় তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলস-বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদর দপ্তরে হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় সরকারের গঠন করা জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করতে চান আসামিপক্ষের আইনজীবী।
এর মধ্যে নিম্ন আদালতে বিস্ফোরক মামলার বিচার কাজ স্থগিত রেখে হত্যা মামলায় খালাসপ্রাপ্ত এবং ইতোমধ্যে যাদের সাজা খাটা শেষ হয়েছে তাদের মুক্তি চেয়েছেন আইনজীবী মো. আমিনুল ইসলাম।
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদর দপ্তরে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায় বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যরা। সেই ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জন প্রাণ হারান।
এ ঘটনায় দুই মামলার মধ্যে হত্যা মামলার বিচার কাজ হাইকোর্ট বিভাগে সম্পন্ন হওয়ার পর আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। অপরদিকে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলা এখনো নিম্ন আদালতে বিচারাধীন।
হত্যা মামলায় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর রায় দেন বিচারিক আদালত। এতে ১৫২ জনের ফাঁসি এবং ১৬০ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। ১০ বছরসহ বিভিন্ন মেয়াদের সাজা হয় ২৫৬ জনের। খালাস পান ২৭৮ জন।
নিয়ম অনুসরে ডেথ রেফারেন্স আসে হাইকোর্টে। আপিল করেন আসামিরা। কয়েকজন খালাসপ্রাপ্তের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষও।
হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চে শুনানি শেষে ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর রায় দেওয়া হয়। রায়ে ফাঁসি বহাল হয় ১৩৯ জনের। যাবজ্জীবন দণ্ড দেওয়া হয় ১৮৫ জনকে। ২২৮ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়। খালাস পান ৪৫ জন।
ওই রায়ের ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে ১১ হাজার ৪০৭ পৃষ্ঠার রায় লিখেছেন বিচারপতি মো. শওকত হোসেন। ১৬ হাজার ৫৫২ পৃষ্ঠার রায় লিখেছেন বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী। আর বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার লিখেছেন ১ হাজার ১০০ পৃষ্ঠার রায়।
এদিকে উচ্চ আদালতে খালাস পাওয়া ও সাজা কমা ৮৩ জনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষ লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) দায়ের করেছে।
আসামিপক্ষেও লিভ টু আপিল দায়ের করা হয়েছে আপিল বিভাগে।
রায়ের পৃষ্ঠা বেশি হওয়ায় একটি আপিলের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৫ হাজার ৬২৩ পৃষ্ঠায়। এতে আপিল করতে অর্থকষ্টে পড়েন আবেদনকারীরা। পরে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পেপারবুক ছাড়া আপিল করতে প্রধান বিচারপতি প্রশাসনিক আদেশ দেন।
তদন্ত কমিশন গঠন
৫ আগস্টে পট পরিবর্তনের পর এ বিষয়ে তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি ওঠে। এ অবস্থায় গত ২৪ ডিসেম্বর একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিডিআর সদর দপ্তর, পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের নামে সংঘটিত বর্বরতম হত্যাযজ্ঞের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ রিট পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে একটি জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠনের মাধ্যমে পুনঃতদন্তের জন্য নির্দেশনা প্রদান করেছে। সেহেতু সরকার পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের নামে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে জড়িত দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ও প্রকৃত ঘটনার স্বরূপ উদ্ঘাটন, ঘটনায় রুজুকৃত দুটি মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তি ব্যতীত, ঘটনার ষড়যন্ত্রকারী, ঘটনার সহযোগী, ঘটনার আলামত ধ্বংসকারী, ঘটনা সংঘটনকারী এবং ঘটনা সংশ্লিষ্ট অপরাপর বিষয় ও অপরাধীদের চিহ্নিত করতে একটি জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করল।
এতে সভাপতি করা হয় বিডিআরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমানকে। আর সদস্য হিসেবে আছেন মেজর জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. সাইদুর রহমান (বীর প্রতীক), অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব মুন্সী আলাউদ্দিন আল আজাদ, অবসরপ্রাপ্ত ডিআইজি ড. এম. আকবর আলী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. শরীফুল ইসলাম ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহনেওয়াজ খান চন্দন।
পরে ৬ ফেব্রুয়ারি কমিশনে আরও একজন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তিনি হলেন (অব.) মেজর এটিকেএম ইকবাল।
এ কমিশন ২০ ফেব্রুয়ারি একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সেখানে কমিশনের প্রধান আ ল ম ফজলুর রহমান জানান, কমিশন পাঁচটি কর্মপরিধি ঠিক করেছে। এর মধ্যে আছে পিলখানায় সংঘটিত ঘটনার স্বরূপ উদ্ঘাটন। সংঘটিত হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য অপরাধ সংঘটনকারী, সহায়তাকারী, ষড়যন্ত্রকারী, ঘটনার আলামত ধ্বংসকারী, ইন্ধনদাতা এবং ঘটনা সংশ্লিষ্ট অপরাপর বিষয়সহ দেশি ও বিদেশি–সংশ্লিষ্ট অপরাধী ব্যক্তি/গোষ্ঠী/সংস্থা/প্রতিষ্ঠান/বিভাগ/সংগঠন ইত্যাদি চিহ্নিতকরণ। হত্যাকাণ্ডসহ সংঘটিত অপরাপর অপরাধ প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিতকরণ। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলা এবং সংশ্লিষ্ট মামলায় অভিযুক্তগণের দায়/অপরাধ অক্ষুণ্ন রেখে সংশ্লিষ্ট মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, এমন প্রকৃত অপরাধীদের তদন্ত প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্তকরণ।
কমিশন জানায়, এখন পর্যন্ত যে ৩৭ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে আছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল তিনজন, মেজর জেনারেল দুজন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পাঁচজন, কর্নেল চারজন, লে. কর্নেল চারজন, মেজর সাতজন, ক্যাপ্টেন দুজন, বিডিআর সদস্য সাতজন ও শহীদ পরিবারের সদস্য তিনজন।
এছাড়া বিভিন্ন ব্যক্তির বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করা হয়েছে। কমিশন গুরুত্বপূর্ণ সব ব্যক্তিকে সাক্ষ্য গ্রহণের প্রয়োজনে আমন্ত্রণ জানাবে। এই বিষয়ে সবাইকে ধৈর্য ধারণের জন্য অনুরোধ জানানো হয়। যে কেউ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে তথ্য নিতে পারবেন বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয় ।
আসামিপক্ষের আইনজীবীর বক্তব্য
এ বিষয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী মো. আমিনুল ইসলাম সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, বিস্ফোরক মামলার বিচারকাজ শুরু হয়েছে। ১৩শ’ জনের মতো সাক্ষীর মধ্যে ২৮৫ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। আমরা জানি না রাষ্ট্রপক্ষ কবে এটা শেষ করবে। ১৬/১৭ বছর হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত বিচারকাজ চলছে।
আসামিদের জামিনে মুক্তির বিষয়ে তিনি বলেন, হত্যা মামলায় ২৭৮ জন খালাসপ্রাপ্ত ও ২৬৫ জন ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত ছিলেন। যাদের ১০ বছরের সাজা ছিল ইতোমধ্যে সেটা খাটা হয়ে গেছে। ১৮৭ জন ৯ জানুয়ারি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। আরও ১০০ জনের পক্ষে জামিনের আবেদন করেছি। ২৫৬ জনের বিষয়েও জামিনের আবেদন করেছি। ১৩ মার্চ ওই জামিন আবেদনের ওপর আদেশের জন্য দিন রেখেছেন আদালত। আশা করছি ওইদিন তারা জামিনে মুক্তি পাবেন।
কমিশনের বিষয়ে আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, কমিশন তিন মাসের মধ্যে একটি প্রতিবেদন দেওয়ার কথা বলেছে। একদিকে বিচার কাজ চলছে আরেকদিকে তদন্ত চলছে। এটি কিন্তু একটি আরেকটির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সে কারণে নিম্ন আদালতে বলেছিলাম, মামলার বিচার কাজ স্থগিত রাখতে। কমিশনের রিপোর্ট আসা পর্যন্ত। না হলে একটি সাংঘর্ষিক সিদ্ধান্ত এসে যেতে পারে। এতে বাদী যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হন, আসামিরাও ক্ষতিগ্রস্ত হন। ইতোমধ্যে ভিকটিম পরিবারের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একটি অভিযোগ দায়ের হয়েছে। সেই অভিযোগে ভিকটিম পরিবার সুনির্দিষ্ট নাম দিয়ে তৎকালীন সরকারপ্রধান (ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা) থেকে শুরু করে অনেকের নাম দিয়েছে। আমরা জানতে পেরেছি, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে।
আমিনুল ইসলাম বলেন, সব কিছু বিচার বিশ্লেষণ করে আমরা মনে করি, যারা হত্যা মামলায় খালাস পেয়েছেন, যাদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরকের অভিযোগ নেই, তাদের শ্রেণি বিন্যাস করে দ্রুত মুক্তি দেওয়া। যতক্ষণ কমিশনের রিপোর্ট না আসে ততক্ষণ বিচারকাজ স্থগিত রাখা। আর আপিল বিভাগকে সামগ্রিক বিষয়ে শুনে একটি গঠনমূলক আদেশ দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি।
বাংলাদেশ সময়: ০১৫১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২৫
ইএস/এইচএ/এজে