ঢাকা, সোমবার, ২৪ ফাল্গুন ১৪৩১, ১০ মার্চ ২০২৫, ০৯ রমজান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

দূষণে ঝুঁকিতে পুরুষের প্রজনন স্বাস্থ্য, বাড়ছে বন্ধ্যাত্ব

রেজাউল করিম রাজা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৫৯ ঘণ্টা, মার্চ ৯, ২০২৫
দূষণে ঝুঁকিতে পুরুষের প্রজনন স্বাস্থ্য, বাড়ছে বন্ধ্যাত্ব

ঢাকা: রাজধানীতে বসবাসরত ৬০ থেকে ৭০ লাখ পুরুষ প্রজনন স্বাস্থ্যের সর্বোচ্চ মাত্রার ঝুঁকিতে আছে। তাদের শুক্রাণুর মান ও পরিমাণ কমে যাচ্ছে।

ফলে দিন দিন বন্ধ্যা দম্পতির সংখ্যা বাড়ছে।

বাংলাদেশ অ্যান্ডোক্রাইন অ্যান্ড মেটাবোলিজম সোসাইটির এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।

বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা দূষণ। রাজধানী ঢাকা প্রায়ই বায়ু দূষণের শীর্ষে অবস্থান করছে। ঢাকার পাশাপাশি সারা দেশেই বায়ু, পরিবেশ, মাটি, নদী এবং পানিসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই বাড়ছে দূষণ।

দূষণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দেশে দূষণজনিত বহুবিধ মানসিক ও শারীরিক রোগব্যাধি। একইসাথে দূষণের প্রভাব পড়ছে পুরুষের প্রজনন স্বাস্থ্যে। ফলে একদিকে যেমন পুরুষের যৌন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, তেমনি বাড়ছে বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকি।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, দূষণের কারণে বাতাসের বিষাক্ত উপাদানগুলো মানুষের প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। এতে পুরুষের শুক্রাণুর মান ও পরিমাণ কমে যাচ্ছে। ডিম্বাণুর সঙ্গে নিষিক্তের ক্ষমতাসম্পন্ন সুস্থ সবল শুক্রাণুর উৎপাদন কম হচ্ছে।

দূষণের ক্ষতিকর উপাদান যেমন, মাইক্রো প্লাস্টিক, সীসা, মার্কারির মতো ক্ষতিকর পদার্থগুলো আমাদের শরীরের এন্ড্রোকাইন সিস্টেমকে বাধাগ্রস্ত করে হরমোনাল ব্যালেন্সকে (হরমোনের ভারসাম্য) প্রভাবিত করে। দূষণের বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক আমাদের শরীরের বায়োকেমিক্যাল ব্যালেন্স (জৈবরাসায়নিক ভারসাম্য) নষ্ট করে দেয়। এতে হরমোনাল গ্লান্ড (হরমোন গ্রন্থি) ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে প্রজনন স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।

পুরুষের প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর দূষণের প্রভাব বিষয়ে বাংলাদেশ অ্যান্ডোক্রাইন অ্যান্ড মেটাবোলিজম সোসাইটির এক গবেষণায় দেখা যায়, দূষণ বিভিন্নভাবে পুরুষের উর্বরতা হ্রাস করছে। দূষণ শুক্রাণুর গুণগতমান, হরমোনের ভারসাম্য এবং সামগ্রিক প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

বায়ু দূষণ
বাতাসের অতি সূক্ষ্ম ক্ষতিকর কণা রক্তে প্রবেশ করে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস সৃষ্টি করে যা শুক্রাণুর ডিএনএর ক্ষতি এবং গতিশীলতা হ্রাস করে।

নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড এবং সালফার ডাই অক্সাইড এই গ্যাসগুলি নিম্ন শুক্রাণুর ঘনত্ব এবং অস্বাভাবিক শুক্রাণুর আকারের সাথে সাথে যুক্ত।

পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন যানবাহনের ধোঁয়া এবং শিল্প বর্জ্য থেকে পাওয়া যায়, যা হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা এবং শুক্রাণু উৎপাদনকে ব্যাহত করতে পারে।

পানি দূষণ
পানিতে থাকা সীসা, ক্যাডমিয়াম এবং পারদের মতো দূষিত পদার্থগুলি শরীরে জমা হয়ে টেস্টিকুলারের ক্ষতি, শুক্রাণুর সংখ্যা হ্রাস এবং হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণ হতে পারে।

পানিতে থাকা কীটনাশকের মতো রাসায়নিক পদার্থ হরমোন উৎপাদন এবং কার্যকারিতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে, যার ফলে টেসটোস্টেরনের মাত্রা কমে যায় এবং স্পর্মাটোজেনেসিস হয়।

মাটি দূষণ
অর্গানোফসফেট এবং গ্লাইফোসেটের মতো রাসায়নিক পদার্থ মাটিতে প্রবেশ করে খাদ্য ও পানি দূষিত করে, যার ফলে শুক্রাণুর ডিএনএর ক্ষতি এবং উর্বরতা কমে যায়।

ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক দূষণ
মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ এবং ওয়াইফাই থেকে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিকের দীর্ঘায়িত এক্সপোজার শুক্রাণুর গতিশীলতা এবং বর্ধিত ডিএনএ ফ্র্যাগমেন্টেশনের সঙ্গে যুক্ত। এক্সরে এবং অন্যান্য ধরনের আয়নাইজিং রেডিয়েশনের এক্সপোজার শুক্রাণু কোষের এবং টেস্টিকুলার টিস্যুর সরাসরি ক্ষতি করতে পারে।

দূষণের ফলে বন্ধ্যাত্বের প্রক্রিয়াঅক্সিডেটিভ স্ট্রেস
ফ্রি রেডিকেল: দূষণের ফলে প্রতিক্রিয়াশীল অক্সিজেন শুক্রাণুর ডিএনএ প্রোটিন এবং লিপিডের ক্ষতি করে, যার ফলে শুক্রাণুর গুণগত মান কমে যায়।

অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের ক্ষয়: দূষণের দীর্ঘস্থায়ী এক্সপোজার শরীরের প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলোকে হ্রাস করতে পারে, অক্সিডেটিভ ক্ষতিকে বাড়িয়ে তুলতে পারে।

হরমোনের ব্যাঘাত
এন্ডোক্রাইন বিঘ্ন: অনেক দূষিত পদার্থ এন্ডোক্রাইন ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী রাসায়নিক হিসেবে কাজ করে, যা টেস্টোস্টেরন, লুটিনাইজিং হরমোন এবং ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোনের মতো হরমোনের উৎপাদন ও নিয়ন্ত্রণে হস্তক্ষেপ করে।

টেস্টোস্টেরনের মাত্রা: দূষণকারী পদার্থ টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কমিয়ে দিতে পারে, যা শুক্রাণু উৎপাদন এবং পুরুষ প্রজনন স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

ডিএনএর ক্ষতি
শুক্রাণুর ডিএনএ ফ্র্যাগমেন্টেশন: দূষণের ফলে শুক্রাণুর ডিএনএ ভেঙে যেতে পারে, যার ফলে উর্বরতা কমে যায় এবং গর্ভপাতের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

এপিজেনেটিক পরিবর্তন: দূষণকারীর সংস্পর্শে এপিজেনেটিক পরিবর্তন ঘটাতে পারে, যেমন ডিএনএ মিথিলেশন, যা প্রজনন কার্যের সাথে সম্পর্কিত জিনের অভিব্যক্তিকে পরিবর্তন করতে পারে।

প্রদাহ এবং ইমিউন প্রতিক্রিয়া
দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ: দূষণকারী পদার্থ শরীরে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে, যা অণ্ডকোষ এবং শুক্রাণু উৎপাদনে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।

ইমিউন সিস্টেম অ্যাক্টিভেশন: দূষণকারী পদার্থের অবিরাম এক্সপোজার ইমিউন সিস্টেমকে সক্রিয় করে, যা অ্যান্টিবডি তৈরি করে শুক্রাণু কোষকে আক্রমণ করতে পারে।

এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ডোক্রাইনোলজি ও মেটাবোলিজম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং এন্ডোক্রাইনোলজি অ্যান্ড মেটাবোলিজম সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহজাদা সেলিম বাংলানিউজকে বলেন, মাত্রা এবং ধরণ আলাদা হলেও ঢাকা থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যায়ে সবখানেই দূষণ আছে। দূষণে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন। বায়ু দূষণে অধিকাংশ সময় ঢাকা শীর্ষে থাকে। ঢাকাতে প্রায় দুই কোটি লোক বসবাস করে, যার প্রায় অর্ধেক পুরুষ। এর মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ লাখ রয়েছে প্রজননক্ষম পুরুষ। এদের সবাই সর্বোচ্চ মাত্রার ঝুঁকিতে আছে।

দূষণ প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, দুষিত বায়ুর মধ্যে সিসা থাকে। আমরা ঢাকায় যে ধরণের যানবাহন ব্যবহার করছি, মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেলে সেগুলো বন্ধ হয় না। আমাদের জ্বালানি তেল মানসম্মত নয়। এগুলোর কারণেও বায়ু দূষণ হয়। দুবাই ঘোষণা দিয়েছে আগামী বছর থেকে তারা জিরো কার্বন নিঃসরণে যাবে। ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ নরওয়ে, তারা দূষণ রোধে ইলেকট্রিক বাস এবং ট্রেন ব্যবহার করে। আমাদের এসবের ঘাটতি আছে। ফলে আমরা ঝুঁকিতে পড়ছি। দিন দিন বন্ধ্যা দম্পতির সংখ্যা বাড়ছে। এর মধ্যে পুরুষরা বিশেষ ঝুঁকিতে আছে।

দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে তিনি বলেন, রাজধানী ঢাকায় সরবরাহ করা পানি পানযোগ্য নয়। ফিল্টার করে কিংবা ফুটিয়ে পান করতে হয়। এটাও দূষণের আরেক রূপ। আমাদের বিশাল সংখ্যক মানুষের খাদ্য সরবরাহ ঠিক রাখতে গিয়ে কীটনাশক ব্যবহার করছি। ধান, সবজি বা অন্যান্য ফসলে কীটনাশক প্রয়োগ করলে, সেটা দীর্ঘদিন থেকে যায়। এটা আমাদের শরীরে মধ্যে ঢুকে যেখানে টেসটোস্টেরন তৈরি হয়, সেখানে আঘাত করে।

এন্ড্রোকাইন অ্যান্ড মেটাবোলিজম সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক বলেন, আমাদের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ গার্মেন্টসে কাজ করে। গার্মেন্টসে রঙ ব্যবহার করা হয়। আবার চামড়া শিল্পেও রঙ ব্যবহার করা হয়। এসব রঙয়ের মধ্যে থাকা কেমিক্যাল প্রজনন স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। স্বাস্থ্যগত কারণে এক্সরে, এনজিওগ্রাম কিংবা রিং লাগানোর সময় রেডিয়েশন হয়, তাতেও অণ্ডকোষ এবং থাইরয়েড গ্লান্ড আক্রান্ত হয়। খাবারে ভেজাল থাকার পরেও আমাদের গড় আয়ু বাড়ছে কিন্তু প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, পুরুষের অণ্ডকোষ দেহের বাইরে থাকার কারণে শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা থেকে দুই ডিগ্রি কম তাপমাত্রায় এটাকে রাখতে হয়। ঢাকা কিংবা ঢাকার আশেপাশের বেশিরভাগ মানুষ নিয়মিত বাসে চলাচল করে। বাসের সিটে রেক্সিন থাকে। কেউ যদি দেড় থেকে দুই ঘণ্টা নন এসি বাসের সিটে বসে থাকে, তাহলে সিটে যে তাপ উৎপন্ন হবে, সেটা অণ্ডকোষের চরম ক্ষতির জন্য যথেষ্ট। গন্তব্যে যাওয়া আসা মিলে প্রতিদিন দুইবার এবং সপ্তাহে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় দিন যাওয়া আসা করতে হয়। এরা প্রায় সবাই প্রজননক্ষম। এ থেকে বোঝা যায়, তারা কতটা প্রজনন স্বাস্থ্যের ঝুঁকিতে আছেন।

ঢাকা এবং ঢাকা বাইরের মানুষের ঝুঁকি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঢাকায় বসবাস করা মানুষ প্রজনন স্বাস্থ্যের চরম ঝুঁকিতে আছে। ঢাকার বাইরের মানুষও কম ঝুঁকিতে নেই। বাতাসে সিসার পরিমাণ ঢাকায় বেশি, তবে ঢাকার বাইরেও আছে। সারা দেশের মানুষ এভাবেই বাসে চলাচল করে। সামগ্রিক বিবেচনায় পুরুষের যৌন ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে এবং প্রজনন স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে।

এখন ফার্টিলিটি সেন্টারগুলোতে আগের থেকে অনেক বেশি মানুষ চিকিৎসা নিচ্ছেন। আবার বহু সংখ্যক মানুষ ভারত বা অন্য কোনো দেশে প্রধানত ফার্টিলিটি চিকিৎসার জন্য যাচ্ছেন। একটা সময় বাড়তি জনসংখ্যা আমাদের দেশের জন্য সমস্যা ছিল, তবে সামনের দিনগুলোতে হয়তো উল্টো জনসংখ্যা কমে যাবে, জনসংখ্যা বাড়ানোর জন্য তখন আমাদের চিকিৎসা করতে হবে, সেই ঝুঁকিও ইতিমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে বলেও জানান তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ০১৫৯ ঘণ্টা, মার্চ ০৯, ২০২৫
আরকেআর/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।